Koyel Talukdar

  • যা হারিয়ে যায়

    কোনো একসময় প্রতিদিনই চিঠি আসত কণিকার। কোনো কোনো দিন তিন চারটি করে। এত ভালোবাসা আর এত ভালোলাগা থাকত সেইসব চিঠিতে। জীবন ভরে উঠত, হৃদয় দুলে উঠত। কতো ঝিম দুপুর পার করেছি এইসব চিঠি পড়ে। চিঠি হয়ে উঠত এক একটি কবিতার প্রহর । কণিকা কাকে ভালোবেসেছিল? আমাকে না আমার কবিতাকে? সে যখন লেখে —

    প্রিয় সখা, তোমার ‘চোখ’ কবিতাটি পড়েছি। তুমি যে চোখ নিয়ে কবিতাটি লিখেছ সেটি কার চোখ ছিল? তুমি তো আমার চোখ দেখনি, কিভাবে মেলালে আমার ভ্রু। আমার চোখের তারা। লিখেছ, চোখের জলপতনের কথা। লিখেছ করোতোয়ার স্বচ্ছ জলের কথা। আমার চোখে নাকি স্বপ্ন আঁকা আছে। তুমি কোথায় পেলে সে স্বপ্নের রং। আবার লিখেছ, আমার চোখে নাকি কান্না মানায় না। ভূবন জোড়া হাসি দেখতে চাও। আমি স্বপ্ন দেখি দুই চোখ ভরে। স্বপ্ন দেখি তোমাকে নিয়ে। তুমি যে চোখে স্বপ্ন খোঁজো, আমি সেখানে খুঁজি মুক্তির স্বাদ। দিন আসে দিন যায়। রাত্রি আর ফুরায় না। আমি কি কোনো অনন্ত দূঃখের ছায়া দেখতে পাই। নাহ্ এসবই আমার দুর্ভাবনা। আমি তোমার স্বপ্ন হতে চাই। আমি তোমার দূরের মাধবী হয়ে থাকতে চাই না।

    আমি লিখেছিলাম —
    কণিকা, পড়তে পড়তে আমার ঘুম এসে যায়। লিখতে লিখতে ঘুম এসে যায়। তোমার কথা ভাবতে ভাবতে ঘুম এসে যায়। কালকে হেনা স্যারের পদাবলীর ক্লাসে রাধার বিরহবিধুর কথা শুনতে শুনতে ঘুম এসে গিয়েছিল। ঘুম আসুক, কিন্তু সে ঘুমে কোনো স্বপ্ন না আসুক। বন্ধন আমার ভালো লাগে না। জীবন যেভাবে চলছে, সেই ভাবেই চলুক। আমার সবকিছুই এলমেল, কোনোকিছুই সাজাতে চাই না। আমি যে পথে চলছি, সেই পথ চলা অন্তহীন। তুমি আমার যাত্রী হইও না।

    কনিকা কি মনে করে লিখেছিল — ‘ আমি তোমার জন্য পথে নেমেছি। এই পথ মিলবে একদিন তোমারই পথে। পথের মাঝের এই ক্লান্তিকে তুমি থামিয়ে দিও না। আমার পথের মাঝে ফুল বিছিয়ে নাইবা রাখলে, কাঁটা বিছিয়ে রেখ না। আর যদি রাখো, সেই কাঁটা বিঁধেই আমি হাঁটব। রক্ত ঝরবে পথে, ঝরুক না। আমি একদিন ঠিকই পৌঁছে যাব তোমার বাড়ি। যদি তুমি তুলে নাও তোমার ঘরে।’

    একটি চিঠিতে লিখেছিলাম —
    তুমি করোতোয়া পাড়ের মেয়ে। যে স্বচ্ছ জল তুমি হাত দিয়ে ধরো, সে সৌন্দর্য তোমার। শিমুল পিয়াল থেকে যে ফুল ঝরে পড়ে, সে রক্তিম পাঁপড়ি তোমার। ফাগুনে যে জীর্ণ পাতা ঝরছে, সে মর্মরধ্বনি তোমার। বসন্ত রাতে জ্যোৎস্নার যে মাধুর্য, সে সিম্ফোণীও তোমার। এই শহরের রুক্ষ ইট পাথরের কথা তুমি শুনতে চাইবে না। অট্টালিকার ফাঁকে যে পূর্ণিমার চাঁদ ওঠে, তা দেখে তুমি কখনোই তোমার দয়িতের জন্য আকুল হবে না। এখানে কখন শুক্লপক্ষ আর কখন কৃষ্ণপক্ষ হয়, তুমি জানতে পারবে না।

    কি এক আবেগ ছিল তার, কি এক ভালোবাসার টান ছিল কণিকার। একটি চিঠিতে সে লিখেছিল — ‘আমার আর সালোয়ার কামিজ পড়তে ইচ্ছা করে না। আমার মাথায় ঘোমটা দিয়ে শ্বশুরবাড়ির উঠোনে হাঁটতে ইচ্ছা করে। কুয়া পার থেকে কলসীতে জল তুলতে ইচ্ছা করে। তুমি সোহাগপুরের হাট থেকে একটি সবুজ রঙের তাঁতের শাড়ি কিনে এনে দেবে। আমি সাধারণের মতো করে পরবো সে শাড়ি। করোতোয়ার স্বচ্ছ জল কলসী ভরে আমি নিয়ে যাব তোমাদের বাড়ি। যমুনায় মিশাব সে জল। তুমি কি আমাকে পাগলি ভাবছ। আসলেই হয়ত তাই। এসবই আমার ভাবনার কথা। তুমি হাসবে না। এ যে আমার ভালোলাগার কথাও।’

    কণিকা, এইভাবে স্বপ্ন দেখ না। যদি সব স্বপ্ন একদিন ভেঙে যায়, সেদিন কার কাছে এসব স্বপ্নের কথা বলবে। তুমি কবিতাকে ভালোবাসো, কবিতাকেই বাসো। আমাকে না। আমি বিহঙ্গের মতো ঘুরে ফিরি নীল আকাশের মেঘের নীচে। কখনো হয়ে যাই ডানামেলা গাংচিল সমুদ্রের। রাতের নিবিড়ে সাগরের শব্দ শুনি। তোমার ওখানে আছে হেমন্তের চাঁদের রাত্রি। আমার আছে ঝলমলে নিয়ন বাতি। তুমি করোতোয়ার পাড়ে ভাটিয়ালী গান শোনো মাঝিদের। আমি বুড়িগঙ্গার পাড়ে যেয়ে শুনি অসংখ্য লঞ্চের কর্কশ ভেঁপুর শব্দ। আমার সাথে তোমার জীবন মিলবে না।

    প্রিয় কবি, তোমাকে কেবল চিঠিই লিখে গেলাম। তোমার কন্ঠ কখনো শোনা হয় নাই। তুমি কেমন করে বলো – ‘ভালোবাসি’, বড়ই শুনতে ইচ্ছা করে এ জীবনে। তুমি যে গান লিখ সে গান আর কে শোনাবে। তুমি দেখতে কেমন, তোমার সে রূপ আমার অন্তরে গেঁথে আছে। প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলায় আমাকে যে দীপ জ্বালাতে হবে, তা তোমার সেই মূর্তিকে সামনে রেখেই জ্বালাতে হবে। এ এক অসীম বেদনার দীর্ঘশ্বাস। তোমার গায়ে সে তপ্ত বাতাস কোনদিনই লাগবে না।

    কণিকা, রাত জেগে জেগে তোমাকে নিয়ে অনেক কবিতা আমি লিখেছি। তোমার শরীরবৃত্ত সাজিয়েছি আমি মাত্রাবৃত্ত ছন্দে। তোমাকে আমি কোনো দিন দেখিনি কিন্তুু তোমাকে দেখেছি আমার কবিতায়। তোমার কাজল কালো চোখ এঁকেছি প্রিয়তম শব্দগুলি দিয়ে। তোমার চুলের সুবাস নিয়েছিলাম কত দখিনা বাতাস থেকে। তোমার মায়াময় ঐ মুখের দিকে তাকিয়ে রয়েছি কতো রাত। সবই যেন এক রূপকথা। মাঝে মাঝে মনে হয়, তোমাকে পেলে ভালোই হতো।সোহাগপুরের হাট থেকে শাড়ি কিনে এনে দিতাম তোমাকে । তুমি ঘোমটা দিয়ে হাঁটতে আমাদের বাড়ির উঠোনে। কিন্তু তা আর এ জীবনে হবে না।

    প্রিয়তম, তোমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা শুরু করতে না করতে সে স্বপ্ন দেখা তুমি ভেঙে দিও না। আমি প্রায়ই করোতোয়ার নদীর পাড়ে বসে নিস্তব্ধ জল দেখি। কি নির্জনতা চারদিকে। আমি কান পেতে থাকি তোমার পদধ্বনি শোনার জন্য। জীবনের আর কোনো মধুর রাগিণী শোনা হলো না। প্রায়ই ভ্রান্তি হয়, তোমার গভীর আলিঙ্গনে উদ্বেলিত হই। তোমার বুকের গন্ধ লাগে আমার গায়ে। আচ্ছা বলো তো, জীবন এমন কেন? আমি কি বেশি কিছু চেয়েছিলাম? যাক, নাই বা হলে তুমি আমার। তোমার লেখা কবিতা আর গানগুলোই আমার জীবনের করে নেব।

    তারপর কোনো এক সময়ে কণিকাকে আর খুব বেশি চিঠি লিখি নাই। কণিকা মাঝে মাঝে লিখেছে, কিন্তু তার আর উত্তর দেওয়া হয় নাই। শেষ যে চিঠিটি লিখেছিল সেখানে সে বলেছিল — ‘তুমি কি সত্যিই আমার স্বপ্ন ভেঙ্গে দিলে? তুমি আর আমায় লিখবে না? ‘ আমি সেই চিঠিরও উত্তর দিয়েছিলাম না। জীবনে এরকম কত মায়া এসেছে, এরকম কত কনিকা’ই তো চিঠি লিখেছে। একটা হেয়ালি অহংকার ছিল আমার। যে অহংকার করতে ভালোই লাগেত। এর জন্য কতজন যে চোখের জল ফেলেছে। আবার এজন্যে আমাকে অনুতপ্তও হতে হয়েছে। সব কিছুরই একটি প্রায়শ্চিত্ত আছে।

    এমনি এক প্রায়শ্চিত্তের কথা বলছি। কণিকাকে আমি একদম ভুলেই গেছি। আমার কোনো কবিতায়, কোনো গানে সে আর ছিলো না। একদিন দুপুরে পোষ্টম্যান একটি চিঠি দিয়ে যায়। অনেক দিন পর কণিকার চিঠি। হঠাৎ পুরনো আবেগ প্রাণে দোলা দিয়ে উঠলো। আমি খুলে চিঠিটি পড়ছিলাম —

    ‘প্রিয়তম, জীবনকে হার মানাতে পারলাম না। আমার এই জীবন আমার একার নয়। এ জীবন আমার বাবা মা ভাই বোনদেরও। তাদের কাছে আমার অনেক ঋণ আছে। তাদেরকে আমার সুখী করার দায় আছে। আগামী অগ্রহায়ণের সাত তারিখে আমার বিয়ে। তুমি তো আর বিয়েতে আসবে না। তুমি আমার সুখের জন্য শুধু প্রার্থনা করিও।’

    সেদিন রুমেই সারা বিকেল শুয়ে রইলাম। চোখে আর ঘুম এল না। সন্ধ্যায় হাঁটতে হাঁটতে চলে যাই লাইব্রেরী এলাকায় হাকিম চত্বরে। পর পর তিন কাপ চা খেলাম। তিনটি সিগারেটও খেলাম। আজ কোনো পরিচিত বন্ধুর দেখা পেলাম না। সন্ধ্যার পর রাতে হলে চলে আসি। মন ভালো লাগছিল না। হলের বন্ধু মমিনের রুমে যাই। দেখি ওরা তিন বন্ধু নীলক্ষেত থেকে মৃত সঞ্জিবনী সুরা কিনে এনে খাচ্ছে। ওদের সাথে আমিও বসে কয়েক পেগ খেলাম। তারপর রুমে এসে ঘুম দেই।

    ছুটিতে বাড়িতে চলে আসি। বাড়িতে এসে শুনি, আমার এক কাজিনের বিয়ে। বগুড়ার মহাস্থানগড়ের এক গ্রামে। কনের নাম পারভীন আকতার কণিকা। আমাকে সে বিয়েতে বরযাত্রী হিসাবে যেতে হবে। গেলামও আমি।

    করোতোয়া নদীর পারে ছায়া সুনিবিড় একটি গ্রাম। সেই গ্রামেরই মেয়ে কণিকা। ওকে দেখে চমকে উঠি, এ যে সত্যিই আমার সেই কণিকা। যাকে আমি কল্পনায় অনেক ছবি এঁকেছিলাম। কণিকা লাল বেনারসি শাড়ি পরে ঘোমটা দিয়ে বসে আছে। সে আমাকে চিনতে পারেনি। কি অপরূপ কবিতার মতো সুন্দরী মেয়ে। কি মায়াময় তার চোখ! আমি বিমুগ্ধ নয়নে ওকে দেখছিলাম আর ভাবছিলাম, কণিকা তো আমারও বউ হতে পারত। জীবনে কত না পাওয়ার বেদনা আসে। সে যে আজ অন্য একজনের বউ।

    কি এক দহনে আস্তে আস্তে হেঁটে বাড়িটির সামনে করোতোয়া নদীর তীরে চলে যাই। দেখি শান্ত আর স্নিগ্ধ নদীর জল। আমি একটি ঢিল ছুঁড়ি, জল আলোড়িত হলো। কিছুক্ষণ পরে আবার স্তব্ধও হলো। জীবনটা কি এই রকমই? এই আলোড়িত হয়, এই স্তব্ধ হয়।

    ~ কোয়েল তালুকদার

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *