Koyel Talukder

গল্প – প্রাণ ভরিয়ে /
লেখক – কোয়েল তালুকদার

নতুন বিয়ে করেছি। মেস ছেড়ে দিয়ে কলাবাগানে বাসা ভাড়া নিয়েছি। বউকে নিয়ে উঠি সেই বাসায়। দুই রুমের ছোট্ট টিনসেডের একটি বাড়ি।

ছোট বাসা হলেও আঙিনা অনেক বড়ো। চারদিকে প্রাচীর ঘেরা। ঘরটা পিছনের দিকে। সামনে ডানে বামে খালি জায়গা। গলির দিকে বাসায় ঢোকার গেট।

ঘরের সামনের কোণে একটি ঝাঁকড়া আমগাছ থাকলেও বাকী খালি জায়গায় ঘাস ও বিভিন্ন লতা গুল্মে জঙ্গল হয়ে আছে। একদিন বাড়ির মালিককে আমি বললাম — ‘আমি কী জঙ্গল পরিস্কার করে খালি জায়গায় কয়েকটি ফুল গাছ লাগাতে পারি?’ মালিক বললেন, ‘অবশ্যই লাগাতে পারেন। এত ভালো কথা। আমার কোনো আপত্তি নেই।’

আমার স্ত্রী থানা শহরের মেয়ে। স্থানীয় কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেছে। বাবা স্কুল মাস্টার। মা গৃহিণী। দুই ভাই বোন। ছোট সুখী পরিবার। হারমণিয়াম বাজিয়ে সে ভালো রবীন্দ্র সংগীত গাইতে পারে। স্কুল কলেজের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সে গান গাইত।

তাকে এখানে পড়াতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সে অভিমানহীন ভাবে বলেছিল — আমি শুধু তোমার ঘর সংসার করব। আমাকে পারলে একটি হারমণিয়াম কিনে দিও। যখন মন খারাপ লাগবে তখন ঘরে বসে গান গাইব।’

বিয়ের প্রথম মাসে বেতন পেয়ে তাকে একটি হারমণিয়াম কিনে দেই। প্রথম দিনে প্রথম যে গানটি সে গেয়ে শোনায়েছিল —

আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে দেখতে আমি
পাই নি।
বাহির-পানে চোখ মেলেছি, আমার হৃদয়-পানে
চাই নি।

একদিন অফিস থেকে এসে তাকে বলি, কী ফুল তুমি পছন্দ করো, সেই ফুল গাছ আঙিনায় লাগাব।
— আমার প্রিয় ফুল গন্ধরাজ। তোমার কী ফুল পছন্দ?’ আমি বললাম, আমার পছন্দ জবা। উল্লেখ্য আমার স্ত্রীর নাম জবা।

এক শ্রাবণের বৃষ্টিমুখর দিনে ঢাকা কলেজের সামনে থেকে আমরা দুজন বেশ কয়েকটি জবা আর গন্ধরাজের চারা রিক্সার হুডি ফেলে ভিজতে ভিজতে কিনে এনে আঙিনায় লাগিয়ে দেই।

খুব অল্প সময়েই ফুলগাছ গুলো বড়ো হতে থাকে। এবং একসময় গাছগুলোতে ফুুল ফুটতে থাকে। যেদিন প্রথম জবা ফুল ফোটে, সেদিন কাকতালীয় ভাবে জবার জন্মদিন ছিল।

অফিস থেকে একটু তাড়াতাড়িই বাসায় আসি।ফেরার পথে জবার জন্য গাওসিয়া মার্কেট থেকে একটি সবুজ রঙের টাংগাইলের তাঁতের শাড়ি কিনে নিয়ে আসি।

বিকালে ওকে বললাম — শাড়িটি পরো। জবা শাড়িটি পরে। আমি দুটো জবা ফুল ছিঁড়ে এনে ওর খোঁপায় পরিয়ে দেই। সে হাতে কাঁচের চুড়ি পরে। কপালে লাল টিপ ও ঠোঁটে লিপস্টিক লাগায়। খুব ভালো লাগছিল ওকে। যেন কুমুদিনী।

আমরা একটা খোলা রিকশা করে শেরেবাংলা নগর চন্দ্রিমা উদ্যানে চলে যাই। পরন্ত বিকালের নীল আকাশ দেখতে দেখতে আর নাগরিক কোলাহল পেরিয়ে আমরা উদ্যানে চলে যাই। পথে যেতে যেতে জবা গুনগুন করে গেয়েছিল —

তোমার খোলা হাওয়া লাগিয়ে পালে টুকরো করে কাছি

আমি ডুবতে রাজি আছি আমি ডুবতে রাজি আছি।

উদ্যানের সবুজ ঘাসে বসে সেদিন দুজন কত কথাই বললাম। কত স্বপ্নের কথা। জীবনের কথা। ঘর সংসারের কথা। সন্তান নেবার পরিকল্পনার কথা। আরো কত কথা। কথা বলতে বলতে একসময় সব কথা ফুরিয়ে যায়। পাশে হাস্নাহেনার ঝাড় থেকে সুবাস ভেসে আসছিল। উদ্যানের সন্ধ্যার পাখিদের কলরব থেমে গেল।
নীরবতা ভেঙে আমি জবাকে বললাম — ‘এখানে আজ কোনও গান হলো না যে!’
জবা আমার বাহুতে মাথা ঠেকিয়ে বলেছিল —
‘এখন গান নয় গো, আজ আমরা দুজন শুধু দুটো প্রাণের হব। চলো, ঘরে ফিরে যাই।’

আলো আঁধারে দুজন হাত ধরে হাঁটতে হাটঁতে উদ্যানের বাইরে চলে আসি। আবারও একটি খোলা রিকশা করে আকাশ ভরা তারা দেখতে দেখতে বাসায় চলে আসি।

রাতটি ছিল স্বপ্ন আর ঘুম জড়ানো। জানালা খোলা ছিল। জবাফুল গন্ধ বিলিয়েছিল গন্ধরাজের গায়ে। কী এক আশ্চর্য দ্যোতনা। বাতাস এসে কথা বলেছিল আমাদের কানে কানে। যেন —

দিকে দিগন্তে যত আনন্দ লভিয়াছে, এক গভীর গন্ধ,

আমার চিত্তে মিলি একত্রে তোমার মন্দিরে উছাসে।

সকালে আমার আগে ঘুম ভাঙে। দরজা খুলে এমনিতেই বারান্দায় গিয়ে একটু দাঁড়াই৷ আঙিনায় চেয়ে দেখি– ঘাসের উপরে একগুচ্ছ গোলাপ ফুল পড়ে আছে।
আমি জবাকে ডেকে বলি– ‘দেখ, কে যেন রেখে গেছে এই ফুল!’
জবাও বিস্মিত হয়! তবে ফুলগুলো দেখে তার মনে পড়ল — এক জন্মদিনে এমনই এক গুচ্ছ গোলাপ ফুল তাকে দিয়েছিল তাদেরই ছোট্ট থানা শহরের এক উন্মূল তরুণ। ছেলেটি ওর সহপাঠী ছিল। সে ভালো গানও গাইত।

একদিন অফিস থেকে এসে দেখি, জবার খুব মন খারাপ। কথা বলছে ভারি কণ্ঠে। চোখ দেখে বোঝা গেল, এই চোখ একটু আগে অঝোর ধারায় কেঁদেছে। এখনও সিক্ত। এখনও চোখের দুই কোণ্ চিকচিক করছে।

জবার মনখারাপ থাকলে আমারও মনখারাপ লাগে। ও কাঁদলে আমারও চোখ ছলছল করে ওঠে। আমি ওকে বললাম, চলো কোথাও থেকে ঘুরে আসি। জবা বলছিল– ‘কোথায় নিয়ে যাবে’। বললাম, ‘শিশু পার্কে। ওখানে শিশুদের দোলনায় দোল খাওয়া দেখবে। ঘোড়ায় চড়ে ওরা হাট্টিমাটিম গান গায়। সেই গান তুমি শুনবে। ওদের সাথে আমরাও রেলগাড়িতে উঠব।’
জবা বলল — আচ্ছা, নিয়ে চলো।

আমাদের প্রিয় যান খোলা রিকশায় করে সেদিন গিয়েছিলাম শিশু পার্কে। পার্কের গেটে দাঁড়িয়ে দুজন ফুসকা খাই। একটি বালিকা এসে ওকে বলে, ‘আপা বকুল ফুলের মালা নিবেন?’ আমি জবাকে বললাম, নাও দুটো মালা। খোপায় পরিয়ে নাও। খুব ভালো লাগবে।

আমরা দুজন নাগরদোলায় উঠেছিলাম। নাগরদোলাটি যখন সুউচ্চ চূড়ায় পৌঁছে, তখন জবা আমার দুহাত চেপে ধরেছিল। আমি ওর দিকে চেয়ে মনে মনে বলেছিলাম — ভয় পেওনা তুমি। আমি তোমার জীবনেও আছি। আমি তোমার মরণেও পাশে আছি।

সেদিন ছিল ছুটির দিন। দুপুরে খেয়ে বিছানায় দুজনই শুয়ে আছি। কোনো কথা নেই কারোরই। আম গাছটায় বসে দোয়েল শিস দিচ্ছিল খুব মায়া করে। জবা আমার হাত ধরে। ঠিক মনে হলো বাইরে ডাকা ঐ দোয়েলটির মতো মায়া করে আমার দিকে তাকিয়ে বলছিল– তুমি আমাকে অনেক ভালোবাসো, না!
— জ্বী বাসি।
— যদি দূরে চলে যাই, তোমার খুব মন খারাপ লাগবে?
— হে..
— জানো, আমি যে কলেজে পড়তাম, সে কলেজে স্কুলের মতো ঘন্টাধ্বনি বাজত। কলেজ ছুটি হলে আমরা রেললাইনের স্লিপারের উপর দিয়ে জোরে জোরে হেঁটে বাড়ি চলে আসতাম।
— তাই!
— আমাদের বাড়ি থেকে ট্রেনের হুইসেল শোনা যেত। বাড়ি থেকে একটু দূরে ছোট্ট একটি রেল ব্রিজ আছে খালের উপরে।
— আচ্ছা।
— ঐ ব্রিজটা আমার খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। তুমি নিয়ে যাবে আমাকে ঐ ব্রিজ দেখাতে?
— নিয়ে যাব। একটা গান গেয়ে শোনাওনা শুয়ে শুয়ে খালি গলায়। জবা গাইছিল —

দূরে কোথায় দূরে দূরে
আমার মন বেড়ায় গো ঘুরে ঘুরে।
যে বাঁশিতে বাতাস কাঁদে সেই বাঁশিটির সুরে সুরে।
যে পথ সকল দেশ পারায়ে উদাস হয়ে যায় হারায়ে
সে পথ বেয়ে কাঙাল পরান যেতে চায় কোন্‌ অচিনপুরে।

সুখে দুঃখে আনন্দ বেদনায় দিনগুলো আমাদের ভালোই কাটছিল। কিন্তু জবার শরীরটা ভালো যাচ্ছিল না খুব একটা। দিনে দিনে সে খাওয়ার রুচি হারিয়ে ফেলে। রাতে রাতে তার জ্বরও আসে। ডাক্তার দেখাই। চিকিৎসা চলতে থাকে।

আঙিনায় জবা ও গন্ধরাজ ফুলগাছ গুলো পরিচর্যার অভাবে দিনে দিনে শ্রীহীন হয়ে মরে যেতে থাকে। জবা ফুল গাছে আর ফুল আসে না। গন্ধরাজ আর কোনও গন্ধ বিলায় না সন্ধ্যারাতে। আঙিনায় লতাপাতা গুলো বেড়ে আগাছায় ভরে ওঠে।

সেদিন ছিল আমাদের বিয়ে বার্ষিকী। অফিস থেকে ফিরতে সন্ধ্যা রাত হয়ে যায়। জরুরি কাজে আটকে পড়েছিলাম। ফেরার পথে গাওছিয়া মার্কেট থেকে জবার জন্য একটি লাল বেনারসি শাড়ি কিনি। আর কিনে নিয়ে আসি একগুচ্ছ লাল গোলাপ।

গেট দিয়ে ঢুকতে আলোছায়ায় আঙিনার ঘাসের উপর একটি ভাজ করা কাগজ দেখতে পাই। হাতে উঠিয়ে গলি থেকে আসা ল্যাম্পপোস্টের নিয়ন আলোয় কাগজটি খুলে পড়ি। দেখি, রবি ঠাকুরের একটি গান লেখা আছে। কাগজটি পড়ে আমার কাছেই রেখে দেই।

ঘরের ভিতর বিছানায় জবা শুয়ে আছে। খুব মায়া করে সে আমাকে তাকিয়ে দেখছিল। চোখের পাতা কেমন কালো হয়ে গেছে। যেন কত অশ্রুর দাগ লেগে আছে। যেন বলতে চাচ্ছে — ‘জীবন যখন শুকায়ে যায় করুণা ধারায় এসো।’

আমি ওকে বলি– একটু উঠে বসো, দেখো — তোমার জন্য আজ একটি বেনারসি শাড়ি কিনে নিয়ে এসেছি। একটু পরে নাও।’

জবা পরম আনন্দে শাড়িটির দিকে চেয়ে বলে — ‘আমি খুব খুশি হয়েছি। তবে আজ পরব না লক্ষীটি। আমি ভালো হয়ে উঠি, তখন পরব।’
— আচ্ছা, তাই পরবে।

আমি ঘরের জানালাটা খুলে দেই। আম গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে অপূর্ব সুন্দর চাঁদের আলো এসে পড়ে জবার মুখের উপর! আমি ওকে বলি — একটা গান গেয়ে শোনাও না! জবা আমাকে বলে কোন্ গানটি শুনবে তুমি?
আমি ওকে বলি — ‘প্রাণ ভরিয়ে’।
জবা গেয়ে শোনালো —

প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে মোরে আরো আরো আরো দাও প্রাণ।
তব ভুবনে তব ভবনে মোরে আরো আরো আরো দাও স্থান।

গানটি গাইতে গাইতে জবার চোখের কোণ ভিজে উঠছিল। হয়ত তার মনে পড়ছিল —
কবে এক বিষণ্ণ সন্ধ্যায় ছোট্ট থানা শহরের এক উন্মূল তরুণ এই গানটি গেয়ে শোনায়েছিল তাকে, বাড়ি থেকে দূরে একটি রেল ব্রিজের কাছে ঘাসের উপর বসে থেকে।

****

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *