অবিশ্বাসী//জয়নারায়ণ সরকার
ভোরে উঠেই ট্রাকস্যুট, গেঞ্জি পরে আর পায়ে স্নিকার গলিয়ে বেরিয়ে পড়ে দীপ। এ অনেক দিনের অভ্যাস। পার্কের মাঠে গিয়ে হাজির হলেই গজেনদা প্রথমেই বলে ওঠেন, দাঁড়ানো চলবে না। চলো হাঁটা শুরু করি। কথা শেষ করার সাথে সাথেই শিবু, বাপন, হেমন্তরা হাঁটতে থাকে। দীপও ওদের সাথে সারা মাঠ চক্কর দিতে থাকে। কয়েক পাক দেওয়ার পর গজেনদাকে ঘিরে সবাই দাঁড়িয়ে পড়ে। দীপের তখন মনে হয় গজেনদাই যেন বাবা রামদেব। তারপর শুরু হয় প্রাণায়াম। সব শেষে লাফিং থেরাপি। হা হা হা হো হো হো। এই সময় দীপের প্রতিদিনই হাসি পায় আর গজেনদা কড়া চোখে তাকায় তার দিকে। শেষে পার্কের গেটের পাশে চায়ের দোকানে বড় ভাঁড়ে চা খেয়ে তবে বাড়ি ফেরা। সারা বছরই সকালে এক রুটিন।
বাড়ি ফিরেই বিপাশাকে ঘুম থেকে টেনে তোলে। সে কিছুতেই উঠতে চায় না। জড়ানো গলায় বলে, প্লিজ, দু’মিনিট পরে উঠছি। তবুও দীপ হাত ধরে টেনে তুলে দেয়। সে জানে ওই দু’মিনিট দু’ঘন্টা হয়ে যাবে। দীপ আর দাঁড়ায় না। বাথরুমে ঢুকে যায়। বিপাশাও ঘুম চোখে রান্নাঘরে ঢুকে পড়ে। দীপ অফিসে যাওয়ার জন্য তাড়াতাড়ি রেডি হয়। তাকে দশটার মেট্রো ধরতে হবে। এরমধ্যে বিপাশা ব্রেকফাস্ট টেবিলে দেয়। ব্রেকফাস্ট শেষ হলে ব্যাগ ঝুলিয়ে অফিসের পথে।
দীপ ও বিপাশা এই অঞ্চলে বেশিদিন আসেনি। যদিও দীপের দিদির বাড়ির পাশেই একটা ওয়ান রুম ফ্ল্যাট কিনেছে। সেই সময় দিদিই ঠিক করে দিয়েছিল। বিপাশার প্রথম প্রথম খুব মন খারাপ হত। সে তো বেশ সাজানো গোছানো শ্বশুরবাড়ি পেয়েছিল। তা দেখে তাদের আত্মীয়দের চোখ কপালে উঠেছিল। এক এক সময় ভাবে, মানুষ নিজেও জানে না পরের দিন কী হবে। সে আর পুরনো কথা ভেবে মন খারাপ করতে চায় না।
অফিস থেকে ফিরে দীপ বলল, জানো বিপাশা, আসার সময় মোড়ের মাথায় শিবুর সাথে দেখা হল। ও জানাল, গজেনদা খুব অসুস্থ। হাসপাতালে ভরতি।
জলের গ্লাস দিতে দিতে বিপাশা বলল, তাই নাকি!
গ্লাসটা হাতে নিয়ে বলল, এতদিন গজেনদাকে দেখছি। এই বয়সেও ওনার মতো মিশুকে আর হুল্লোড়বাজ খুব কম লোক আছে।
বিপাশা আর কথা বাড়ায় না। সে সন্ধের টিফিন তৈরি করতে রান্নাঘরে চলে যায়।
দীপ তড়িঘড়ি জামা-প্যান্ট বদলে বেরিয়ে যেতে যেতে বলে, গজেনদার খবরটা নিয়ে আসি।
বিপাশা শুধুমাত্র সম্মতিসূচক মাথা নাড়ে।
এদিকে রাত অনেক হওয়াতে বিপাশার চিন্তা বাড়ে। তাহলে গজেনদার কোনো অঘটন ঘটল? পরক্ষণেই মনকে সান্ত্বনা দেয়। কু-মন ভাল নয়।
বেশ রাত করেই ফিরল দীপ। ঘরে ঢুকেই বিপাশাকে বলল, খুব খিদে পেয়েছে। তাড়াতাড়ি খেতে দাও। বিপাশা রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতে বলল, আমার সব রেডি। হাত-পা ধুয়ে এসো।
রাতের খাওয়া শেষ করে বিছানায় গিয়ে বসল দীপ। হাতে মোবাইল নিয়ে মগ্ন। সব কাজ সেরে ঘরে এসে বিপাশা বলল, এবার ফোনটা রাখো। গজেনদা কেমন আছেন?
দীপ মোবাইলটা সুইচ অফ করে রেখে বিছানায় শুতে শুতে বলল, একটু ভাল।
বিপাশা বিস্তারিত শুনবে বলে তাকিয়ে দেখে দীপ ঘুমিয়ে পড়েছে।
পরদিন অফিসে জরুরি কাজের জন্য দীপ খুব সকালেই বেরিয়ে পড়ে। সেদিন বিকেলে ফোনে বিপাশাকে দীপ জানায় ফিরতে রাত হবে। সে রাত প্রায় বারোটার সময় ফেরে।
বিপাশা বলে, আজ এত দেরি হল?
দীপ বলল, আর বোলো না, অফিসে এখন খুব কাজের চাপ। আবার ওদিকে গজেনদার খবরটা জানতে গিয়েছিলাম।
বিপাশা বলে, জানো আজ সুমন্তদার বউ রমা বউদি এসেছিল। উনি চাকরি পেয়েছেন। প্রাইভেট ফার্ম। অফিসটা বলছিল ডালহৌসিতে। আমি ওনাকে বলেছি দীপের অফিসও ওই অঞ্চলে।
দীপ কথাগুলো না শুনে খাটে গিয়ে শুয়ে পড়ে।
বিপাশা আজকাল খেয়াল করে দেখেছে দীপ যতটুকু দরকার ততটুকুই কথা বলে। আগের মতো অফিসের গল্প করে না। আর কিছু বলতে গেলেই চিৎকারে বাড়ি মাথায় করে। একুশ বছরের বিবাহিত জীবনে ইদানিং দীপের পরিবর্তন চোখে পড়ছে বিপাশার। প্রথম প্রথম গুরুত্ব দেয়নি। তবে মনের ভেতরে বিষাদ গ্রাস করতে থাকে।
বিকেলে দোকানে কিছু জিনিস কিনতে গিয়ে গজেনদার সঙ্গে দেখা। বিপাশাকে দেখে বললেন, কেমন আছো? বিপাশা সাথে সাথে বলে, আপনার শরীর এখন কেমন আছে?
প্রশ্নটা শুনে অবাক চোখে তাকিয়ে গজেনদা বলে, আমি সব সময় ভাল থাকি। ব্যাচেলরদের ভাল থাকতে হয়। আজকাল মাঠেও আসে না দীপ।
বিপাশা বলে, অফিসে এখন খুব কাজের চাপ। ফিরতে অনেক রাত হয়। তাই সকালে উঠতে পারে না।
গজেনদা হেসে বলে, চলি। দীপকে বোলো দেখা করতে।
গজেনদাকে দেখে বিপাশার একবারও মনে হল না শরীর খারাপ। তবে দীপ কি মিথ্যে বলল! মনে তার নানা সন্দেহের উদ্রেক হতে থাকে। রমা বউদির কথাটা সেদিন এড়িয়ে গেল কেন! ওর অফিসেই জয়েন করেনি তো? ইদানিং খুব তাড়াতাড়ি অফিসের জন্য রওনা হয়। তবে কি! সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে কখন যে ফ্ল্যাটের সামনে এসে গেছে তা নিজেই বুঝতে পারেনি। ঘরে ঢুকে এক গ্লাস জল খায়।
তারপর টিভিটা অন করে রিয়ালিটি শো দেখতে দেখতে টুকটাক কাজ সেরে নেয়। কিছুক্ষণ পরে দীপ অফিস থেকে ফিরে আসে। এসেই হাত-পা ধুয়ে ঘরে ঢুকে যায়। বিপাশা টিফিন নিয়ে ঘরে ঢোকে। দেখে দীপ জামা-প্যান্ট পরে রেডি হচ্ছে। সে গজেনদার কথাটা বলতে যাবে। তখনই দীপ বলে, গজেনদার অবস্থা খুব খারাপ। এখন কিছু খাব না।
দেরি হয়ে যাবে। বলেই বেরিয়ে যায় দীপ। ওর চলে যাওয়ার পথের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। রাস্তার আলোগুলো বড্ড ঝাপসা লাগে বিপাশার। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর দীপের মুখটা ভেসে ওঠে চোখের সামনে। মনের ভেতর অবিশ্বাসের স্রোত বইতে থাকে। আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। এক দৌড়ে বিছানায় পড়ে অঝোরে কাঁদতে থাকে বিপাশা।