Koyel Talukder

কোন্‌ অচিনপুরে /
কোয়েল তালুকদার

তিন মাস হাসপাতালে থাকার পর আজই বাসায় ফিরেছে নাজমা। বাসায় এসে দেখে সবকিছু এলোমেলো। তার সাজানো সংসার যেভাবে সাজিয়ে রেখে গিয়েছিল, তা আর আগের মতো নেই। আলনায় কোনো কাপড় ভাজ করা নেই। ময়লা করে একটার উপর আরেকটি কাপড় অগোছালো করে
রেখে দিয়েছে । বিছানা পরিপাটি নেই। ঘরের মেঝের কোণে কোণে ময়লা জমে আছে। রান্না ঘরের মেঝেতে মাছি উড়ছে। ময়লার ঝুড়ির ভিতর বাসি খাবার পড়ে আছে। হাঁড়ি পাতিলগুলো ঝকঝকে নেই। এলোমেলো এসব জিনিস দেখতে দেখতে নাজমা কেমন যেন হাঁপিয়ে উঠছিল।

শরীরে ক্যামো দেওয়ার কারণে এমনিতেই দূর্বল ছিল। কোনো কিছুই ভালো লাগছিল না। হাত পা কাঁপছিল। ওর এই অবস্থা দেখে ওর স্বামী ওকে হাত ধরে ভিতরে বিছানায় নিয়ে শোয়ায়ে দেয়।

নাজমা’র চার মাসের বাচ্চাটি পাশের রুমে দোলনায় ঘুমাচ্ছে। নাজমা ওর স্বামীকে বলে — ‘মর্জিনাকে বলো, বাবুকে একটু আমার কাছে নিয়ে আসতে।’ মর্জিনা যখন বাবুকে নিয়ে আসে তখনো ওর ঘুম ভাঙ্গে নাই। বাবু’র জামাটি ফিডারের দুধে ভিজে আছে। ফিডারের নিপলটা পুরোনো দুধের গন্ধে ভরে গেছে। বাবুর চোখে কোনো কাজল নেই। কপালে কোনো কালো টিপ নেই। নাজমা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে এগুলো দেখছিল , আর বিষাদে ছলছল হয়ে উঠেছিল ওর চোখ ।

পিছনে ফিরে দেখা —

আজ থেকে দেড় বছর আগে এক বসন্ত দিনে নাজমার বিয়ে হয়। মধুরতম এক ভালোবাসায় সাজিয়ে তোলে নিজের ঘর। আহ্লাদের জীবন ছিল তার প্রতিদিন। বিয়ের পর প্রিয়তম স্বামীর সাথে কতো জায়গায় সে ঘুরেছে। কতো প্রান্তর , কতো পথ যে দু’জন হাতে ধরে হেঁটেছে। কতো বনছায়া তলে তারা একান্তে বসে থেকেছে, কতো নদীর কূলে তারা জলের গান শুনেছে। তারা ঘুরে বেড়িয়েছে পাহাডে পাহাড়ে , আবার গিয়েছে কখনো সাগর বালুকাবেলায়। কতো ক্ষণ গানে গানে কেটে গেছে দুজনের। যেন — ‘ আমারে তুমি অশেষ করেছ এমনই লীলা তব, ভরিয়ে তুলে শূন্য করেছ এমনই নব নব।’

তারপর একসময় বাবু পেটে এলো। কতো স্বপ্ন ভরা চোখ নিয়ে বাবুর আগমনের দিন গুণতে থাকে।
একদিন সন্ধ্যারাতে উত্তরার একটি ক্লিনিকে সিজার করে একটি রাজপুত্রকে এই পৃথিবীতে নিয়ে আসা হয় । ঠিক তারপরেই জানা গেল মরণ ব্যাধি ক্যান্সার বাসা বেঁধেছে তার শরীরে। তারপরেই তার সাজানো ঘর এলোমেলো হতে থাকে। হাসপাতালে থেকে আজই নাজমা ঘরে এলো। এসে দেখতে পায় বারান্দায় ঝুল জমে আছে। উঠোনের ঘাসগুলো বড়ো হয়ে গেছে। ভেন্টিলেটরের ফাঁকে চঁড়ুই পাখি এসে বাসা বেঁধেছে।

আসলে ডাক্তার তাকে তিন দিনের জন্য হাসপাতাল থেকে ছুটি দিয়েছে বাড়ি আর বাবুকে দেখার জন্য। তিনদিন পর তাকে আবার হাসপাতালে ফিরে যেতে হবে। নাজমা একটা ব্যাপার পুরোপুরি জানেনা, সে বাঁচবে মাত্র আর জোর একমাস।

ঠিক তিনদিন পর একদিন বিকালে হাসপাতাল থেকে এ্যাম্বুলেন্স এসে বাড়ির গেটে থামে। নাজমাকে যখন এ্যাম্বুলেন্সে উঠানো হয়, তখনও বাবু তার কোলেই ছিল। সে দেখছিল বাবুর মুখ আর ফিরে ফিরে দেখছিল স্মৃতি বিজড়িত বাড়ির আঙ্গিনা।

একদিন হাসপাতালের বেডে নাজমা শুয়ে আছে। তার স্বামী সিয়রে দাঁড়ানো ছিল । নাজমার প্রাণ নিঃশেষিত প্রায়। শরীরের সব মাধূর্য নষ্ট হয়ে গেছে। মাথার চুল সব পড়ে গেছে। দাঁত ও হাতপায়ের নোখগুলো কালো হয়ে গেছে। স্বামীর দিকে নিষ্প্রভ চোখে তাকিয়ে নাজমা বলছিল– ‘ওগো আমি চলে গেলে তোমাকে দেখবে কে ? বাবুকে দেখে রাখবে কে?’ স্বামী ওর কপালে হাত বুলিয়ে বলেছিল – ‘তুমি ভালো হয়ে যাবে, তুমিই দেখবে।’

কিন্তু নাজমা আর ভালো হয় নাই। প্রায় একমাস পর একটি লাশবাহি গাড়ি বাড়ির গেটে এসে থামে। এবার আর ওকে ঘরের ভিতর নেওয়া হলো না। বাইরেই ওকে ধোয়ায়ে কাফনের কাপড় মুড়িয়ে কবরস্থানে মাটির ঘরের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়।

তারপর অনেক দিন চলে গেছে। নাজমার সাজানো সেই ঘর এখনো এলোমেলোই থাকে। এখনো বারান্দায় জমে থাকে ঝুল। এখনো ঘরের আসবাব পত্রের উপর ধুলোবালি পড়ে আছে। আলনায় কাপড় চোপর এলোমেলো। ঘরের চালের ফাঁকে চঁড়ুই পাখিরা এসে আরো বেশি করে বাসা বেঁধেছে।

নাজমার আদরের খোকনসোনা প্রায় সময় অনাদরে দোলনায় শুয়ে থাকে। প্রায়ই ও কান্না করে। ওর কান্নাভেজা চোখ হয়তো মাকে খুঁজে বেড়ায়। গৃহকর্মী মর্জিনার আদর নিতে চায় না। নাজমার স্বামী প্রায়ই বাচ্চাটিকে কোলে নিয়ে বাড়ির আঙ্গিনায় পায়চারি করে। স্বজনেরা কত করে বলেছে তাকে — আর একটি বিয়ে করতে। কিন্তু তিনি তা করেনি।

অন্ধকার রাতে বারান্দায় ইজি চেয়ারে একাকী সে বসে থাকে। মনখারাপের চোখে দূরে নক্ষত্রবীথির মাঝে খুঁজে বেড়ায় তার প্রিয়তমা স্ত্রীর মুখখানি। অন্তরের ভিতর তখন বিষাদের সুর বেজে ওঠে। কত স্মৃতি কত কথা মনে পড়ে। দুচোখ তার জলে ভরে ওঠে।

আঁধারের গা ছুঁয়ে কোথা থেকে এই গানটি যেন ভেসে আসে ক্লান্ত সুরে —

‘দূরে কোথায় দূরে দূরে. আমার মন বেড়ায় গো ঘুরে ঘুরে/ যে বাঁশিতে বাতাস কাঁদে সেই বাঁশিটির সুরে সুরে / যে পথ সকল দেশ পারায়ে উদাস হয়ে যায় হারায়ে / সে পথ বেয়ে কাঙাল পরান যেতে চায় কোন্‌ অচিনপুরে।’

~ ****~

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *