আশ্রয় // জয়নারায়ণ সরকার
ট্রেনটা প্রচণ্ড গতিতে ছুটছে। বাইরের কিছুই দেখা যাচ্ছে না। একটার পর একটা স্টেশন পার হয়ে চলে যাচ্ছে মুহূর্তের মধ্যে। প্রথম যেদিন অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার মেইলে এসেছিল, সেদিনই মুম্বাইয়ের ট্রেনের টিকিট কেটে দিয়েছিল বাবা। বাবার মুখটা গম্ভীর দেখাচ্ছিল। মুম্বাই শহরে কোনো আত্মীয়স্বজন বা চেনাজানা কেউ আছে কিনা, তাই নিয়েই বাবা ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। জরুরিকালীন তৎপরতায় আত্মীয়দের ফোন করে করে খবর নিচ্ছিলেন। একমাত্র পিসতুতো ভাই সন্তুর এক বন্ধু চাকরিসূত্রে কয়েক বছর আছে মুম্বাই। বাবা বেশ চিন্তায় পড়লেন। তাহলে উপায়! বাবার এই দুশ্চিন্তা দেখে নির্মলা কোম্পানির এইচ আর-কে ফোন করে থাকার জায়গার কথা বলে। তখন উনি জানান, কোম্পানির গেস্ট হাউসে ছ’মাস পর্যন্ত ফ্রি-তে থাকা যাবে। তারপর রেন্ট অ্যাড হবে। একথা শোনার পর বাবা খানিকটা নিশ্চিত হয়। যাক ওই কয়েক দিনের মধ্যে হয় বাইরে ঘর ভাড়া ঠিক করতে পারবে। সেটা সামর্থ্যের বাইরে হলে পেয়িং গেস্ট হিসেবে অন্তত ঠিক করতে পারবে।
***
ট্রেনটা বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। ওঠার পর পরেই যাত্রাপথের খাবারের অর্ডার নিয়ে গেছে। মাঝে মাঝে চা ও খাবার দিয়ে যাচ্ছে। যদিও টিকিটে সবকিছুর দাম ধরা ছিল। ট্রেনে তুলতে এসে বাবা ও মা বেশ নিশ্চন্ত হন। একটা বাঙালি পরিবার পড়েছিল ওর কুপে।
ঘড়ি ধরে ট্রেন পৌঁছয়। নির্মলা লাগেজ নামিয়ে নিজে টানতে টানতে বাইরে আসে। ট্যাক্সি স্ট্যান্ডের লাইনে দাঁড়ায়। একটা গুমটি ঘরের ভিতরে বসে থাকা লোকটিকে অফিসের ঠিকানা বলতেই একটা কুপন ধরিয়ে দেয়। তাতে গাড়ির নাম্বার ও ভাড়ার টাকা লেখা। নির্মলা টাকা মিটিয়ে পাশের লেনে আসতেই দেখে গাড়ি দাঁড়িয়ে।
দিনের আলোয় কেমন সাদামাটা লাগে মুম্বাই শহরটাকে। রাস্তায় গাড়ি ও লোকজনের সংখ্যাও কম। কিছুটা যাওয়ার পরেই মোবাইল বেজে ওঠে, বাবা এক নিশ্বাসে বলতে থাকেন, তুই এখন কোথায়, আর কত সময় লাগবে অফিসে পৌঁছতে? ওখানে গিয়েই ফোন করে দিবি। নির্মলা শুধু হ্যাঁ বলে। বাবা ফোনটা কেটে দেয়। সে ভাবে বাবা এখনো তাকে বাচ্চা ভাবে।
অফিসে পৌঁছে যাবতীয় ফর্মালিটি শেষ করে গেস্ট হাউস যেতে দুপুর গড়িয়ে যায়। গেস্ট হাউসের ঘরে পৌঁছেই খাবারের অর্ডার দিয়ে স্নানে ঢুকে যায়। খাওয়া সেরে বিছানায় শুয়ে পড়ে। মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখে কুড়িটা মিসড কল। সবকটিই বাবার। অফিসে সায়লেন্ট করে দেওয়ার পর খুলতে ভুলে গেছে। সাথে সাথে বাবাকে ফোন করে। বলে, আমি পৌঁছে গেছি। অফিসের কাজ সেরে এখন গেস্ট হাউসে। একটু ঘুমিয়ে নিয়ে রাতে দেখব শহরটাকে।
বাবা শুধু গম্ভীর হয়ে বলে, হুঁ।
***
পরের দিনেই অফিসে জয়েন করে নির্মলা। ঝা চকচকে অফিসের পরিবেশ তাকে উল্লসিত করে। গভীর রাতে ছুটি হলে অফিসের গাড়িতে ফেরে। সকালে ঘুম ভাঙতে বেশ বেলা হয়। মোবাইল তুলে দেখে বাবার ফোন মিসড কল হয়ে রয়েছে। বাবাকে ফোন করে। শুধু বলে, চিন্তা কোরো না। সব ঠিক আছে। আজ অফিস ছুটি। তাই উঠতে দেরি হল।
অলসভাবে এগোয় সময়। নির্মলার মনে পড়ে সন্তুর কথা। ও বলেছিল, ওখানে গিয়ে ফোন করিস, শ্যামলদার ফোন নম্বর দিয়ে দেব। এই শ্যামলদাকে প্রথম দেখেছিল সন্তুদের বাড়িতে কোনো অনুষ্ঠানে। প্রথম দেখাতেই বুকের ভেতর কেমন দামামা বেজেছিল। দুজনের চোখে চোখ পড়লে শ্যামলদা অর্থপূর্ণ হাসি হেসেছিল। তারপরেই নাকি এই শহরে চলে আসে। অগত্যা সন্তুকে ফোন করে শ্যামলদার ফোন নাম্বার নেয়। তারপর ইতস্তত করে ফোন করতে। মনকে শক্ত করে ফোনে ডায়াল করে। রিং হতেই ওপারে হ্যালো বলে। নির্মলার সারা গা দিয়ে যেন আগুনের হলকা বেরোতে থাকে। ঢোক গিলে বলে, আমি নির্মলা, সন্তুর দিদি। গতকাল এই শহরে এসেছি চাকরির জন্য।
ওপার থেকে হো হো হাসির আওয়াজ শুনতে পায়। বলে, আমি সব সন্তুর থেকে শুনেছি। তারপর থেকে দেখা করার জন্য উতলা হয়ে আছি।
নির্মলা নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারে না। শুধু বলে, আজ আমার ছুটি। তাই…
কথা শেষ হয় না। শ্যামলদা বলে, ঠিক আছে এক্ষুণি বেরিয়ে এসো। আমি যাচ্ছি তোমার গেস্ট হাউসের সামনে।
নির্মলা স্নান সেরে চটপট তৈরি হয়ে বেড়িয়ে দেখে গেটের পাশে দাঁড়িয়ে আছে শ্যামলদা। দুজনে একসাথে একটা রেস্টুরেন্টে ঢোকে। সব কথা হয়। শ্যামলদা দায়িত্ব নেয় তার কাছাকাছি ঘর ভাড়া ঠিক করে দেওয়ার।
***
শ্যামলদা থাকে ক্যান্ডিভ্যালি। কয়েক মাস পরে শ্যামলদার পাশের টাওয়ারে সাততলায় ভাড়া নিয়ে থাকে নির্মলা। ওখানে থাকার জন্য শ্যামলদা সব করেছিল। শুধু একদিন গিয়ে ফ্ল্যাটটা দেখে এসেছিল নির্মলা। ছুটির দিনগুলো শ্যামলদা সকাল থেকেই একসঙ্গে থাকে। বাড়িতে রান্না করতে দেয় না। অন-লাইনে অর্ডার করে সব আনায়। শ্যামলদাই ঠিক করে কখন কোনটা খাওয়া হবে। দুজনের ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে। এমনই বৃষ্টির দিনে দুজনে দুজনের মধ্যে হারিয়ে যায়।
একদিন শ্যামলদাকে বলে, আমরা তো একসঙ্গেই আছি। তাহলে এবার বাড়িতে বলে আমাদের বিয়েটা…
সাথে সাথে শ্যামলদা ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানিয়ে বলে, আমি বাবা-মাকে জানিয়ে রেখেছি। তোমার বাবা-মা এ বিয়ে মানবেন তো!
নির্মলা একটা অর্থপূর্ণ হাসি হাসে।
***
দুই পরিবারে কথা হয়। তারপর কয়েক হাজার মাইল দূরের শহরে বিয়ে সম্পন্ন হয়। দু’পক্ষের বাবা-মা ছাড়া আর কেউ ছিল না এ বিয়েতে। মুম্বাই ম্যারেজ কোর্টে রেজিস্ট্রেশন ও মন্দিরে মন্ত্রোচ্চারণে চার হাত এক হয়ে যায়। বিয়েপর্ব মিটে যেতেই সবাই একে একে ফিরে যায়। তবে যাওয়ার সময় বাবার মুখটা বেশ স্বস্তির দেখায়। যেন একটা ঝড়ের পর শান্ত পৃথিবী।
দুজন অফিস নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়ে। সকালে ব্রেকফাস্ট একসঙ্গে হলেও নির্মলা লাঞ্চ সারে অফিসে। আবার শ্যামল লাঞ্চ করে দুপুরের পর অফিস যায়। ফিরতে ফিরতে ভোর হয়ে যায়। সে ডিনার করে অফিসেই। তবে ছুটির দিনগুলো একসাথে থাকা।
দিনের পর দিন এভাবেই কাটতে থাকে। নির্মলার প্রমোশন হওয়ায় এখন স্যালারি বেশ মোটা অঙ্কের। প্রতি মাসের পয়লা তারিখে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ঢুকে যায়। সে সঙ্গে সঙ্গে শ্যামলের অ্যাকাউন্টে ট্রান্সফার করে দেয়। মা অবশ্য এটা শুনে বলেছিল, তোর কাছে কিছু তো রাখতে পারিস। না হলে সব সময় ওর কাছে হাত পাততে হবে। নির্মলা কথাটাকে পাত্তা দেয় না। যাঁকে শরীর-মন সব সঁপে দিয়েছি, তার কাছে থাকা মানেই তো আমার থাকা। অবশ্য প্রথম প্রথম মা বলতেন। বাবার ধমকে মা চুপ করে যায়। বাবা বলতেন, ও যা ভাল বুঝবে তা করবে।
***
চাকরি-সংসার-ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স নিয়েই দিনগুলো কেটে যায়। মা অনেকবারই বলেছে, এবার তোরা কিছু একটা ভাব। আর দুজনে কতদিন থাকবি। নির্মলা কথাটা শ্যামলকে বললে ও যেন বিরক্ত হয়। তাই নির্মলা কিছু বলে না। ছুটির দিনে শ্বশুর-শাশুড়ির সাথে ফোনেই কথা হয়। কেউ আর আসে না। মাঝে মাঝে নির্মলার দম বন্ধ হয়ে আসে। সে তখন ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে সামনের রাস্তায় চলমান গাড়ির দিকে তাকিয়ে থাকে। শ্যামলের প্রমোশন হওয়ায় বেশি সময় থাকতে হয় অফিসে। এখন সে বাড়ি ফেরে ভোরের সূর্যের রং মেখে। এসেই ঘুমিয়ে পড়ে। নির্মলাও তৈরি হয়ে বেরিয়ে যায় অফিসে।
নির্মলার যেন কিছুই ভাল লাগে না। একদিন ঘুমিয়ে থাকা শ্যামলের কপালে একটা গভীর চুম্বন এঁকে দেয়। তারপর অপেক্ষা করতে থাকে শ্যামল উঠে তাকে জড়িয়ে ধরে বিছানায় ফেলে পাগল করে দেবে। কিন্তু শ্যামল তখনো অঘোরে ঘুমোচ্ছে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বেরিয়ে পড়ে অফিসের উদ্দেশে।
***
সেদিন ছিল রবিবার। ঘুম থেকে উঠেই শ্যামল বলে একমাস আমার কোনো ছুটি নেই। স্যালারি বাড়ার সাথে সাথে দায়িত্বও বেড়েছে। নির্মলা অবাক হয়ে যায়। সপ্তাহে একদিন কথা হয় এবার থেকে সেটাও হবে না। নিজেকে ভীষণ একা লাগে তার। কতদিন এভাবে চলবে তা সে নিজেই জানে না। সেই আশঙ্কা থেকে শ্যামলকে বলে, সপ্তাহে অন্তত একটা দিন ছুটি তো দরকার। না হলে শরীর খারাপ হবে।
শ্যামল এবার মুচকি হেসে বলে, হোক শরীরখারাপ। মোটা টাকা ব্যাঙ্কে ঢুকবে। তাতে তোমার ভবিষ্যতে কাজে আসবে।
বলেই ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে যায় শ্যামল। দরজা অবধি যায় নির্মলা। একদৃষ্টে ওর চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। হঠাৎ সম্বিৎ ফেরে রিংটোন শুনে। সে দৌড়ে বেডরুমে আসে। দেখে মায়ের ফোন। নিজেকে সামলে বলে, বলো মা।
মা এবার খানিকটা রাগতস্বরে বলে, কোথায় থাকিস। তিনবার করার পর ধরলি। আজ তোর বাবার জন্মদিন। শ্যামলকে বলিস যেন বাবার সাথে একটু কথা বলে। ও তো এখন ফোন করা ছেড়েই দিয়েছে।
নির্মলা খানিকটা উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে, ওমা, আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম। তুমি গিয়ে বাবার নাম লিখিয়ে একটা কেক কিনে আনো। ওই কেকের দাম যা হবে আমাকে বলবে, আমি দেব ওটা।
ওপাশ থেকে মা বলে, দোকান থেকে কেক আনব কেন, বাড়িতেই বানাবো, তুই আজকাল সব ভুলে যাচ্ছিস। তোর জন্মদিনে আমিই তো কেক বানাতাম। তোর বন্ধুরা খেয়ে কত প্রশংসা করত।
নির্মলা বলে, বাবাকে একটা পারফিউম কিনে দিও। আমাকে বলবে কত টাকা, পাঠিয়ে দেব।
মা এবার গম্ভীর হয়ে বলে, তোর বাবার এ বয়েসে পারফিউম কী মাখবে। ওসব থাক যখন তুই বাড়ি আসবি তখন কিছু নিয়ে আসিস। তাতে বাবা বেশি খুশি হবে।
একথা শোনার পর নির্মলা বুঝতে পারে। টাকাটা শ্যামলের কাছ থেকে চাইতে হবে ভেবে মা এড়িয়ে গেলেন।
***
ফ্ল্যাটে একা একা থাকতে মনে নানা চিন্তার ভিড় করে। বাড়িতে যাওয়া হয় না বহু বছর। কত ঘটনা ঘটে গেছে কিন্তু সব ফোনেই খবর পাওয়া।
শ্যামল-নির্মলার রোজ দেখা হয় কিন্তু কথা হয় না। নির্মলা অফিস যাওয়ার সময় জরুরি কাজগুলো ডায়েরিতে লিখে টেবিলে রেখে যায়। শ্যামলও একইভাবে সবকিছু লিখে রাখে। সকালে কাজের লোক এসে কাজ করে যায়। তার সাথেই নির্মলা কিছুক্ষণ কথা বলে কাটায়। সে চলে যেতেই তাড়াতাড়ি বাথরুমে ঢোকে। স্নান সেরে চটপট রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়ে। কোনো কোনো দিন অফিসের গাড়ি এসে অপেক্ষা করে ওর জন্য। প্রতিদিনই নিঃসঙ্গতা ঘিরে থাকে তাকে। ব্যালকনির দরজা খুলে দিলে দখিনা বাতাস ঘরময় খেলে বেড়ায়। যেন ওই বাতাসের সঙ্গে সে কথা বলে, খেলে। ওদের আশ্রয়েই বাঁচার স্বপ্ন দেখে নির্মলা।