Koyel Talukdar

 

কাশফুল

বইমেলায় প্রথম দিকে ভীড় একটু কম থাকে। ধুলো উড়ে কম। যেখানে ধুলো নেই সেখানে থাকে ঘাস। ঘাসগুলোও সতেজ থাকে। পায়ে পায়ে নুয়ে মিশে যায় না মাটিতে। আমার প্রকাশক অনুরোধ করে বলেছিল, আপনি মাঝে মাঝে মেলায় আসবেন। স্টলের সামনে দাঁড়াবেন। অনেক পাঠক আপনাকে খোঁজে, আপনার অটোগ্রাফ চায়।

সেদিন কোনো ছুটির দিন ছিল না। মেলায় লোক সমাগম খুব কম ছিল । আমি স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম। তেমন কোনো দর্শনার্থী নেই। দু’একজন করে স্টলের সামনে এসে বইপত্র দেখছিল, নাড়াচাড়া করে দুচার লাইন পড়ছিল। পরিচিত তেমন কেউ আসছে না। একটু বোরিং লাগছিল নিজেকে। ভাবলাম, কফি খেয়ে আসি।

হঠাৎ দেখি — একটি একুশ বাইশ বছরের তরুণী স্টলের সামনে এসে দাঁড়ায়। আমি দূর থেকে দেখছিলাম মেয়েটি আমার বইগুলো পাতা উল্টিয়ে উল্টিয়ে দেখছে।

তরুণী সেলসম্যানকে বলছিল — লেখক সাহেব নেই?
সেলসম্যান ছেলেটি বলে — আছে।
ছেলেটি আমাকে ডাক দেয়। আমি কাছে চলে যাই। আমাকে দেখিয়ে ছেলেটি তরুণীকে বলে, ইনি হচ্ছেন লেখক।

মেয়েটি আমাকে সালাম দিয়ে বলে — আমি কী যে খুশি হয়েছি। জানেন, আমি কত যে আপনাকে খুঁজেছি। আজ আপনার দেখা পেলাম।

আমি মেয়েটিকে বলি — তোমাকে এর আগে কোথাও কী দেখেছিলাম? মেয়েটি বলে — না মনে হয়। আবার দেখতেও পারেন।

আমি আমাকেই মনে মনে বলছিলাম — ঠিক এই রকমই দেখতে একটি মেয়ের সাথে আমার পরিচয় ছিল। সে অনেক বছর আগের কথা। অনেক বছর আগেই সে আমার জীবন থেকে অনেক দূরের হয়ে গিয়েছিল। কী আশ্চর্য ! ঠিক সেই মেয়ের মতো এই মেয়েটির চোখ, ভ্রূ, থুতনি, কপাল, মাথার চুল, কণ্ঠস্বর, হাসি। এত অবিকল চেহারা হয়! আমি বিস্ময়ে এই মেয়েকে দেখেছিলাম আর ফিরে যাচ্ছিলাম, বহু বছর আগের দিনগুলোতে। মনে হচ্ছিল — সেই মেয়েটি যেন আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।

মেয়েটি বলছিল, আপনার আগের দুটো বই আমি সংগ্রহ করেছিলাম। আপনার নতুন প্রকাশিত এই গল্পের বইটি আমি আজ সংগ্রহ করলাম। আগের বই দুটোতে আপনার অটোগ্রাফ নিতে পারিনি। কী যে আফসোস করেছি। আজ আর কোনো আফসোস নেই। আপনার অটোগ্রাফ নেব। খুব খুশি লাগছে — আপনাকে দেখলাম। কী যে ইচ্ছে ছিল, আপনাকে দেখবার! আজ আপনাকে দেখলাম, আমার আর কোনো খেদ নেই।

মেয়েটি বইটি এগিয়ে দিয়ে বলে — অটোগ্রাফ লিখে দিন। আমি বইটি হাতে নিয়ে মেয়েটিকে বললাম — তোমার নাম কী ইশিকা? মেয়েটি অবাক হলো ভীষণ! বিস্মিত হয়ে বলছিল — আপনি আমার নাম জানলেন কী করে?

আমি বললাম — মনে হলো তোমার নাম ইশিকা। তাই বললাম।

— জানেন, এই নামটি রেখেছিল আমার মা। মাকে বলেছিলাম, এই নামের অর্থ কী? মা বলত, জানি না। যিনি আমাকে এই নামটি আমার মেয়ে হলে রাখতে বলেছিল — সে অনেক দূরে চলে গেছে। তার আর দেখা পাইনা।

ইশিকা আমাকে বলে — আপনি কী এই নামের অর্থ জানেন?

— জানি, ইসিকা নামের অর্থ হচ্ছে, শরতের শুভ্র তুলতুলে কাশফুল।

— জানেন আমার জন্ম হয়েছিল শরৎকালে। আশ্বিনের এক সন্ধ্যায় আমি নাকি এই পৃথিবীতে এসেছিলাম।

আমি বইটির সাদা পাতায় অটোগ্রাফ লিখি — “তোমার মেয়ের নাম রেখে দিলাম — ইশানা। মেয়ে হলে এই নামটি রেখো। ”

ইশিকা খুব খুশি হয় — বলে, এই নামের অর্থ কী ? বললাম — ইশানা অর্থ — ঐশ্বর্যময়ী।

আমি ইশিকার লাস্যময়ী মুখখানির ভিতর দেখছিলাম ঠিক বহু বছর আগের এমনই এক বিকালের অন্য একটি মুখকে। বংশী নদীর কূলে আমরা বসেছিলাম — ওপারে ছিল সারি সারি কাশবন। শুভ্র কাশফুল গুলোকে লাগছিল সাদা গালিচার মতো। নীচে সাদা ফুল ঢেউয়ে দোল খেলছিল, আর পশ্চিম আকাশকে লাল আভার মেঘ ছেয়ে রেখেছিল।

আমি ইশিকাকে বললাম — তোমার মা কেমন আছেন?
ইশিকা কতক্ষণ চুপ থাকে। তারপর মৃদু কম্পমান স্বরে বলছিল — মা তো নেই। দু’বছর আগে চলে গেছেন পরপারে।

ইশিকা আমার কাছে থেকে বিদায় নিয়ে চলে যায়। আমি ধীরে ধীরে হেঁটে চলে আসি উদ্যানের বিজয় স্তম্ভের দীঘির পাড়ে। সোপানে একাকী বসে থাকি সারা সন্ধ্যা। রাত্রিও নামছিল ধীরে — আঁধারে জলের ভিতর দেখছিলাম — বহুবছর আগের সেই বিস্মৃত মেয়েটির হাতে প্রদীপশিখা জ্বলছে, কী অপার্থিব স্নিগ্ধ নির্মল সেই দীপালোক, এই দীঘির জল কী অপরূপ ধারায় আলোকিত হয়ে উঠেছে।

~ কোয়েল তালুকদার

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *