Joy Narayan Sarkar

 

নিউক্লিয়ার // জয়নারায়ণ সরকার

 

নামে কী যায় আসে! তাই ও নিয়ে আর ভাবতে চায় না হরিপদ। অবশ্য এখন ওর নামের শেষ দুটো অক্ষর প্রাগৈতিহাসিক জন্তুদের মতো লুপ্ত হয়ে গেছে। শুধু হরি নামেই খ্যাত। প্রথম প্রথম বন্ধুরা ডাকতে শুরু করে তারপর ওই নামেই সবাই ডাকে। তবে বউয়ের দেওয়া আদরের নামটা মনঃপূত না হলেও আদরের সুরে ডাকলে গলে জল হয়ে যায় হরিপদ।

ফুলশয্যার রাতে বিছানায় বসে বউ আদো আদো গলায় বলেছিল, তোমায় আমি কী নামে ডাকব?

হরিপদ লজ্জা মাখানো গলায় বলেছিল, তোমার যা ইচ্ছে।

বউ এবার তড়াক করে উঠে বিছানা থেকে নেমে পড়ে। তা দেখে হরিপদ ভ্যাবাচাকা খেয়ে যায়। ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে করতে বউ বলে, আসলে নতুন কিছু ভাবনা মনে এলেই আমাকে পায়চারি করতে হয়। তা না হলে মাথা থেকে কিছু বেরোবে না। তাছাড়া তোমায় অত বড় নামে ডাকতে পারব না। দ্যাখো না, আজকাল সবাই কেমন মিষ্টি মিষ্টি নামে ডাকে!

ঘন ঘন পায়চারি করেই চলে। হরিপদ হাঁ হয়ে তাকিয়ে থাকে বউয়ের দিকে।

কতক্ষণ যে এভাবে কেটে গিয়েছে তা আর খেয়াল করেনি হরিপদ। সারাদিনের ধকলের ক্লান্তিতে চোখদুটো বুঁজে আসছে। সে জোর করে তাকিয়ে থাকার চেষ্টা করে। এদিকে রাত প্রায় শেষের দিকে। ফুলশয্যাটাই মাটি হয়ে গেল, মনে মনে ভাবে হরিপদ। নাম নিয়ে এত জলঘোলা হবে জানা থাকলে আগেভাগে একটা নাম ঠিক করে রাত সে। বউ তখনও জোরে জোরে পায়চারি করেই চলেছে। জানলার ফাঁক দিয়ে ভোরের আলো উঁকি দিচ্ছে। হরিপদ বসে বসে ঢুলেই যাচ্ছিল হঠাৎ বউয়ের চিৎকারে চমকে তাকিয়ে দেখে বউ দু-হাত ওপরে তুলে বলছে, ইউরেকা! ইউরেকা! আমি তোমাকে ডিয়ার বলেই ডাকব।

হরিপদ তন্দ্রা জড়ানো গলায় বলে, একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেল না!

বউ আরও উৎসাহিত হয়ে বলে, কেন বাড়াবাড়ি হবে? ওই নামের জন্যই ভালবাসার বন্ধন আরও জোরালো হয়ে উঠবে।

ওদিকে দরজার কড়া নাড়ার আওয়াজ, সেইসঙ্গে মায়ের গলা পায়। মা বলে, ও বউমা তাড়াতাড়ি বাইরে এসো। বাড়ি ভর্তি আত্মীয়স্বজন!

হরিপদর কানে আর কিছু ঢোকে না। সে চাদর মুড়ি দিয়ে টানটান হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।

ঘুম ভাঙতে বেশ বেলা হয়ে যায় হরিপদর। আজ তো কোনও তাড়া নেই। অফিস জয়েন করতে ঢের দেরি। হানিমুন সেরে তারপর।

দুপুরে খাওয়ার সময় ঘরের মেঝেতে পাতা আসনে সবার সাথে হরিপদও বসে পড়ে। আজ নতুন বউ পরিবেশন করছে। হরিপদকে ভাত দিতে দিতে বউ বলে, এ কী ডিয়ার, তুমি বসে পড়লে! পরে না হয় আমরা একসঙ্গে বসতাম!

পাশেই শাশুড়ি মা দাঁড়িয়েছিলেন। বউমাকে ওই নামে ডাকতে দেখে বলেন, কী নামে ডাকছো হরিকে?

বউমা সাথে সাথে বলে, কেন ডিয়ার! আসলে ডিয়ার মানে…

শাশুড়ি ধমক দিয়ে বলে, বাঘ-সিংহ… বলে ডাকলেও বুঝতাম।

বউমা ফস করে বলে, আসলে নামটা তো শুধুমাত্র আমার!

শাশুড়ি খানিকটা মুখ ঝামটা দিয়ে বলে, তা হোক তোমার, তাও তো একটা ছিরি থাকে।

বউমা বলে, ও আপনি বুঝবেন না মা। এতে ভালবাসা…

শাশুড়ি খানিকটা গলা তুলে বলে, ইস, কত ভালবাসা… তা আমার জানা আছে। আমরা তো ওগো, কীগো করেই জীবন শেষ করে ফেললাম। কখনো তো মনে হয়নি ভালবাসায় ঘাটতি পড়েছে।

পাশ থেকে শ্বশুরমশাই গলা খাঁকারি দিয়ে বলেন, আঃ, তোমরা কী শুরু করলে! শান্তি করে খেতে দেবে তো!

মুহূর্তের মধ্যে ঘরটা নিস্তব্ধ হয়ে যায়। আত্মীয়স্বজনরা মুখ চাওয়াচায়ি করতে থাকে। হরিপদ একবার চারদিক দেখে নিয়ে মাথা নিচু করে খেতে থাকে।

তারপর থেকে হরিপদ কেমন গুটিয়ে থাকে। বউ যদি আবার সবার সামনে ওই নামে ডেকে ফেলে।

ইতিমধ্যে পাড়ার বন্ধুরা ও অফিসের কলিগরা সবাই ওই নামটা জেনে যাওয়ায় বিপত্তি বেড়েছে বই তো কমেনি। সামনে কেউ কিছু না বললেও পেছনে যে বউয়ের নামকরণ নিয়ে হাসি-তামাশা হয় তা সে টের পায়।তবুও বউয়ের মুখে ওই ডাক শুনলে কেমন যেন রোমিও রোমিও মনে হয়। অথচ প্রাণ খুলে যে একটু ভালবাসবে তার আর উপায় নেই। এমনকী কাজের মেয়েটাও একদিন মাকে বলেছিল, বউদিমণি দাদাবাবুকে কী নামে ডাকে গো?

মা মুখ ঝামটা দিয়ে বলেছিল, তোর কাজ তুই কর।

ইদানিং বাড়ির পরিবেশ একেবারেই পাল্টে গেছে। এই পরিস্থিতির জন্য কি ওকেই দায়ী করছে সবাই? ইদানিং ভালবাসার নামটাও অসহ্য লাগছে তার। কখন যে সবার থেকে আলাদা হয়ে পড়েছে বুঝতে পারেনি হরিপদ। ক্রমশ দূরে, বহু দূরে সরে সরে যায় সংসারে জড়িয়ে থাকা স্নেহ-আদর। ওই নামকরণেই সুপ্ত থাকে নিউক্লিয়ার পরিবারের জন্ম-ইতিহাস।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *