নিজস্ব উপলব্ধির কাছেই নিজস্ব স্বাক্ষর: কানুরঞ্জন চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা
তৈমুর খান

তরুণ কবি কানুরঞ্জন চট্টোপাধ্যায়ের দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘নক্ষত্রের ঠিকানায়'(প্রথম প্রকাশ ২০২১) সহজ জীবনের আবেদনে নিজস্ব অনুভূতির উচ্চারণ এক স্বপ্নমেদুর জগতের ঠিকানা আমাদের সামনে উন্মোচিত করে। হৃদয় জুড়ে প্রেমের তীব্র পিপাসা, কিন্তু তা বাস্তবের রক্তমাংসে অধরাই থেকে গেছে। কেননা কবির প্রেম প্রকৃতির অনন্ত সোপানে নির্মোহ এক আবেগের প্রত্যয়নামা থেকে উদ্গত। সেখানে ভোগের আত্মচরিতার্থের কামুক আবিলতা নেই বললেই চলে। প্রেম যেন ঐশ্বরিক এবং প্রাকৃতিক আবেগের এক সমন্বয়ী প্রতিমা, তাই তার অনন্ত ঐশ্বর্য কবির প্রজ্ঞার সীমানাকে নক্ষত্রলোকের ঠিকানায় পর্যবসিত করেছে। তাই দ্বিধাহীন আত্মমগ্ন সংবেদনায় তার প্রকাশ:
“তোমাকে যতবার ছুঁতে চাই,
এক অবাধ্য নির্মোহ আবেশ
আমার হাতের আঙুলে
একগুচ্ছ ক্যাকটাসের মতো
ভিড় করে দাঁড়ায়।
ক্রমশ বুঝতে পারি,
রক্তমাংসকে মুঠির মতো ধরা যায়,
আত্মা, সে ধলভূম পাহাড়ের
বন্য হাওয়ার মতো
নিরুক্ত কায়াহীন।”
সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে প্রেমের অবস্থান শুধু রক্তমাংসের শরীরে নয়, বিরাট অসীমের মাঝে বিরাজ করে। ধলভূম পাহাড়ের মতো এবং বন্য হওয়ার মতো তার প্রকাশ, অথচ নিরুক্ত কায়াহীন। শুধুমাত্র উপলব্ধি করা যায় তার ব্যাপ্তিকে, কিন্তু অস্বীকার করা যায় না। বিখ্যাত আমেরিকান ঔপন্যাসিক,চিত্রনাট্যকার, সমাজসেবী বহু গ্রন্থের প্রণেতা নিকোলাস স্পার্কস্(১৯৬৫) বলেছেন:“Love is like the wind, you can’t see it but you can feel it.”
অর্থাৎ ভালোবাসা বাতাসের মতো, আপনি এটি দেখতে পান না, কিন্তু আপনি এটি অনুভব করতে পারেন। কানুরঞ্জন সেই ভালবাসাকেই আত্মস্থ করেছেন, ধূলি-ধূসর পার্থিব মালিন্য থেকে তাকে রক্ষা করেছেন। তাই রক্তমাংসের শরীরে তার খোঁজ করেননি। পুনরায় তার স্বরূপ বোঝাতে লিখেছেন:
“তুমি কোনো পার্থিব অবয়ব নও,
দেবী অথবা মানবী,
তুমি দুরন্ত বাতাসের সীমানা ছাড়িয়ে
নক্ষত্রলোকের স্থপতি।”
এই নক্ষত্রলোক অসীমতার বিস্ময় নিয়ে কবির আত্মবিন্যাসের স্তরগুলি উন্মোচিত করেছে একে একে। যে দুঃখ-পীড়ন, হতাশা-যন্ত্রণা, কান্না-অভিশাপ নিয়ে আমাদের বাস্তব পৃথিবীর নানা অন্তরায় জেগে উঠেছে; জীবনের ক্লেদাক্ত কুসুম ঝলসে গেছে; সেখানে আত্মমগ্ন প্রলেপে প্রেমের নির্বেদ মন্ত্র নক্ষত্রলোকের স্বপ্নচারিনীর ঠিকানায় আমাদের উত্তরণ এনে দিয়েছে। প্রেমের উপলব্ধিও আধ্যাত্মিক স্রোতের প্রাচুর্যে সমন্বিত সঙ্কটকালের আশ্রয় হয়ে উঠেছে। যেহেতু কবিতাগুলি ২০২০-এর লকডাউন পরিস্থিতিতেই লেখা, স্বাভাবিকভাবেই কবি সময়কে উপেক্ষা করতে পারেননি। আবার আত্মঅনুজ্ঞাকেও মুক্তির আলোক দিশারী করে তুলেছেন। প্রায় একচল্লিশটি কবিতায় এই সময়েরই পরিচয় আছে। নিঝুম রাস্তাঘাট, পাখির ঝাঁক, রাত্রির শূন্যতা, ফাঁকা ক্লাসরুম, স্তব্ধ কুকুর, শিশুর কান্না, রাজপথে চলা খালি-পা-এর মিছিল আর অজস্র মৃত্যু উঠে এসেছে কবিতাগুলিতে। প্রেম খুঁজতে খুঁজতে প্রকৃতির সেই অনাবিল অরণ্যলোকেই পৌঁছে গেছেন। মাধবীও কবির মাধবীলতার ঝোপ হয়ে উধাও হয়ে গেছে। কখনো জলপ্রপাতের উচ্ছ্বাসে এই প্রেমের সদ্গতি উপলব্ধি করেছেন। নুন আর ভালোবাসায় সেই সামুদ্রিক উচ্ছ্বাস কবির হৃদয়ে তরঙ্গায়িত হয়েছে। অবশেষে মানবসভ্যতা তৈরি করার জন্যই কবি মানুষকে ‘বৃক্ষপুরুষ’ হয়ে উঠতে দেখেছেন।
কানুরঞ্জনের কবিতায় স্বাভাবিক ও স্বচ্ছন্দ এক গতি লক্ষ করেছি, বিষয়কেন্দ্রিক বক্তব্যপ্রধান কবিতা। প্রতিটি কবিতায় নিজস্ব উপলব্ধির কাছেই নিজস্ব স্বাক্ষর রেখেছেন, সেখানে কবির কোনো ছলনা নেই। তাই স্থান-কাল-সময় যেমন উল্লেখ করেছেন, তেমনি নিজের অবস্থান জানাতেও ভোলেননি। অযথা ঘোরপ্যাঁচ বা গোলকধাঁধা সৃষ্টি করতেও চাননি। সবরকম পাঠকের জন্যই তাঁর কবিতা গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠবে।
নক্ষত্রের ঠিকানায়: কানুরঞ্জন চট্টোপাধ্যায়, বার্ণিক প্রকাশন, কৈয়ড়, পূর্ব বর্ধমান-৭১৩৪২৩,প্রচ্ছদ :নচিকেতা মাহাতো, মূল্য ১০০ টাকা।

এই লেখাটির শিরোনামে “কানুরঞ্জন” নামের বানানটি দয়া করে সংশোধন করে দিন। মাঝখানে শুধু একটা ‘র’ দিতে হবে।