না বলা কথা // জয়নারায়ণ সরকার
কী দিয়ে শুরু করবে ভেবেই পায় না তনুশ্রী। যদিও শুরু করা গেল আর যেন থামতেই চায় না। কিছুক্ষণ লেখার পর ভাবে, ধুর, চিঠি লিখেই বা কী হবে? মনের খেয়ালে লিখলেও, কাকে দেবে এই চিঠি! ভেতরে ভেতরে অনিরুদ্ধদার মুখটা ভেসে ওঠে। তনুশ্রী নিজেই লজ্জা পায়।
গত পৌষ সংক্রান্তির বিকেলে দাদার সঙ্গে এসেছিল। পরিচয় করে দিয়েছিল দাদা। অনিরুদ্ধ সেন। তাকাতে লজ্জা করছিল তার। মনে আবার ভয়েরও উদ্রেক হয়েছিল। দাদা যদি কিছু বুঝতে পারে! তড়িঘড়ি তড়িঘড়ি পাশের ঘরে চলে গিয়েছিল তনুশ্রী। কিন্তু কীভাবে জোগাড় করব নাম্বারটা। দাদার থেকে নেব? পরক্ষণেই ভাবে, দাদা যদি কিছু জানতে চায় তবে সে কী বলবে? এসব ভাবনায় বুকের ভেতরটা ধড়ফড় করে ওঠে। এবার সে শান্ত হওয়ার চেষ্টা করে।
***
পৌষ সংক্রান্তির সকাল থেকেই মায়ের সঙ্গে কাজ করতে হয় তনুশ্রীকে। নানা রকমের পিঠে-পুলি ও পায়েস করতে করতে বিকেল গড়িয়ে যায়। তনুশ্রীকেও মায়ের সাথে রান্নাঘরে কাটাতে শেষ না হওয়া পর্যন্ত। নারকেল কোড়ানো, তাতে গুড়ের পাক দেওয়া তারপর চাল গুঁড়ো করে রাখা। এসব করার মধ্যেই বার বার ঘড়ির দিকে তাকায়, কখন বিকেল হবে। অনিদা নিশ্চয়ই আসবে। বিকেল গড়িয়ে সন্ধে নামে। মনটা একটু উচাটন হয় তনুশ্রীর।
এর মধ্যেই একটা বাইক এসে থামে বাড়ির সামনে। বাইক থেকে নেমে দাদা অনিদাকে সঙ্গে নিয়ে ঘরে ঢোকে। তাকে দেখেই মনটা চনমনে হয়ে ওঠে। তনুশ্রী দৌড়ে রান্নাঘরে ঢুকে যায়। পাশের ঘরে দাদা ততক্ষণে অনিদার সাথে গল্পে মেতে উঠেছে। পরদা সরিয়ে দুটো প্লেট নিয়ে ঢোকে তনুশ্রী। হাতটা ঠকঠক করে কেঁপেই চলেছে। সে নিজেকে সামলে রাখার চেষ্টাও করে। চোখের দিকে তাকিয়ে দেখে অনিদা কেমন একটা স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। শরীরের মধ্যে কেমন একটা দোলা লাগে তনুশ্রীর। সে আর দাঁড়ায় না বেরিয়ে আসে ঘর থেকে।
***
এখন তো তনুশ্রীর ভরা সংসার। সেটা ঠেলতেই কখন যে দিন থেকে রাত পার হয়ে আবার পরদিন চলে আসে সে বুঝতেই পারে না। দীপক একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির ম্যানেজার। সে হিল্লি-দিল্লি করে বেড়ায়। তার কাছে সংসারে সময় দেওয়া বড্ড কঠিন। তাই তনুশ্রীকেই হাল ধরতে হয়। পৌষ সংক্রান্তির দিনটা এলে মনের মধ্যে কেমন যেন করে। একবার পিঠে-পুলি বানানোর কথা বলায় দীপক বলেছিল, এত হাঙ্গামার কী দরকার। এখন তো এই সময় অনেক জায়গায় খাবারের উৎসব হয়। সেখানে গিয়ে যত খুশি খেয়ে নিলেই তো হয়! তনুশ্রী চুপ করে থাকে। জানে এখন কোনও কথা বলা যাবে না। দীপক অনেক কথা শোনাবে। নিজের হাতে তৈরি করলে যে কী আনন্দ হয়, সেটা ওকে বোঝানো যাবে না। দীপক দিনদিন ফেল কড়ি মাখো তেল-এর মতো কথা বলে। আসলে ও কর্পোরেটের মতো যান্ত্রিক হয়ে উঠেছে। তনুশ্রী একবার ভাবে, পিঠে-পুলির সব জানা আছে। তাহলে একবার করলে হয়। কিন্তু সংসারের সাঁড়াশি চাপে মন থেকে সায় পায় না।
***
সেদিন সকালে মেয়েকে স্কুলের গাড়িতে তুলতে গিয়ে একটা হোর্ডিং চোখে পড়ে। স্কুল-বাসে তুলে দিয়ে তড়িঘড়ি ওই হোর্ডিংটার সামনে এসে দাঁড়ায়। একদৃষ্টে তাকিয়ে লেখাগুলো যেন সে গিলতে থাকে। বিভিন্ন খাবার পাওয়া যাবে খাদ্যমেলায়। ওখানে নিশ্চয়ই পিঠে-পুলি থাকবেই। বাড়ি ফেরার পথে মনে মনে উত্তেজিতও হয়। ঘরে ঢুকেই দীপককে ফোন করে। একবার রিং হতেই ধরে দীপক। তনুশ্রী কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু ওপাশ থেকে দীপক কর্কশ গলায় বলে, এখনও অফিস পৌঁছতে পারিনি। পরে ফোন কোরো। বলেই কেটে দেয়। তনুশ্রীর উচ্ছ্বলতা এক নিমেষে উধাও হয়ে যায়। সে এবার ঘরের কাজে মন দেয়।
সন্ধে হতেই দীপক ফিরে আসে অফিস থেকে। ঘরে ঢুকেই বলে, তাড়াতাড়ি আমার ব্যাগ গুছিয়ে দাও। রাতের ফ্লাইটে মুম্বাই যেতে হবে। বলেই বাথরুমে ঢোকে দীপক। তনুশ্রী কোনো কথা না বলে ব্যাগ গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। দীপক তড়িঘড়ি তৈরি হয়ে নেয়। ইতিমধ্যে অফিসে গাড়িও এসে দাঁড়ায় ফ্ল্যাটের নীচে। বেরোনোর সময় দীপক বলে, এবার ফিরতে বেশ কিছুদিন দেরি হবে। বলতে বলতে লিফটে লাগেজ নিয়ে উঠে পড়ে। তনুশ্রী ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ায়। চারদিকের অন্ধকারটা তার আজ বেশ ঘন লাগে। রাস্তার লাইটগুলো কেমন জোরালো আলোয় অন্ধকারকে খান খান করে দিচ্ছে। দীপকের গাড়িটা মুহূর্তের মধ্যে চোখের আড়ালে চলে যায়। এবার তার সেই হোর্ডিংটার কথা মনে পড়ে।
***
সে ঠিক করে মেয়েকে নিয়ে নিজেই যাবে ওই মেলায়। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতেই হাজির হয় খাদ্যমেলার মাঠে। সঙ্গী মেয়ে। কত রকম খাবারের দোকান! এরই মধ্যে মেয়ের বায়নায় বিরিয়ানি কিনতে হয়। পর পর দোকানের এক কোণায় দেখতে পায় পিঠে-পুলির দোকান। তেমন ভিড় নেই দোকানটার সামনে। ওই দোকানের সামনে যেতেই চমকে ওঠে। তার বুকটা ধড়ফড় করতে থাকে। কিন্তু ওই জায়গা ছেড়ে যেতেও ইচ্ছে করছে না। এবার দোকানি সামনে এগিয়ে এসে মেয়েকে কোলে তুলে নেয়। তনুশ্রী জড়তা কাটিয়ে বলে, কেমন আছো অনিরুদ্ধদা?
অনিরুদ্ধ ভারী গলায় বলল, ভাল। চলো দোকানের ভেতরে বসবে।
বলেই অনিরুদ্ধ মেয়েকে নিয়ে ঢুকে যায় দোকানের ভিতরে। অগত্যা তনুশ্রী গুটিগুটি পায়ে গিয়ে হাজির হয় সেখানে। সে এবার পরিচয় করিয়ে দেয় স্ত্রী পল্লবীর সাথে। তনুশ্রী একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তার দিকে।
অনিরুদ্ধ হেসে বলে, কলেজে পড়ার সময় প্রত্যেক বছর তোমাদের বাড়ি গিয়ে কত পিঠে খেয়েছি। এবার পল্লবীর হাতের পিঠে তোমায় খাওয়াব।
মনের মধ্যে তখন যেন ঝোড়ো বাতাস বইছে। নিজেকে সামলে নিল তনুশ্রী। অনিদা বলতে গিয়ে গলাটা কেঁপে ওঠে। তারপর আস্তে আস্তে বলে, তুমি কি চাকরি ছেড়ে দিয়েছো?
অনিরুদ্ধ একগাল হেসে বলে, আরে না না, পল্লবী এই ব্যবসাটা শুরু করেছে। আমি অবসরে সাহায্য করি। তবে তোমাদের বাড়ির পিঠের স্বাদ ভুলতে পারিনি এখনও।
অন্যদিকে পল্লবী অনেকগুলো পিঠে কাগজের বাস্কে ভরে দেয়। তনুশ্রী টাকা দিতে চাইলেও সে নেয় না।
মেলার মাঠ থেকে বেরিয়ে হাঁটতে থাকে তনুশ্রী। নিজেকে বড্ড নিঃসঙ্গ লাগছে। সেদিনের না-বলা কথাটা বুকের মধ্যে মোচড় দিতে থাকে। তনুশ্রী পিঠের বাক্সটা ধরে জোরে জোরে শ্বাস নেয়। পিঠের সুঘ্রাণে মনের ভেতরটা তোলপাড় হতে থাকে…