https://www.facebook.com/groups/sahityapatrika/posts/1067356803921560/
জীবনের বৈতরণীতে
কবিতা চক্রবর্ত্তী
হটাৎ করেই আজ সকাল থেকে নিখোঁজ হলেন রমাদেবী।মধ্যবয়সী রমাদেবীর তিন সন্তান স্বামী আর বৃদ্ধ শ্বশুর কে নিয়ে সংসার।ছেলেরা প্রতিষ্ঠিত।স্বামীও উচ্চপদে চাকরি করেন।সদ্য মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন।শান্তশিষ্ট নম্র ভদ্র মিষ্টভাষী পতিব্রতা হিসাবে তিনি পাড়া প্রতিবেশী আত্মীয় স্বজন সবার কাছেই খুব প্রিয়।অনেক ছোটো বয়েসে বিয়ে হওয়ার জন্য শশুর মশাই ওনাকে একদম নিজের মেয়ে মনে করেন।শাশুড়ি মা অনেক বছর আগে ,তার ওপর সংসারের ভার দিয়ে গত হয়েছেন।
প্রত্যেকদিন ভোরে উঠে ফুল তোলা ওনার অভ্যাস।তারপর সবাই একসাথে ডাইনিং টেবিলে বসে চা খাওয়া হয়। বৃদ্ধ শশুরমশাই এর জন্য গরম জল, চা উনি ওনার ঘরেই দিয়ে আসেন।আজ সবাই ঘুম থেকে উঠে রমাদেবীকে না দেখে খুঁজতে শুরু করলো।ছেলেরা, স্বামী প্রথমে আশেপাশে খুঁজলেন ।কোথাও নেই।প্রত্যেক আত্মীয়র বাড়িতে ফোন করা হলো ।কিন্তু কোথাও পাওয়া গেলনা।এত বয়েস পর্যন্ত যে মানুষটা কোনোদিন একা বাড়ির বাইরে যাননি,তিনি গেলেন কোথায়?বেলা বাড়লে পুলিশে খবর দেওয়া হলো।
মেয়ে জামাই সবাই আসলো।কিন্তু রমাদেবীকে কোথাও পাওয়া গেলনা।
পরদিন সকালবেলায় বাড়ির দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকলেন রমা দেবী। ভাবলেশহীন মুখ।যেনো কিছু হয়নি।প্রত্যেকে জিজ্ঞাসা করছে ,উনি কোথায় ছিলেন এই একদিন।কিন্তু উনি কোনো কথা বলছেন না।বৃদ্ধ মানুষটা কেঁদে ফেললেন।বললেন তুমি কোথায় চলে গিয়েছিলে মা?উনি খালি বললেন আমি কিছু মনে করতে পারছিনা।পুলিশ থেকে আত্মীয় স্বজন প্রত্যেক কেই উনি উত্তর দিলেন ওনার কিছু মনে নেই।ডাক্তার ওনাকে আর কিছু জিজ্ঞাসা করতে বারণ করে দিলেন।অনেক রকম শারিরীক সমস্যায় যেহেতু ভোগেন। আস্তে আস্তে সব কিছু স্বাভাবিক হতে লাগলো।ব্যাপার টা সবাই প্রায় ভুলে গেলো।তবে রমা দেবী a ধীরে ধীরে নিজেকে কেমন যেনো গুটিয়ে নিতে লাগলেন।
কয়েক বছর পর,রাতে হটাৎ বুকে প্রচন্ড ব্যাথা শুরু হলো রমাদেবীর।তাড়াতাড়ি ডাক্তারকে খবর দেওয়া হলো।হাসপাতালে ভর্তি করা হলো।ডাক্তার খুব একটা আশা দিতে পারলেননা।
ইশারাতে একবার উনি ওনার স্বামীর সাথে দেখা করতে চাইলেন।ডাক্তার অনুমতি দিলেন।কিন্তু কোনোরকম উত্তেজনা যাতে না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে বললেন।চোখের জল মুছে ,কেবিনে ঢুকলেন ওনার স্বামী।দুজন দুজনের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন।দুজনের চোখের জল বাঁধ মানছিল না।রমাদেবীর হাত দুটো ধরে ওনার স্বামী একটা কথাই বললেন,আমাকে ছেড়ে যেওনা।সেই মুহূর্ত টা একটা অন্যরকম আবহাওয়ার সৃষ্টি করলো সারা ঘরে। দুটো হাত যেনো সেই প্রথম দিনের মতো ধরা একসাথে।
খুব ধীরে ধীরে রমাদেবী বললেন,তোমাকে না বলা আমার কোনো কথা নেই।এই জীবনে তুমিই আমার সব।কিন্তু কিছু কথা আমি কাউকে বলতে পারিনি।আমার আলমারিতে কাপড়ের ভাঁজে তোমার জন্য একটা চিঠি আছে।আমি যখন থাকবো না, তুমি সেই চিঠি টা খুলে পোড়ো।আমাকে ভুল বুঝনা।আমি সারাজীবন খালি তোমারই আছি।
এর কিছু পরেই রমাদেবী ডাক্তারদের সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থ করে,ইহলোক ত্যাগ করেন।চোখের জলে স্বামী সন্তান ওনার সমস্ত পারলৌকিক কাজ শেষ করলেন।
কিছুদিন পর হটাৎ সেই চিঠির কথা মনে পড়ায় ,কাপড়ের ভাঁজে একটা চিঠি পেলেন ওনার স্বামী।তাতে লেখা….
প্রিয়তম,
বিয়ের পর থেকে এতগুলো বছর আমি শুধু তোমাকেই আমার সব মেনে এসেছি।কোনোদিন তোমার কথার অবাধ্য হইনি।তোমাকে ছাড়া আমার পৃথিবী অন্ধকার।আমার পৃথিবীতে এই সংসার সন্তান আর তুমি ছাড়া আর কিচ্ছু নেই।কারণ তুমি কোনোদিন মনে করোনি,একজন মহিলার এর বাইরেও অনেক কিছু চাওয়ার থাকতে পারে।কোনোদিন তোমাকে ছাড়া আমি বাড়ির বাইরে পা দিইনি।কারণ তুমি পছন্দ করতে না।কোনোদিন কোথাও গিয়ে একরাত ও থাকতে দাওনি।তাহলে তোমার বাবাকে কে দেখবে।
আমি সব হাসিমুখে মেনে নিয়েছি।কারণ আমার মা মাসীকে ও এরকমই দেখেছি।মেয়েদের জীবন বোধ হয় এরকম ই হতে হয়।
তোমার মনে আছে কিনা জানিনা,বিয়ের পর তোমাকে আমি জানিয়েছিলাম ,আমি একজন কে ভালবাসতাম বিয়ের আগে।ওই ছেলেবেলার ভালোবাসা যেমন হয় আর কি।আবেগ নির্ভর।তুমি শুনে হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলে।বলেছিলে আমি সব ভুলিয়ে দেবো।ভুলে গেছিলাম জানো।তাকে দেওয়া কথা,সারাজীবন একসাথে থাকবো……সব সব ভুলে গেছিলাম তোমার ভালোবাসায়।
কিন্তু ভগবান যে অন্যরকম ভেবেছিলেন।কত কত বছর পর তার সাথে আবার আমার যোগাযোগ হলো।আমার বোনের বিয়েতে গিয়ে। এ কি দেখলাম?না দেখলেই বোধ হয় ভালো হতো।সারাদিন বই এর মধ্যে ডুবে থাকা আত্মভোলা এক মানুষ।পেনশন এর টাকায় চলে।বিয়ে থা কিচ্ছু করেন নি।সেটাও নাকি আমার জন্য।গেলাম তার বাড়ি।আমার বড়ো একটা ছবি টাঙানো।ভীষণ অগোছালো ঘর।সারা ঘরে বই ছড়ানো।বললাম বিয়ে করনি কেনো।বললো ওই তো ছবিতে আমার বউ।আমি কথা রেখেছি সারাজীবন একসাথে আছি।
শুনে ভীষণ ভীষন বিকেক দংশন হলো। ছুটে বেরিয়ে গেলাম ।
বাড়ি ফিরে এসও শান্তি পাচ্ছিলাম না।তাই ঠিক করলাম,কিছু একটা করে এই মানসিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাবার।
সেদিন আমি সকালে ওর কাছে গেছিলাম,যেদিন তোমরা আমাকে খুঁজে পেলেন।আমার জীবনের একটা দিন আমি তাকে দিলাম।সারাজীবন নাহোক,একটা দিন তাকে আমি দিয়েছি।বলো,আমি পারিনা,আমার সারাজীবনের থেকে একটা মাত্র দিন নিজের জন্য নিতে?একটাই দিন।হয়তো ভীষণ ঘৃনা হবে আমার প্রতি তোমার।কিন্তু বিশ্বাস করো,আমি কোনো অন্যায় করিনি ।আমি এখনও শুধুই তোমার।তুমি আমার অভ্যাস,তুমি আমার ভালোবাসা,তুমি আমার পৃথিবী,তুমিই আমার সব।তোমাকেই আমি ভালোবাসি।আর কাউকেই না।পারলে ক্ষমা করো।
শুধুই তোমার
রমা।