Joy Narayan Sarkar

আলোর রেখা // জয়নারায়ণ সরকার

সকালে ঘুম ভেঙে দেখে বিছানায় শ্রাবণী নেই। কখন যে উঠে গেছে টের পায়নি অম্লান। আবছা চোখে ঘড়ির দিকে দেখে সাড়ে ছটা। আজ তো সানডে। এত তাড়াতাড়ি উঠে কি হবে। আবার পাশ ফিরে শুয়ে পড়ে। শ্রাবণী চা নিয়ে ঘরে ঢুকেই বলে, ওঠো, অনেক বেলা হয়েছে। চা খেয়ে নাও, বাজার যেতে হবে। অম্লান এবার পাশবালিশটা জড়িয়ে নিয়ে উল্টোদিকে ঘোরে। শ্রাবণী পাশবালিশটা টেনে নেয় নিজের কাছে। অম্লান চোখ খুলে বলে, এত তাড়াতাড়ি উঠতে হবে!
শ্রাবণী এবার ধমকের সুরে বলে, উঠবে, না গায়ে জল ঢেলে দেব।

এবার হুড়মুড় করে উঠে পড়ে অম্লান। মনে পড়ে আগেও কয়েকবার জল ঢেলে দিয়েছিল শ্রাবণী। বিছানা থেকে উঠেই বাথরুমে চলে যায়। এদিকে শ্রাবণী হোম থিয়েটারে রবি ঠাকুরের গান একটু উঁচু ভল‍্যুমে বাজিয়ে দেয়।

অম্লান আর শ্রাবণী। দুজনের বিয়ে বছর দশ পার হয়ে গেছে। এখনও কোনও সন্তান হয়নি। অম্লান একটা বেসরকারি অফিসের অ্যাকাউন্ট‍্যান্ট আর শ্রাবণী নার্সারি স্কুলের ম‍্যাডাম। রোজ সকাল থেকেই দুজনের ব‍্যস্ততা তুঙ্গে থাকে। শুধুমাত্র ছুটিছাটা ছাড়া। এসব দিনেই ওরা একটু আয়েশ করে থাকতে চায়।

একটা বিস্কুট অম্লানের দিকে এগিয়ে দেয় শ্রাবণী। অম্লান সেটা নিয়ে কামড় দিয়ে বলে, বাজার থেকে কী কী আনতে হবে? লিস্ট করে দাও। এখন আর মনে থাকে না।
শ্রাবণী এবার গলায় মজা এনে বলে, তুমি তো মেধাবী বলেই জানতাম। বিয়ের সময় তোমাদের বাড়ি থেকে কত কথাই না বলেছে। এখন সব ফুস!
অম্লান বলে, তোমার পাল্লায় পড়েই তো সব শেষ হয়ে গেল।
শ্রাবণী সাথে সাথে বলে, ও যত দোষ নন্দ ঘোষ!

এবার দুজনেই হেসে ওঠে। চা খাওয়া শেষ করে বাজারে বেরোয় অম্লান। এই বাজার করাটাও একটা শিল্প। যেটা শিখিয়েছিল ঠাকুমা। রোজ সকালে তাঁর পেছন পেছন ছুটত সে। তখন বয়স আর কত হবে আট কি নয়। কোন মাছের সাথে কী কী তরকারি লাগে, কোন শাকে কি দিলে সুস্বাদু হয় বা কোন সিজিনে কোন সবজি পাওয়া যায়, সেসব তো ঠাকুমাই মনের মধ‍্যে গেঁথে দিয়েছিলেন। যা এখনও বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে সে। তবে আগে বড়ো ব‍্যাগ নিয়ে যেতে হত। আর এখন ছোটো ব‍্যাগেই হয়ে যায়। বাজারের মূল‍্যবৃদ্ধি ও সেইসাথে পরিরারও ছোট।

বর্ষাকালে ইলিশে ছেয়ে যেত বাজার। এখন আর সেরকম হয় না। সেদিন বাজারে গিয়ে প্রথমেই চোখ পড়ে ইলিশে। সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। দোকানি তার চেনা। ওকে দেখেই বলে, আজ কিন্তু ইলিশ দেব দাদা।
সে আমতা আমতা করে বলে , কত করে?

দোকানি ততক্ষণে একটা ইলিশ দাঁড়িপাল্লায় চাপিয়ে ফেলে বলে, আটশো টাকা কেজি। বেশি ওজন হবে না, ওই ন’শো-র মতো।
অম্লান চট করে হিসেব করে ঢোক গিলে বলে, না না, রুই কাটা দাও আড়াইশো।
বাড়ি ফিরে ধপাস করে ব‍্যাগ রেখে বলে, আর খেতে হবে না। বাজারে যেন আগুন লেগেছে।
শ্রাবণী শুধু মুচকি হেসে বলে, মধ‍্যবিত্তের আট হাত কাপড়।

***
এক সময় বিলাসিতায় দিন কেটেছে। কী কারণে যে এমন হাল হল আজও বুঝতে পারে না অম্লান। তবে চরম সিদ্ধান্ত নিতেই হয়েছিল। বেড়ে ওঠা সেই জায়গা ছেড়ে এসে নতুন ঠিকানায়, নতুনভাবে শুরু।
অফিস আর বাড়ি করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়ে অম্লান। তার বই পড়ার অভ‍্যেস ছিল। আজকাল পড়ার মধ্যে শুধুমাত্র খবরের কাগজটাই আছে। অনেক খবরের মাঝে হারিয়ে যেতে বেশ লাগে।

শ্রাবণী সকালের চা ও টিফিন গুছিয়ে দিয়ে কখন বেরিয়ে গেছে। অম্লান ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ধড়মড় করে উঠে চা গরম করে খায়। তারপর ঝটপট স্নান করে তৈরি হতে হতে কোনোরকমে খেয়ে নেয়। ব‍্যাগে টিফিন নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। বাসস্ট‍্যান্ডে এসে দেখে কোনো বাস নেই। আজ অফিসে গিয়ে প্রথমেই শনিবারের না মেলা হিসেবটা ক্লিয়ার করতে হবে। হাজার পঞ্চাশ টাকার গড়মিল। এসব নিয়ে উতলা হয়। কিন্তু বাস আসছে না দেখে টেনশন বাড়তে থাকে। দেরি হলেই বড়বাবু মুখ বেঁকিয়ে কথা শোনাবে। টেনশনটা যেন আরও বেড়ে গেল। এবার অন‍্য কিছু করে যাওয়ার কথা ভাবছে অম্লান। একটা স্করপিও ওর সামনে এসে দাঁড়ায়। ও যেন হাতে চাঁদ পেয়েছে। সাথে সাথে বলে, দাদা, ডালহৌসি যাবেন?

গাড়ির পেছন সিট থেকে কে যেন বলে, উঠে পড়।
সে আর কোনোদিকে না দেখে দরজা খুলে পেছন সিটে বসে পড়ে। যাক বাবা, আজ একটু বেশি খরচ হবে, কিন্তু কথা শুনতে হবে না। ভেবে একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে। পাশে থাকা লোকটির দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে যায়। নিজে যেন ঘোরের মধ‍্যে রয়েছে মনে হয়।
পাশ বসা লোকটি বলে, কী রে, চিনতে পারছিস?
অম্লানের কথা জড়িয়ে যায়। বলে, আরে সুদীপ! তুই।

ছোটবেলার অভিন্ন হৃদয়ের দুই বন্ধু। কত বছর পর দেখা হল হিসেব মেলাতে পারে না অম্লান।
সুদীপ বলে, বাসস্ট‍্যান্ডের কাছে আসতে তোকে দেখলাম। তাই ড্রাইভারকে বললাম দাঁড়াতে।
অম্লান ঘোর কাটিয়ে বলতে থাকে, মাসিমা-মেসোমশায় কেমন আছেন? এখনও মাঠে খেলা হয়? ক্লাবটা কারা চালায়? অম্লানের আর প্রশ্নের শেষ হয় না। মুচকি মুচকি হাসে সুদীপ। নেমে যাওয়ার আগে সুদীপ বলে, একদিন বাড়িতে আসিস। নিজেই সব উত্তর পেয়ে যাবি।

গন্তব‍্য এসে যাওয়ায় অম্লান নেমে পড়ে। ও যেন এখনও ঘোরের মধ‍্যে আছে। ঘোর কাটিয়ে ভাবে, সুদীপ এখন বেশ বড়লোক। সে হাবেভাবে বুঝিয়েও দিয়েছে। ওদের অবস্থা তেমন ভাল ছিল না কোনওকালেই। অম্লানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হওয়ায় বাড়িতে আসা-যাওয়া লেগেই থাকত। তাদের বাড়িতে খাওয়াদাওয়া করত মাঝেমধ‍্যে। বৃষ্টি হলেই ওর ঘরে জল পড়ত। তাই অম্লানের ঘর ছিল ওর থাকার জায়গা। এরকম কত কথা উসকে উঠছে ভেতরে ভেতরে। অফিসে পৌঁছেও ঘোর কাটতে চায় না অম্লানের।

***
একটা ছুটির দিনে শ্রাবণীকে কোনও কিছু না বলে সে চলে আসে ফেলে আসা সময়ের কাছে। ট্রেন থেকে নেমেই একটা টোটো করে মোড়ের মাথায় নামে। নেমেই বাঁদিকে তাকিয়ে দেখে চায়ের দোকানটা এখন পাকা বিল্ডিং। এগিয়ে গিয়ে এক দাগ চা দিতে বললেই দোকানি ঠিক চিনতে পেরে বলে, অম্লান কেমন আছ? বহুদিন পরে এলে।

চা খাওয়া শেষ করে নিজের পাড়ায় ঢুকতে গিয়েই মনটা বিষাদে ভরে ওঠে অম্লানের। এইখানেই তো বড় একটা কৃষ্ণচূড়া গাছ ছিল। বৈশাখ মাসে লাল ফুলে ভরতি হয়ে থাকত। কী অপূর্ব তার দৃশ‍্য। তার পাশেই ছিল চৌধুরীদের দুর্গামণ্ডপ। সেখানে বিরাট বিরাট বিল্ডিং উঠেছে। একমাত্র অনেক স্মৃতি জড়িয়ে নিয়ে আছে একটুকরো মাঠটা। রাস্তাগুলো এখন কংক্রিটের, বড্ড রুক্ষ। সেই রাস্তা ধরে এঁকেবেঁকে পৌঁছয় সুদীপের বাড়িতে। ওটা আর এখনটালির নয়, পাকা দোতলা।

বেল বাজাতেই দরজা খোলে সুদীপ। বেশ আন্তরিকতা মিশিয়ে ভেতরে ডাকে। ফ্লোর মার্বেলের। একটা বুলডগ এসে অম্লানের গা শুঁকতে থাকে। সুদীপ কুকুরটাকে সরিয়ে নেয়। এরপর অম্লান বলে, মাসিমা-মেসোমশায় কোথায়? সুদীপ বলে, ওঁনারা পুরী গেছেন বেড়াতে। এরপরই সুদীপের স্ত্রী বৈশাখী সামনের টেবিলে চা রেখে বলে, শ্রাবণী আসেনি? এর পর ওকে না আনলে আপনারও নো-এন্ট্রি। বলেই হেসে অন‍্য রান্নাঘরের দিকে চলে যায়।

সুদীপ বলে, দুপুরে খেয়ে তবে যাবি। অম্লান মাথা নেড়ে বলে, না না, শ্রাবণীকে কিছু বলে আসিনি। পরে একদিন এসে খেয়ে যাব।
সুদীপ এবার তার কষ্টসাধ্য উত্থানের গল্প শোনায়। অম্লান যেন রূপকথার গল্প শুনছে। বুকটাও ভরে ওঠে। সুদীপ তো কোনোদিনই পড়াশোনায় ভাল ছিল না। মাঝপথেই সব ছেড়ে দিয়ে কোথায় একটা কাজ করত। তাতে ওদের সংসারটা চলত। এসব ভাবতেই গা-টা গুলিয়ে ওঠে। সে উঠে পড়ে বলে, আজ চলি। পরে একদিন এসে খেয়ে যাব।
সুদীপ দরজা অবধি এগিয়ে দেয়।

***
পরদিন অফিস যেতেই রিজিওনাল ম‍্যানেজার শশধর গাঙ্গুলি ডেকে পাঠায়। অম্লান শশব‍্যস্ত হয়ে তার চেম্বারে ঢোকে। মনে মনে ভাবে বরোদার হেড অফিস থেকে নিশ্চয়ই কোনও মেইল এসেছে। এমনিতে উনি খুব একটা ডাকেন না।
শশধরবাবু বলেন, বসুন মিস্টার বোস। তারপর চোখের পলক না ফেলে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলেন, হিসেবটা কি মেলাতে পারলেন?

অম্লানের ঘাম ঝরতে থাকে। তারপর আস্তে আস্তে ঘাড় নেড়ে বলে, না।
এবার উনি হেসে বলেন, অত ঘাবড়াচ্ছেন কেন? কিছু একটা করে মিলিয়ে দিন। আমি সই করে দেব।
একথা শুনে অম্লান আস্তে আস্তে ঘাড় নাড়ে। সাথে সাথে অন্য ভাবনা মাথায় খেলতে থাকে। অডিটের সময় যদি ধরা পড়ে। ভেতরে ভেতরে ঝড় বইতে থাকে।

ওর চোখ-মুখের অবস্থা দেখে শশধরবাবু বলেন, আচ্ছা আপনি এত ভাবেন কেন? যা বললাম, তাই করুন। আর শুনুন আজকে ব্লুচিপ হোটেলের একটা রুম বুক করবেন। আমার গেস্ট আসবে।
ঠিক আছে স‍্যার। বলে অম্লান বেরিয়ে এসে নিজের চেয়ারে বসে। আবার মোবাইল ফোনটা বেজে ওঠে। ওপাশ থেকে শশধরবাবুর গলা শুনতে পায়, আমাকে পঞ্চাশ হাজারের মতো ক‍্যাশ দিয়ে যাবেন। পরে হিসেবটা দিয়ে দেব। অম্লানের গলা দিয়ে আর কোনো কথা বেরোয় না,আচ্ছা বলে ফোন ছেড়ে দেয়।

এরপর কাজে মন দেয়। কিন্তু কিছুতেই মন বসাতে পারছে না। বার বার ওই পঞ্চাশ হাজারের কথা মাথায় ধাক্কা মারছে। এরই মধ‍্যে অন-লাইনে ব্লুচিপ হোটেলের একটা সুইটও বুক করেছে সারা রাতের জন‍্য। আপাতত খাতায় লিখে রেখেছে মিসনেলিয়াস এক্সপেন্স।

অফিস ছুটি হতে আর মিনিট পাঁচেক বাকি। সে টেবিলে রাখা দরকারি কাগজপত্র ড্রয়ারে রাখে। কম্পিউটার সাটডাউন করতে করতে ফোনে রিং হয়। তুলে দেখে শশধরবাবু। ওপাশ থেকে কিছু একটা বলার পর ব‍্যস্ত হয়ে পড়ে অম্লান। সে তড়িঘড়ি বেরিয়ে পড়ে অফিস থেকে। প্রথমেই শ্রাবণীকে ফোন করে জানিয়ে দেয় ফিরতে রাত হবে।

ব্লুচিপ হোটেলে গিয়ে সুইটটা দেখে নেয়। ঘর থেকে রাতের শহরটা মায়াবী মনে হয় তার। আর মনে মনে ভাবে, ইস, এমন একটা ঘরে শ্রাবণীকে নিয়ে যদি রাত কাটাতে পারতাম। সে ভাবনার অতলে তলিয়ে যায়। হঠাৎই ঘরের এন্টারকম বেজে ওঠে। অম্লান ধরে আবেশ জড়ানো গলায় বলে, হ‍্যালো। ওপাশ থেকে বলে, স‍্যার, আপনার গেস্ট এসে গেছেন। ওনাকে কি সুইটে পাঠিয়ে দেব।

অম্লান দ্রুত বলে, না না, ওখানেই থাকতে বলুন। আমি আসছি।
সে আর দাঁড়ায় না। ঘর থেকে বেরিয়ে লিফটে নামতে থাকে। নেমেই রিসেপশনে যায়। সুবেশী রিসেপসনিস্ট উল্টোদিকে সোফায় বসা এক মহিলাকে দেখায়। উনিই আজকের গেস্ট। ভাল ভাবে তাকিয়ে দেখে সুদীপের স্ত্রী বৈশাখী বসে। সে হতভম্ব হয়ে যায়। সে আর এগোয় না। ফোনটা বেজে ওঠে। মোবাইলের স্ক্রিনে ভেসে উঠেছে এস.জি। ফোনটা ধরে না। মুহূর্তের মধ‍্যে হোটেল থেকে বেরিয়ে পড়ে অম্লান।

চারিদিকে যেন অমাবস‍্যার মিশমিশে অন্ধকার, তার মধ‍্যে ল‍্যাম্পপোস্টের আলোগুলো যেন দিশা দেখাচ্ছে। ওই আলোর রেখা ধরে ঊর্ধ্বশ্বাসে হাঁটতে থাকে অম্লান…

# শেষ #

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *