খড়কুটো // জয়নারায়ণ সরকার
গভীর রাতে ঘুম ভেঙে যায় সুব্রতর। জানালার পর্দা সরিয়ে বাইরে তাকাতে মুষলধারায় বৃষ্টি পড়তে দেখে চটপট বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ে। ড্রয়িংরুম পেরিয়ে আলোছায়ার মধ্যে দিয়ে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ায়। সামনের বড় রাস্তায় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা হ্যালোজেন লাইটের দিকে তাকায়। লাইটটাকে ঘিরে অবিরাম জলের ধারা চোখে পড়ে। শুনশান রাস্তা দিয়ে দ্রুতগতিতে জলের ধারার মধ্যে দিয়ে কত খড়কুটো ভেসে যাচ্ছে। দেখতে দেখতে মনটা উতলা হয়ে ওঠে সুব্রতর।
পাশের চেয়ারে কেউ এসে বসল। সুব্রত টের পেলেও তাকায় না সেদিকে। হঠাৎ শান্তার গলা শুনে ঘুরে তাকায়। শান্তা ঘুম জড়ানো গলায় বলে, এত রাতে এখানে বসে আছো কেন? ঘুমিয়ে পড়েছিলে তো, আবার উঠলে কেন?
সুব্রত তখনও মগ্ন, না তাকিয়ে বলে, দেখ, দেখ শান্তা, জলের সাথে কতকিছু ভেসে যাচ্ছে।
শান্তা খানিকটা বিরক্ত হয়ে বলে, এই রাতদুপুরে ঘুমকে মাটি করে ন্যাকামো হচ্ছে!
বলেই শান্তা শোওয়ার ঘরের দিকে চলে যায়। সুব্রত রাস্তার জলের দিকে তাকিয়ে ভাবতে থাকে, বড়লোক বাবার একমাত্র মেয়ে। ভেসে যাওয়া কি বুঝবে শান্তা! সেও এবার ব্যালকনি থেকে ঘরে ঢুকে দ্যাখে শান্তা ঘুমিয়ে পড়েছে। সে শুয়ে পড়লেও ঘুম আসে না কিছুতেই। এপাশ আর ওপাশ করেই চলেছে। চোখের সামনে ভেসে যাওয়া খড়কুটোগুলো দেখতে পায় সে।
সকালে ঘুম থেকে উঠেই সোজা ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ায় সুব্রত। বৃষ্টি এখন আর নেই। সারা আকাশ মেঘে ঢাকা। রাস্তায় জলের স্রোতও উধাও। আজ তো অফিস যেতে হবে। তাই সে আর দেরি না করে চটপট বাথরুমে ঢুকে পড়ে।
***
সুব্রত যখন ক্লাস সিক্সে পড়ে তখন বাবাকে হারাতে হয়। এক এক সময় পেরে উঠতেন না মা। অভাবের সংসার হলেও পড়াশোনায় ব্যাঘাত ঘটতে দেননি উনি। বড় ছেলেকে কোনো কাজে ঢুকিয়ে দিতে বলতো আত্মীয়রা। মা অবশ্য সেসব কথায় কান দেননি। অন্যদিকে স্কুলের কয়েকজন মাস্টারমশাইও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন।
যেদিন চাকরি পাওয়ার খবর মাকে দিয়েছিল, সেদিন ওকে জড়িয়ে ধরে হাউ হাউ করে কেঁদে উঠেছিল মা। সংসারে সামান্য স্বচ্ছলতা, বোনের বিয়ে, ভাইয়ের ব্যবসার জন্য সাহায্য— সবই করতে হয়েছিল সুব্রতকে। মায়ের বয়সের সাথে সাথে অসুখও যেন ঘিরে ধরতে থাকে। সে প্রতি মাসের ডাক্তার, ওষুধের খরচে কোনো কার্পণ্য করেনি।
***
মায়ের আবদারেই বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয় তাকে। মেজ মাসি এই সম্বন্ধটা এনেছিল। ওরা উচ্চবিত্ত বলে প্রথমে আপত্তি তুলেছিল সুব্রত। মেজ মাসি শেষে রাজি করান মাকে। মায়ের কথা অমান্য করতে পারেনি সে। বিয়ের কয়েক মাস পরেই সুব্রত বুঝতে পারে, জীবনে সব থেকে বড় ভুল করে ফেলেছে।
সংসারে অভাব আষ্টেপৃষ্ঠে ছিল বলে মায়ের কাছে কোনো জিনিসই ফেলে দেওয়ার নয়। সবকিছু আঁকড়ে বাঁচতে ভালবাসেন। অন্যদিকে শান্তার চোখে সেসব আবর্জনা। সে মাঝেমধ্যে দু–এক কথা শুনিয়েও দেয় মাকে। সুব্রত সব শুনেও নীরব থাকে। কোনো কিছু নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে চায় না। খানিকটা এড়িয়েই চলে সংসারের নানা জটিলতা।সংসারে নানা ঘটনা ঘটতে থাকলেও সে নির্বাক, নিশ্চুপ।
শান্তা আর এ বাড়িতে থাকতে চায় না। সে নোংরা, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ মানিয়ে নিতে পারছে না। ছোট ভাইয়ের ব্যবসাও তখনও সেভাবে দাঁড়ায়নি। সংসারের বোঝা একা টেনে চলেছে সুব্রত। শান্তার সেখানেও আপত্তি। ইদানিং একটু বেশি রাতে শান্তার উঁচু গলার নানা ক্ষোভের কথা শুনতে হয় সুব্রতকে। সে যথারীতি নীরব হয়েই থাকে। পাশের ঘর থেকে সবকিছুই টের পায় মা। একদিন মা বলেন, বউমার যখন ইচ্ছে আলাদা থাকার, তখন তোরা অন্য কোথাও গিয়ে থাক। তোরা ভাল থাকলে আমার ভাল লাগবে।
কথাগুলো বলতে বলতে মায়ের দুচোখের কোণ জলে ভরে উঠেছিল। তাড়াতাড়ি আঁচল দিয়ে আড়াল করলেও সুব্রতর চোখ এড়ায়নি। মুখ ফুটে কিছু বলতে পারেনি সে।
***
শান্তার কিটিপার্টির বান্ধবীদের এখন আর তেমন দেখতে পায় না। সে যেন ওসব ব্যাপারে উৎসাহ হারিয়েছে। ছুটির দিনগুলোতে সুব্রত একবার মায়ের সাথে দেখা করে আসে। একদিন অফিস থেকে ফিরে দ্যাখে শ্বশুর–শাশুড়ি এসেছেন। মুখে কিছু না বললেও একটা কৌতূহল মনের মধ্যে উঁকি দিতে থাকে। শান্তা ওকে পাশের ঘরে ডেকে নিয়ে বলে, বাবার ব্যবসার অবস্থা খারাপ। যতদিন না সবকিছু ঠিক হয়, ততদিন ওঁনারা এখানে থাকবেন।
সুব্রত অবাক চোখে তাকায় শান্তার দিকে। এ রকম সিদ্ধান্ত নেওয়া হল কিন্তু সে জানতেই পারল না। আপত্তি থাকা সত্ত্বেও আস্তে আস্তে সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়ে।
রাতে আবার মুষলধারায় বৃষ্টির সঙ্গে ক্রমাগত বাজ পড়তে থাকে। আজ আর ব্যালকনিতে যায় না সুব্রত। তারও ইচ্ছে করে স্বার্থের সংসারকে ভেঙে খান খান করে দিতে। প্রতিবাদের ভাষাটাও ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে খড়কুটোর মতোই ভেসে গেছে তার জীবন থেকে। গলার মধ্যে একটা কান্না দলা পাকিয়ে ওঠে।