আলো-আঁধারি // জয়নারায়ণ সরকার
কোথায় চললি দাদা?
ঘর থেকে চিৎকার করে বলল শর্মি।
কোথাও না রে, এই সামনে থেকে একটু ঘুরে আসি।
তাহলে একটা কাজ করে দিবি আমায়?
তোর ফাইফরমাশ খাটার জন্যই তো এখানে থাকি।
কী বলছিস তুই, ভাল হবে না কিন্তু।
ভাল আর হচ্ছে কই?
আমাকে ক’টা শ্যাম্পুর স্যাসের প্যাকেট এনে দে না?
ওঃ বাবা, তুই চুলে শ্যাম্পু করবি আর সেটা আমি এনে দেব!
তুই বাইরে যাচ্ছিস বলেই তো বললাম।
আমি যখনই বেরোবো তখনই তোর কিছু না কিছু এনে দিতে হয়। আমি বেগার খাটতে পারবো না।
ঠিক আছে, যে টাকাটা ফিরবে তাই দিয়ে কিছু কিনে নিস।
আমি কারও থেকে ভিক্ষা নিই না।
ইস, এটাকে তুই ভিক্ষা বললি?
শোন, আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। আমি চললাম।
ও মা, দেখো না, দাদা কিছুতেই রাজি হচ্ছে না।
আর কাঁদিস না। এখন থেকে নিজের কাজ নিজে কর।
কথাটা বলেই দাদা হনহন করে হেঁটে বাইরে বেরিয়ে যায়। স্নেহা ওঁর চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলে, স্বার্থপর কোথাকার!
পড়তে পড়তে কখন যে বেলা গড়িয়ে গেছে বুঝতে পারেনি স্নেহা। হঠাৎ খেয়াল হয়, টেবিলের এক কোণে কতগুলো শ্যাম্পুর স্যাসের প্যাকেট রাখা। কিন্তু কে ওখানে রাখল? দাদা তো এ ঘরে ঢোকেনি! স্নেহা চট জলদি উঠে পড়ে চেয়ার থেকে। শ্যাম্পুর প্যাকেটগুলো হাতের মুঠোর মধ্যে ভরে ঊর্ধ্বশ্বাসে ঘর থেকে বেরোতেই দ্যাখে, বারান্দার এক কোণে চুপটি করে দাদা দাঁড়িয়ে। দৃষ্টি রয়েছে ওর ঘরের দরজার দিকে। ওকে ওভাবে বেরোতে দেখে দাদার সারা মুখে একটা অদ্ভুত হাসি ছড়িয়ে পড়ে।
***
শ্বশুরবাড়িতে আসার পর থেকে কিছুই করতে হয়নি স্নেহাকে। শাশুড়ি মা সংসারের সবদিক আগলে রেখেছিলেন। স্নেহাকেও স্নেহের বন্ধনে আগলিয়ে রেখেছিলেন। অল্প দিনের মধ্যেই কত আপন হয়ে উঠেছিল। হঠাৎ করে শাশুড়ি মায়ের চলে যাওয়া মেনে নিতে পারেনি। মাঝে মাঝে স্নেহার বড্ড খালি খালি লাগত। নিজেকে ব্যস্ত রাখতে সংসারের যাবতীয় দায়িত্ব ঘাড়ে তুলে নেয়। সেই শুরু।
ইদানিং মাস শেষ হতে না হতে মুদিখানার লিস্ট তৈরি করে সায়ন্তনের হাতে ধরিয়ে দেয় স্নেহা। অফিস যাওয়ার পথে লিস্টটা দিয়ে যায় সায়ন্তন। ফেরার পথে ব্যাগ ভর্তি করে নিয়ে আসে।
রবিবার সন্ধ্যাবেলায় সায়ন্তন চা খেতে খেতে টিভি দেখতে থাকে। অন্যদিকে স্নেহা ওই ঘরে বসে মুদিখানার মালগুলো গুছিয়ে তুলে রাখতে গিয়ে দ্যাখে, শ্যাম্পু নেই। লিস্টে চোখ বোলাতে গিয়ে থমকে যায় সে। শ্যাম্পু যে লেখাই হয়নি। সে জিভ কেটে বলে, ইস সায়ন্তন, শ্যাম্পুটা লেখা হয়নি। আর একবার গিয়ে নিয়ে এসো।
সায়ন্তন টিভির চ্যানেল ঘুরিয়ে বলে, এখন আমি বেরোতে পারব না। পরে দেখা যাবে।
স্নেহা আস্তে করে বলে, পরে কেন? এখনই গিয়ে নিয়ে এসো আর খাতায় দামটা যোগ করে দিতে বোলো।
সায়ন্তন এবার খানিকটা গলা তুলে বলে, ভুল করবে তুমি আর আমাকে ফালতু খাটতে হবে! ওসবে আমি নেই। রেখে দাও, যখন বেরোব, তখন দেখা যাবে।
স্নেহা খানিকটা অভিমানের সুরে বলে, সব দোষ আমার। সবকিছু তো আমাকেই দেখতে হয়। এবার না হয় ভুল হয়ে গেছে!
সায়ন্তন বাক্ রুদ্ধ স্বরে বলে, এবার ভুল! প্রতিবারই কিছু না কিছু ভুল করো। এবার আর আমি পারব না। এ মাসে চুলে শ্যাম্পু করতে হবে না।
স্নেহা অবাক করা গলায় বলে, কী বলছো তুমি? সামান্য একটা জিনিসের জন্য তুমি পায়ে পা দিয়ে ঝগড়া করছো!
সায়ন্তন আরও রেগে বলে, সামান্য হোক বা অসামান্য, আমি আর দোকানে যেতে পারবো না।
স্নেহা উদ্বিগ্ন হয়ে বলে, তোমার কি শরীরখারাপ লাগছে?
কেন, আমার শরীরখারাপ হতে যাবে কেন। যত্তসব রাবিশ কথাবার্তা। কথাগুলো বলে সায়ন্তন হাতে ধরা রিমোটটা ছুঁড়ে ফেলে ভেতরের ঘরে চলে যায়।
এবার স্নেহা খানিকটা উত্তেজিত হয়ে বলে, আমার ওপর রাগ দেখাচ্ছো দেখাও। জিনিস ক্ষতি করছো কেন? সামান্য একটা জিনিসের জন্য এতকিছু আর ভাল লাগে না।
***
দাদার শরীরটা কয়েকদিন হল ভাল যাচ্ছে না। বউদি ফোন করে বলেছিল স্নেহাকে। ভেতরে ভেতরে উৎকণ্ঠায় দিন কাটছিল তার। কিন্তু এদিকে সায়ন্তনের অফিসে কাজের চাপও বেড়ে গেছে। কিছুতেই দাদার কথাটা ওকে বলতে পারছে না স্নেহা। একবার ভেবেছিল, সায়ন্তন অফিস বেরিয়ে গেলে নিজেই চলে যাবে দাদাকে দেখতে। আবার পরক্ষণেই মনে হয়, সায়ন্তন ফিরে আসার আগে যদি না ফিরতে পারে। এরকম সাত-পাঁচ ভাবনার মধ্যে ডুবে থাকে স্নেহা।
সেদিন সন্ধেতে বউদি ফোন করেছিল। মোবাইল স্ক্রিনে দাদা লেখা ওঠায়, ভেবেছিল দাদা করেছে। কিন্তু হ্যালো বলতেই বউদির গলা পায়। বউদি বলল, দাদার অবস্থা এখন ভাল নয়। বউদির কথা বলার মাঝেই শুনতে পায় দাদার গলা।
ভাঙা স্বরে একনাগাড়ে বলে চলেছে, আয় না একবার। তুই যা চাইবি তাই আমি কিনে নিয়ে আসব। দাদার ওপর রাগ করিস না। একবার অন্তত আয়। সায়ন্তনকে বলিস, একবার আমাকে দেখে যেতে। ও হয়তো ব্যস্ত মানুষ। তবুও…
বিছানায় ধড়মড় করে উঠে বসে স্নেহা। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। পাশে তাকিয়ে দ্যাখে সায়ন্তন কোলবালিশ জড়িয়ে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দ্যাখে তিনটে বাজে। বিছানা থেকে নেমে বাথরুমে গিয়ে ঘাড়ে-মুখে জলের ঝাপটা দেয়। ড্রেসিং টেবিলের পাশে রাখা জলের বোতলটা তুলে ঢকঢক করে গলায় ঢালে। আবার বিছানায় গিয়ে বসে। চাদর টেনে শুয়ে পড়ার সময় মোবাইলটা বাজতে থাকে। চকিতে চোখ যায় মোবাইলের স্ক্রিনে। আলো-আঁধারির মধ্যে দাদা লেখা অক্ষরগুলো অস্পষ্ট লাগে স্নেহার।