অবসর // জয়নারায়ণ সরকার
ব্যাগ হাতে রমেনবাবু সারা বাজার চক্কর দিতে থাকেন। কোনো কিছুর দাম জিজ্ঞেস করতেও আজকাল বেশ আতঙ্কে ভোগেন। এরই মধ্যে চায়ের দোকানে গিয়ে এক ভাঁড় চা খাওয়া হয়ে গেছে। আগে এই অভ্যেসটা ছিল না। ইদানিং ঘুরতে ঘুরতে পা ব্যথা হলেই এক ভাঁড় চা নিয়ে একটু জিরিয়ে নেন। মাস দুই হল এ রকম পরিস্থিতি দেখছে রমেনবাবু। চায়ের দোকানে বসে অনেকেই এই মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে গলা ফাটাচ্ছেন। কিন্তু ওই অবধি। বাজারের দাম ওঠানামা করে নিজের তালেই। তবে তাতে কারোর যেন কিছুই যায় আসে না। একমাত্র রমেনবাবুদের মতো লোকদের হয়েছে সব থেকে বড় সমস্যা। একটা বড় ব্যাগের একদম নীচে পড়ে থাকে মাছ, আনাজ। এখনো যৌথ পরিবার থাকায় বুঝে বাজার করতে হয় তাকে। এই তো সেদিন রাতে ডিম হওয়ায় ছোট বউ অনেক কথা শুনিয়ে যায় গিন্নিকে। সেই কথাগুলো রাতে উগড়ে দেয় রমেনবাবুর কাছে। কিন্তু কিছুই বলতে পারে না। শুধুমাত্র ছাদের দিকে তাকিয়ে চুপ করে শুয়ে থাকে।
***
এই বাড়িতেই তো তিন ভাই মানুষ হয়েছে। বাবা বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করতেন। তাঁর আয়ে মোটামুটি সংসার চলে যেত। ইচ্ছে থাকলেও শখ-আহ্লাদ সেভাবে মেটাতে পারতেন না। মায়ের তো সারাদিন রান্নাঘরেই কেটে যেত। তবুও রমেনবাবুরা কখনো খাওয়া নিয়ে কোনো অভিযোগ করত না। ছোটভাই মাঝেমধ্যে কিছু বলতে চাইলে বড়দাদা রমেনবাবু তাকে বুঝিয়ে শান্ত করতেন। বাবা থাকতেই রমেনবাবু একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে হিসেব রাখার চাকরি পায়। সেই খবর বাবাকে দেওয়ার সময় সে লক্ষ করেছিল যে তাঁর মুখে একটা খুশির আভা। যদিও বাবার মুখে কোনো অভিব্যক্তি প্রকাশ হত না। এই প্রথম সেটা দেখে বেশ ভাল লেগেছিল রমেনবাবুর। আর এক ভাই কলেজে পড়াকালীন রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ে। সেটা জেনেও বাবা নিশ্চুপ থাকতেন। তবে এক এক সময় বলতেন, তোমরা এখন সাবালক। যেটা ভাল বুঝবে সেটা করবে। কিছুদিন বাদে ওই ভাই রাজনীতির দাদাদের ধরে সরকারি চাকরি জোগাড় করে। যখন সে এই খবর বাবাকে দিয়েছিল তখন বাবার মুখটা কেমন পাংশে দেখাচ্ছিল। তাকে প্রথম পোস্টিং দিয়েছিল বোলপুর। এই প্রথম একান্নবর্তী সংসারে ফাটল দেখা দিল। প্রথম প্রথম এক সপ্তাহ পরে একদিনের জন্য বাড়ি আসত। ও যেদিন আসত সেদিন একটু বেশি রান্নাবান্না করত মা। মাসের টাকাটা মানি অর্ডার করে পাঠিয়ে দিত মেজভাই। ইতিমধ্যে রমেনবাবু ও মেজভাইয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। অন্য পরিবার থেকে বউমারা এসে ভাল-মন্দের সাথে নিজেদের জড়িয়েও নিয়েছে। হঠাৎই এক সন্ধেবেলায় হার্ট অ্যাটাকে বাবা মারা যান। বাবা চলে যাওয়ার মাস দুয়েকের মধ্যে মা অসুস্থ হয়ে পড়েন। অনেক চেষ্টা করেও তাঁকে বাঁচানো যায়নি। মায়ের চিকিৎসার বেশিরভাগ দায়িত্ব নেয় মেজভাই। তখনো ছোটভাই বেকার হয়ে ঘুরে বেড়ায়। রমেনবাবু অনেকবার বলেছে কোথাও কোনো চাকরি করতে। সে সেসব কথায় কান দেয়নি। বন্ধুবান্ধব নিয়ে সারাদিন ধরে আড্ডা দিয়ে কাটিয়ে দিত। যখন কোথাও কিছু হচ্ছে না দেখে সে নিজের কোম্পানিতে ঢুকিয়ে দিতে চেয়েছিল। মালিক রাজিও ছিলেন। কিন্তু ছোটভাই রাজি নয়। ওর চিন্তাতেই বিভোর হয়ে থাকতেন রমেনবাবু।
***
গলদঘর্ম হয়ে অফিস থেকে ফিরে সবে ঘরে ঢুকেছেন এরইমধ্যে লোডশেডিং হয়ে যায়। বাধ্য হয়ে হাত পাখাটা হাতে নিয়ে বাতাস করতে থাকেন। এরমধ্যে এলাকায় পরিবর্তন শুরু হয়ে গেছে। পুরোনো বাড়িগুলো ভেঙে বিশাল বিশাল অট্টালিকা উঠছে। শোওয়ার ঘরের পাশেই এরকম একটা অট্টালিকা হওয়ায় আলো-বাতাস আর ঘরে ঢোকে না। এই অবস্থায় নিজেই চিৎকার করে বলে, ওইসব বিল্ডিংগুলোর নীচে একদিন মান-সম্মান-লৌকিকতা- আদর-ভালবাসা সব-সব চাপা পড়বে। কিন্তু রমেনবাবুর কথা কে শোনে!
শুধুমাত্র বউ পাশ থেকে বলে, তোমার ভাল লাগে না বলে আর কারোর লাগবে না? অনেকে এই ব্যবসা করে বড়লোক হয়েছে।
এবার মুখ বেঁকিয়ে রমেনবাবু বলেন, তুমি ওই নিয়েই থাকো। সবকিছু জলাঞ্জলি দিয়ে টাকার ওপরে বসে থাকাটা খুব সম্মানের!
রমেনবাবুর প্রেশার বেড়ে যেতে পারে ভেবে বউ আর কথা বাড়ায় না।
এক সন্ধেতে প্রচণ্ড গরমে অফিস থেকে হাঁসফাঁস করতে করতে বাড়ি ফিরে ফুল স্পিডে ফ্যান চালিয়ে নীচে বসে বিশ্রাম নেয় রমেনবাবু।
বউ এককাপ চা এনে সামনে রেখে চলে যায়। যাওয়ার সময় দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে যায়। কিছুক্ষণ পরে দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শুনতে পান রমেনবাবু। দরজার দিকে তাকাতেই দেখে ছোটভাই উঁকি দিচ্ছে।
সাথে সাথে রমেনবাবু বলেন, আয়, ভেতরে আয়। কিছু বলবি?
ইতিমধ্যে দরজা ঠেলে ঢোকে ছোটভাই। তার হাতে বড়ো একটা মিষ্টির হাঁড়ি। হাঁড়ির দিকে চোখ পড়তেই তার চোখদুটো বড় হয় রমেনবাবুর।
ছোটভাই হাঁড়িটা টেবিলে রাখতে রাখতে বলে, তোমাকে একটা কথা বলব বলে কয়েকদিন ধরে ভাবছিলাম কিন্তু ডিলটা ফাইনাল না হওয়ায় বলতে পারছিলাম না। আজই ফাইনাল হল।
রমেনবাবু যেন কিছুই বুঝতে পারছেন না। তার চোখদুটো বিস্ময়ে আরো বড় হতে থাকল। ছোটভাই এবার বলল, আমি একটা বাড়ি নিয়েছি। ওটা প্রোমোটিং করব।
রমেনবাবু যেন বিষম খেলেন। তারপর নিজেকে ধাতস্থ করে বললেন, এ তো অনেক টাকার ব্যাপার। তাছাড়া…
মুখের কথা কেড়ে নিয়ে ছোটভাই বলে, ওসব নিয়ে তোমায় ভাবতে হবে না। আমি ঠিক ম্যানেজ করে নেব। বলেই বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। রমেনবাবু একদৃষ্টে চেয়ে থাকে হাঁড়িটার দিকে।
***
পাল্টে যাচ্ছে, সব পাল্টে যাচ্ছে। রাস্তাঘাট থেকে শুরু করে পাড়ার লোকজন অবধি। তার ওপর পুরনো একতলা বাড়ির জায়গায় বহুতল উঠেছে। এখন অনেক মানুষকে চিনতেই পারেন না রমেনবাবু। ছোটভাইও ফুলেফেঁপে উঠেছে। এলাকায় অনেকগুলো বহুতল করে ফেলেছে সে। নামডাকও হয়েছে। টাকার মাঝে বসে যদি সংসারে মন না বসে তাই তড়িঘড়ি বিয়ে দেন তার। নিজেই পছন্দ করে এনেছিল ছোট বউমাকে।
ইতিমধ্যে মেজভাই বদলি হয়ে চলে এসেছে। সে এখন বাড়ি থেকেই ডেলি প্যাসেঞ্জারি করে। এদিকে রমেনবাবু চাকরি থেকে রিটায়ার করে বাড়ির সমস্ত কাজ নিয়ে সারাদিন ব্যস্ত থাকেন। ইদানিং ছোটভাই মাঝে মাঝে বাজার করে আনে। সেদিন একটু বেশি পদ রান্না হয়। তবে এজমালির টাকায় নয়, সে নিজের থেকেই খরচ করে। সেইসব দিনগুলোতে সকালে বেরোতে হয় না রমেনবাবুকে। একটা ব্যাপার তার নজরে এসেছে। ইদানিং বাড়ির কিছু কিছু ব্যাপারে ছোটভাই সিদ্ধান্ত মান্যতা পায়। রমেনবাবুকে কিছুই জানানো হয় না। ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরে সে জানতে পারলেও মুখে কিছু প্রকাশ করেন না।
প্রতিদিন সন্ধেবেলায় হাঁটতে বের হন। বাড়ি ফিরে আসার সময় বাজার থেকে টুকিটাকি কিছু কিনে আনেন। একটু বেশি রাত হলে সামান্য সস্তাতেও মেলে। এমনই একদিন বাড়ি ফিরে বাজারের ব্যাগটা বউয়ের হাতে দিয়ে ঘরে ঢুকে খবরের কাগজটা নিয়ে বসে। বাইরে থেকে মেজভাইয়ের গলা শুনতে পান। খবরের কাগজ থেকে মুখ তুলে দেখে মেজ ও ছোটভাই সামনে দাঁড়িয়ে। খানিকটা বিস্ময়ের সুরে বলেন, তোরা কিছু বলবি?
তারপর দেখে মেজভাই কেমন আমতা আমতা করতে থাকে। তার পাশ থেকে ছোটভাই বলে, এই বাড়ির অবস্থা খুবই খারাপ। কোনোকিছু সারানো হচ্ছে না। মাঝে মাঝে চাঙড় খসে পড়ছে। তাই আমরা ঠিক করেছি এটা প্রোমোটিং করব।
রমেনবাবু আকাশ থেকে পড়লেন। ওরা এসব কী বলছে! বাবা কত কষ্ট করে বাড়িটা আগলে রেখেছিলেন। এবার সে চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়েন। দ্রুত পায়চারি করতে করতে বলেন, তোমরা তো ঠিক করেই ফেলেছো। আবার আমাকে জিজ্ঞেস করতে এসেছো কেন?
ছোটভাই এবার ঘাড় বেঁকিয়ে বলে, তুমি যদি সই না দাও! তাহলে তো সব আটকে যাবে।
রমেনবাবু এবার দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বলেন, বাড়ির অবস্থা খারাপ! চাঙড় ভেঙে পড়ছে! তা পড়ুক। একান্নবর্তী প্রথা তোমরা ভাঙতে চাও। টুকরো টুকরো হয়ে গেলে কুক্ষিগত জীবন বয়ে বেড়াতে হবে।
ছোটভাই কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল এমন সময় তাকে হাত তুলে থামতে বলেন। তারপর রমেনবাবু বলেন, ঠিক আছে। এই জমিতে যারা যারা বাস করে তাদের সবার মতামত জানতে চাই।
একে একে সকলে এসে হাজির হয় রমেনবাবুর সামনে। ছোটভাই কথাটা উত্থাপন করে। রমেনবাবু দেখেন সবাই তার বিপরীতে। এমনকি অর্ধাঙ্গিনীও!
রমেনবাবু মুখটা আরও নিচু করে বসে পড়ে। ঘর থেকে অন্যেরা ততক্ষণে চলে গিয়েছে। উদাস চোখে তাকিয়ে থাকেন সামনের ক্যালেন্ডারের দিকে, যেখানে দুটো শিশু গলা জড়িয়ে হাসছে। তারপর আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ান। পা দুটো যেন কেঁপেই চলেছে।