Joy Narayan Sarkar

আমার মা কখনও বাপের বাড়ি যাননি
জয়নারায়ণ সরকার

আমার মা কখনও বাপের বাড়ি যাননি। সবুজে ঘেরা মেঠোপথ আর পুকুরের জলে হাঁসেদের অবাধে ঘুরে বেড়ানো বেশিদিন দেখেননি। মাথা থেকে কোমর ছাপিয়ে যাওয়া চুল নিয়ে যখন পুকুর থেকে উঠে আসতেন তখন জলপরী বলে দাদু মাকে ক্ষেপিয়ে তুলতেন।

যে রাস্তাটা এঁকেবেঁকে স্কুল অবধি চলে গেছে। কখনও উষ্ণতা, কখনও জলে ঢোবা আবার কখনও শিশিরভেজা রাস্তা ধরে বেশিদিন যাতায়াত করতে পারেননি। প্রথম প্রথম দাদা-ভাইদের সাথে উদ্দীপনায় ভেসে কখন যে ওই রাস্তা ধরতেন, তা নিজেই জানতেন না। হঠাৎই আশেপাশের লোকেরা, যাঁদের জন্মের পর থেকে আপনজন জেনে এসেছেন, তাদের মধ্যে কেউ কেউ কেমন যেন পালটে যেতে থাকে। ওই বয়সে কিছু না বুঝলেও অভিভাবকদের কড়া শাসনে আর ওমুখো হননি তিনি।

সবকিছুই কেমন যেন পালটে যেতে থাকে। ওই গ্রাম, ওই টিনের চালার ঘর, ওই মেঠো পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে কখন যে কুচকুচে কালো রাস্তায় পাকা দালান দেওয়া বাড়িতে এসে উঠেছিলেন, তা নিয়ে কোনও দিন কিচ্ছু বলেননি কাউকে।


বড়মামা, মেজমামা, সেজমামা, রাঙামামা, ছোটোমামা কখনও কখনও এসে আমাদের নিয়ে যেতেন। মামাবাড়ি যাওয়ার আনন্দে নেচে উঠতাম আমরাও। তাও বছরে একবার কি দু<বার। কিন্তু মা কখনও যাননি আমাদের সঙ্গে। মামারা কত কাকুতিমিনতি করেছেন, তাও এক চুল নড়ানো যায়নি তাঁর সিদ্ধান্ত থেকে।

মামাবাড়ি গিয়ে একদিন থাকার পর আমাদের কেমন বেস্বাদ লাগত। আসার আগে যে উদ্দীপনা, সেসব কোথায় যে ফানুসের মতো উড়ে যেত তা বোঝা যেত না। কান্নাকাটি শুরু করলে অগত্যা ছোটোমামা ফিরিয়ে দিয়ে যেতেন। বাড়িতে পা দিতেই সেই মনখারাপ ম্যাজিকের মতো ভ্যানিশ হয়ে যেত। ছোটোমামাকে আদর করে খাইয়ে তবে ছাড়তেন। যাওয়ার সময় হাতে কিছু খুচরো পয়সা সবার চোখের আড়ালে গুঁজে দিতেন। তারপর আবার নিজের কাজে মগ্ন হয়ে থাকতেন।


বাবা সারাদিন, সারা সপ্তাহ, সারা মাস, সারা বছর জুড়ে ব্যস্ততার পারদে ওঠানামা করতেন এতগুলো মানুষের জন্য। কাজের অবসরে নিজের মতো থাকতে ভালবাসতেন বাবা। কিন্তু মা যেন সবকিছুতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। অভিযোগ বা অনুযোগ বলে শব্দগুলো আছে, তা হয়তো জানতেন না তিনি।


ভাইফোঁটায় পিসিরা আসতেন। মা আড়ালে থেকে সব গুছিয়ে দিয়ে রান্নাঘরে ব্যস্ত হয়ে পড়তেন। কখনও মেজমামা, কখনও ছোটমামা আসলে মায়ের মুখে হালকা হাসির রেখা খেলে যেত। ওইদিন পিসিরা মায়ের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠতেন। আর অলক্ষ্যে মায়ের ঘাম ঝরত গুমোট, উনুনের আঁচে গরম হয়ে ওঠা ঘরে। আদেশ, অভিযোগ, অনুযোগ, ঝগড়া, কথা কাটাকাটি, পাঁচকান করার মতো সংসারের অসুখ কখনও হয়নি তাঁর।
***
ছেলের বিয়ে দিয়েছেন নিজের হাতে। সেভাবে দেখাদেখি করতে দেননি। এক বিকেলে দুই বাড়ির বড়রা বসে ঠিক করে ফেলে দিনক্ষণ। সেই সন্ধেতে তিনিই ছিলেন মধ্যমণি। বিয়ে-পর্ব শেষ হতেই এক সকালে সদ্য বাড়ির বউকে নিজের ঘরে ডেকে নিয়ে গিয়েছিলেন।

রুদ্ধদ্বারে দুজনের কী কথা হয়েছিল তা আর জানতে পারেনি কেউ। পরদিন থেকে বউমা হয়ে উঠেছিল শাশুড়ির ছায়াসঙ্গী। পানের ডিবে থেকে চুল বাঁধার ফিতে হাতের সামনে না পেলেই হাঁক পাড়ত শাশুড়ি।

বউমাও মুহূর্তের মধ্যে খুঁজে এনে হাজির হয়ে যেত। বউমা সকালে উঠতে একটু দেরি করলে, সুর করে বলতেন, সংসার সুখের হয় রমণীর গুনে। তারপর নিজে ব্যস্ত হয়ে পড়তেন ঘরকন্নার কাজে। দু-একটা বিড়াল তাঁর গা-ঘেঁষে চুপ করে বসতো।


ছেলেকে মাঝে মাঝেই বলতেন, বউমাকে কাছাকাছি কোথাও একটু ঘুরিয়ে নিয়ে আসতে। ছেলে কাজ আছে বলে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতেই খানিকটা ধমকের সুরে বলতেন, মাঝে মাঝে বাইরে বেরোলে মনটা ভাল থাকে। কাজ তো সারা জীবন থাকবে। তা বলে… তোর বাবাও তো কাজ কাজ করেই গেল সারাজীবন ধরে। মেয়েদেরও যে একটা মন আছে!
মায়ের কথার পর ছেলে আর বসে থাকতে পারেনি। সস্ত্রীক বেরিয়ে পড়েছিল ভাঙাচোরা রাস্তা ধরে।


বউমা বাপের বাড়ি যেতে চাইলে কখনও বারণ করেননি। ওর চলে যাওয়ার পথে বিষণ্ণ মাখানো চোখে তাকিয়ে থাকত অনেকক্ষণ। হয়তো অনুভবে ভেসে উঠতো টিনের চালার বাড়ি, সবুজে ঘেরা মাঠ, মেঠো রাস্তা, কত রকম গাছ-গাছালি, বর্ষায় পুকুর ছাপিয়ে রাস্তায় হাঁটু অবধি জল উঠে আসা। ওই রাস্তা, ওই গাছ, ওই পুকুরকে ভুলে গেলেও, ভেতরের মানুষটাকে হয়তো ভুলতে পারেনি…নিশ্বাস নেওয়া ও ছাড়া যেমন সত্যি, তেমনি আমার মা কখনও বাপের বাড়ি যাননি।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *