অপেক্ষা // জয়নারায়ণ সরকার
আমার পিসি ধনী বলতে যা বোঝায়, তাই ছিলেন। গাড়ি, বাড়ি, লোকলস্কর সবই ছিল। লম্বা, ফরসা, টান টান ত্বকে বেশ সুন্দরীও ছিলেন। মুম্বাই ছিল পিসির বিয়ের পর পাকাপাকি বাসস্থান। আমাদের অবস্থা তেমন ছিল না বলে সেখানে যেতে পারিনি কখনও। তবে নিঃসন্তান পিসি কখনও-সখনও আমাদের বাড়িতে আসলে খুব মজা হত। ওই ক’টা দিন আনন্দে মেতে উঠত সারা বাড়ি। যেদিন এসে পৌঁছতেন, সেদিন আমরা ভাইবোনেরা দলবেঁধে বসে থাকতাম ঠাকুমার খাটের ওপরে। আমরা জানতাম, পিসি এসেই ঠাকুমাকে প্রণাম করে ঢাউস ব্যাগটা খুলবে। বিকেলে আসার খবর দিকে দিকে ছড়িয়ে দিতেন ঠাকুমা নিজে। ছোটো মেয়েকে দেখবে বলে সেও ঠায় বসে থাকতেন রাস্তার দিকে মুখ করে। পিসি, পিসেমশায় ঘরে ঢুকতেই আমাদের মধ্যে উশখুশ শুরু হয়ে যেত। পিসি ঠাকুমাকে প্রণাম করে তাকাতেন আমাদের দিকে। কেউ কেউ তাকিয়ে হেসে উঠত। সেই হাসিটা ছিল কে কত আপন, তা বোঝানোর জন্য। আমি ছোটো থাকায় সবার পেছনে বসতে হত। কিন্তু পিসি সবাইকে এড়িয়ে আমার দিকে দু’হাত বাড়িয়ে দিতেন। আমিও লাফ দিয়ে উঠে পড়তাম পিসির কোলে। অন্যরা তখন একে-অন্যকে দেখত।
এরপর পিসির জন্য রাখা চেয়ারটাতে আমাকে কোল থেকে নামিয়ে বসিয়ে দিতেন। এরই মধ্যে মা এসে দু’কাপ চা দিয়ে যেতেন সামনের টেবিলে। ঝকঝকে চায়ের কাপ আর ডিশ দেখা যেত ওই ক’দিন। পিসি কাপের দিকে না তাকিয়ে নিচু হয়ে বড় লাগেজটা খুলতে উদ্যত হত। সাথে সাথে ভাইবোনেরাও একসাথে মাথা ঝুঁকিয়ে তাকিয়ে থাকতাম ব্যাগের দিকে। তারপর সেই সময়ের মহার্ঘ্য ফাইভ স্টার ক্যাডবেরি মিলতো হাতে-হাতে। সবার কাছে পৌঁছনো মাত্র আস্তে আস্তে ভিড় হালকা হতে শুরু হত। ঠাকুমা আর পিসির মধ্যে কী কথা হত, তা কেউ জানত না। মা, কাকিমারা এসে কুশল বিনিময় করে যে যার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়তেন। পিসেমশায় কিছুক্ষণ ঠাকুমার সঙ্গে কথা বলে ওই ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বাবা বা কাকার ঘরে ঢুকে যেতেন। আমরা আর কারোর খবর রাখতাম না। বেরিয়ে পড়তাম বাড়ির বাইরে। ভেতরে ভেতরে বেশ লাগত। কাউকে বুঝতে না দিলেও মনটা খুশিতে ভরে উঠত।
***
তার পরেও কয়েকবার পিসি এসেছেন। আমরা ভাইবোনেরা তখন বেশ বড়। এখন আর কেউ অপেক্ষায় বসে থাকে না। ততদিনে ওই পাড়াগাঁয়ের দোকানে বয়ামের কাঁচের ভেতর দিয়ে ক্যাডবেরি উঁকি দেয়। পিসি তাঁর স্বভাবমতো আনলেও তাঁর কাছ থেকে আর নেওয়া হয় না। মা, কাকিমাদের হাতে দিয়ে দিলে আমরাও পেয়ে যেতাম রাতের পড়া শেষ হলে। সে নিয়ে আর কারও মধ্যে আগ্রহ লক্ষ্য করা যায়নি।
সেবার পিসি এসেছিলেন। তবে ঠাকুমার খাটটা ফাঁকা পড়েছিল। পিসি এবার আর ফাইভ স্টার আনেননি। ভাইবোনেরাও ফিরে তাকায়নি ঢাউস ব্যাগটার দিকে। রাতে বিছানায় শোওয়ার আগে মা এসে বললেন, এবার থেকে পিসিরা এখানেই থাকবেন।
কথাটা শোনার পর কার ও মধ্যে উত্তেজনা লক্ষ্য করা গেল না। শুধুমাত্র মেজদি বলেছিল, এ বাড়িতেই থাকবেন? মা তখন হেসে বলেছিলেন, না না, পাশের পাড়ায় জমি কেনা আছে। সেখানে বাড়ি করবেন ওঁনারা।
কী জানি কেন, আমার মনটা বিষণ্ণতায় ভরে গিয়েছিল। তাহলে, পিসির ওই দূরের বাড়িতে আর যাওয়া হবে না। আমার মুখ দেখে ছোড়দি বলেছিল, ভালই হল বল। যখন-তখন পিসির বাড়ি যাওয়া যাবে।
***
প্রথম প্রথম যাতায়াত লেগে থাকলেও পরবর্তীতে ক্রমশ কমে যেতে থাকে। পিসিও এখন আর তেমন আসতে পারেন না। ততদিনে অনেক বদল ঘটেছে বাড়িতে। ইতিমধ্যে বাবাও পাড়ি দিয়েছেন না ফেরার দেশে। বোনেরাও বিয়ে হয়ে অন্য বাড়িতে চলে গেছে। হঠাৎই এক সকালবেলায় বাড়িতে হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। দেরি না করে পৌঁছে যাই পিসির বাড়ি। আমাদের দেখে পিসি বুকফাটা আর্তনাদ করে ওঠেন।
তারপর থেকে পিসির বাড়ি যেতে মন চাইত না। মায়ের নির্দেশে কয়েক বার যেতেও হয়েছে। পিসি সাদা থান পড়ে বসে থাকতেন সামনের ঘরে। বোবা চোখে তাকাতেন সবার দিকে। তাঁর ওই চোখের দিকে তাকাতে পারতাম না। ভেতরটা কেমন যেন করে উঠত।
এখন আর কেউ যায় না পিসির বাড়ি। একা-একা দিন থেকে রাত, রাত থেকে দিন অতিবাহিত করেন। নানা রোগ এসে ক্রমশ বাসা বাঁধছে শরীরে। টান টান ত্বকে ভাঁজের আধিক্য স্পষ্ট। স্বাস্থ্যেও ভাটার টান চোখে পড়ার মতো। পিসি আর বাইরে বেরোতে পারেন না। প্রাইভেট কোম্পানি থেকে পিসেমশাইয়ের পাওয়া শেষ সম্বলটুকু ব্যাঙ্কে রেখে তা থেকে যা পান, তাই দিয়ে সংসার চালান। দিন-রাতের কাজের মাসির দেখভালে থাকতে হয় তাঁকে। সামনের বারান্দায় চেয়ারে বসে থাকেন সারা বিকেল। মাঝে মাঝে উঠে বারান্দার রেলিং ধরে ঘোলাটে চোখে সামনের রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকেন! অপেক্ষায় কাটে সারা বিকেল।