চাবির গোছা // জয়নারায়ণ সরকার
সকাল থেকেই মনের মধ্যে টানাপোড়েন চলছে। রাতে ভাল ঘুমও হয়নি। নিজের ওপরে বিরক্ত লাগে সুমনের। এ রকম তো হওয়ার কথা ছিল না। সদ্য বিবাহিত জীবন কত সুখের হয়! কিন্তু সেখানেও বিধি বাম! আজই ধীরাগমনে শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার কথা থাকলেও মায়ের শরীর খারাপ হওয়াতে আর যাওয়া হয়নি। এদিকে নতুন বউ মুখে কিছু না বললেও, হাবেভাবে বুঝিয়ে দিচ্ছে যে তার এ রকম পরিস্থিতি ভাল লাগছে না। সুমন কী ভেবে ডাক্তারবাবুকে ফোন করে জানতে চায়, মাকে একা রাখা যাবে কি না? ও প্রান্ত থেকে মুখে কিছু না বললেও একটা দীর্ঘশ্বাস পড়েছিল। বুঝে গিয়ে ফোনটা কেটে দেয় সুমন। বাড়িতে কেমন একটা অদ্ভুত পরিবেশ তৈরি হয়েছে। ছোটবেলা থেকে এ রকম পরিস্থিতিতে কখনো পড়তে হয়নি। এদিকে অফিস থেকে পনেরো দিনের ছুটি নেওয়া হয়েছে। হানিমুন সেরে একেবারে জয়েন করার কথা।
সন্ধেবেলায় মায়ের শরীর একটু ভালর দিকে। সুমনকে ডেকে মা বললেন, এক্ষুনি বেরিয়ে পড়। অনুষ্ঠান সেরে রাতেই ফিরে আসিস। আমি এখন বেশ ভাল আছি।
সুমন আর কথা বাড়ায় না। সে মোবাইল দিয়ে উবের বুক করে চিৎকার করে বউকে বলে, কুইক, রেডি হয়ে নাও। এখনই বেরোতে হবে। বলতে বলতে সে জামা-প্যান্ট বদলে রেডি হয়ে নেয়। অন্যদিকে বউমাও রেডি হয়ে লিফটের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। সুমন আর বউমা বাবা-মায়ের সাথে দেখা করে বেরিয়ে আসে। তখন সন্ধেটা ক্রমশ গাঢ় হচ্ছে।
***
ওরা বেরিয়ে যাওয়ার পর আরতি নিজে উঠে এক গ্লাস জল খায়। আজ অনেক কথা মনের মধ্যে মোচড় দিতে থাকে। এদিকে সুমনের বাবাকে নিয়ে আর পারা যায় না। চিরকালই সে সংসারের প্রতি উন্নাসিক। একমাত্র টাকা-পয়সার ক্ষেত্রে সজাগ দৃষ্টি। আরতিকেই প্রথম থেকে সংসারের দায়িত্ব-কর্তব্য নিজের হাতে তুলে নিতে হয়। সুমনের বাবা সরকারি চাকরি করলেও অবসরে মহাজনী ব্যবসা ফেঁদে বসে। এই অঞ্চলে দোকানদার থেকে শুরু করে প্রোমোটার তার ক্লায়েন্ট। তবে কোনো ঝামেলায় পড়লে আরতি হয় মুশকিলআসান। দু-একটি ক্ষেত্রে বেশ কিছু টাকাও খোয়া গিয়েছে। রাজনৈতিক দাদাদের ধরেও উদ্ধার করতে পারেনি আরতি। কিন্তু সংসার সামলেছে নিপুণভাবে। ছেলেকে পড়িয়েছে শহরের ভাল স্কুলে। প্রাইভেট কলেজে পড়িয়ে অবশেষে চাকরি। পুরোটাই সম্ভব হয়েছে সুমনের বাবার রিটায়ার করে যা টাকা পেয়েছিল তাই দিয়ে। অবশ্য আরতি বাপের বাড়ি থেকেও কারণে-অকারণে টাকা-পয়সা নিয়ে আসত। বাবার সম্পত্তি বিক্রি করার সময়েও আরতি সমান ভাগ নেয়। যদিও ভাইয়ের দেওয়ার ইচ্ছে ছিল না। একরকম চেঁচামেচি করে মোটা টাকা আদায় করেছিল। সে টাকাও মহাজনী ব্যবসায় ঢেলেছিল। যাকে দিয়েছিল সে কয়েক মাস বাদে এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ায় টাকা আর পায়নি।
শ্বশুরের ভেঙে পড়া এজমালি বাড়ি প্রোমোটিং হওয়ায় তিন কামরার ফ্ল্যাট পেয়েছে আরতি। সুমন নিজের মতো করে সাজিয়েও নিয়েছে। ওপেন কিচেন থেকে শুরু করে সমস্ত কিছুই আধুনিকতায় মোড়া। তারপরেই সুমনের বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক করে আরতি।
***
আরতি এবার ঘড়ির দিকে তাকায়। রাত প্রায় এগারোটা বাজে। সুমনের বাবার প্রেশার ওঠানামা করায় ইদানিং আর রাত করে না। দশটা বাজলেই খাওয়াদাওয়া করে সোজা বিছানায়। তবে মাঝেমধ্যে শুকনো কাশি হওয়ায় সুমনের বাবাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা হয় আরতির। আচ্ছা, সুমন ওর আলমারিতে ঠিকঠাক তালা দিয়েছে? কিন্তু চাবি তো দিয়ে গেল না! একথা মনে হতেই কোনওক্রমে উঠে ঘর থেকে বেরোতেই দেখে সুমনের ঘরে বড় একটা তালা ঝুলছে। দেখামাত্র মাথায় আগুন জ্বলে যায়। আজ পর্যন্ত এ বাড়ির কোনওকিছু বাইরে যায় না। সবকিছুই থাকে আরতির কাছে। এবার ড্রেসিংটেবিলের ওপর রাখা মোবাইলটা নিয়ে ফোন করে সুমনকে। ফোন সুইচড অফ। আরতির নিজেকে বড় অসহায় লাগে। আর দেরি না করে বিছানায় গিয়ে শরীর এলিয়ে দেয়।
***
মায়ের ঘরে ঢুকে সুমন দেখে মা উলটোদিক করে শুয়ে আছে। দু-বার মা বলে ডাকার পর সোজা হয়ে শোয়। তখন রাত একটু গভীর। সুমন অপরাধীর মতো করে পাশে গিয়ে বসে। ও বসতেই আরতি একটু সরে যায়। সুমন বুঝতে পারে, মা এখনও রেগে রয়েছেন। সে মায়ের আঁচলের গন্ধ শুকতে শুকতে বলে, আসলে খাওয়াদাওয়া করতে করতে…
আরতি এবার দপ করে জ্বলে উঠে বলে, একটা ফোন করে তো জানাতে পারতিস। উল্টে আমি ফোন করলাম। তোর ফোন তো বন্ধ ছিল।
সুমন এবার আমতা আমতা করে বলে, আসলে…
আরতি আর কথা বাড়াতে চায় না। সে সরাসরি বলে, ঘরে তালা দিয়ে গেছো তোমরা! চাবিটাও দিয়ে যাওনি। তোমার দু-দিনের সংসারে আমাদের ওপর ভরসা নেই। তাই তো!
এবার বউমাকে শোনানোর জন্য গলা একটু তুলে বলে, এ বাড়িতে এরকম ঘটনা কোনোদিন ঘটেনি। তাহলে এখন থেকে তোমার বাবা আর আমি তোমাদের কোনো ব্যাপারেই থাকব না।
ইতিমধ্যে বউমাও ঘরে এসে ঢোকে। তাকে দেখে আরতি যেন নিজেকে ঠিক রাখতে পারে না। চিৎকার করে বলে, এজন্যই ছোটঘরের মেয়েকে আনতে নেই। তারা ধরাকে সরা জ্ঞান করে।
সুমন খানিকটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে মাথা নিচু করে বসে থাকে। বউমা এবার বলে, তাড়াহুড়োতে ভুল হয়ে গেছে। তাছাড়া আপনার শরীরখারাপ, তাই… বলতে বলতে দৌড়ে নিজের ঘরে ঢুকে বেশ জোরেই দরজা বন্ধ করে দেয় বউমা। সুমন মায়ের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। আঁচলে চাবির গোছাটা বেশ শক্ত করে বাঁধা । এক অজানা শঙ্কা মায়ের মুখে স্পষ্ট দেখতে পায় সুমন।