Goutam Acharya

পঁচিশ নক্ষত্রের সমাবেশ – তৈমুর খান

হৃদয়ের কথা’ ক্ষুদ্র একটা লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশনী থেকে ২৫ জন কবির ৭৫ টি কবিতা নিয়ে ‘একই মলাটে’ (২০২১) নামে একটি কবিতা সংকলন প্রকাশ করেছে। ঝরঝরে রুচিপূর্ণ মনোগ্রাহী সংকলনটি হাতে নিলে একটি আন্তরিকতার স্পর্শ উপলব্ধি করা যায়। সংকলনটি সম্পাদনা করেছেন গৌতম আচার্য এবং ঈশানী রায়চৌধুরী। প্রচ্ছদ ও অলংকরণ করেছেন অসীম মুরশেদ। সব আয়োজনের মধ্যেই অনাড়ম্বর সহজ-সরল এক আবেদন মুগ্ধ করে।

২৫ জন কবির ভিড়েও সেই মুখগুলি হারিয়ে যায় না যাঁরা আগামী দিনে বাংলা সাহিত্যের প্রবাহকে শতধারায় উজ্জীবন দান করার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। যাঁদের কবিতা পড়ার খুব একটা সুযোগ হয়নি অথবা নেহাত তরুণ-তরুণী নিজেকে প্রকাশ করার পথ খুঁজেছেন। এই সংকলনে তাদের উপস্থিতিই আমাকে আকৃষ্ট করেছে। সংকলন খুলেই প্রথম যাঁর কবিতার স্তবকের দিকে মুগ্ধ-বিস্ময়ে তাকিয়েছি দেখুন সেই স্তবকটি:

“তোমার হাসির সামনে সব নদী হাঁটু গেড়ে বসে
তোমার মিষ্টি স্বরধ্বনির সামনে সব পাখিরা সুর মেলায়, আমি তোমাকে বারবার লিখি,আমার
পেন দিয়ে আঁকিবুকি করে কাটি আর লিখি!”
‘নদী’ ও ‘পাখি’ ‘হাসি’ ও ‘স্বরধ্বনি’কে যেভাবে মেলায় তা যেমন প্রকৃতিগত, তেমনি আমাদের চেতনার এক গভীর সামঞ্জস্যে আবহমান ক্রিয়ায় সন্নিবেশিত হয়। আর এই অনন্ত ক্রিয়াব্যঞ্জনকে একটি মাত্র শব্দ ‘লিখি’ দ্বারা আত্মগত করা যায়। ‘আমার পেন দিয়ে আঁকিবুকি করে কাটি আর লিখি’ অর্থাৎ ‘আমার পেন’ যা আত্মচেতনার উপলব্ধি স্বয়ংক্রিয়ভাবে আঁকি-বুকির চিত্রকল্পে নিষিক্ত হয়। এই কবির নাম মহুয়া কুণ্ডু। এই সংকলনের সম্পাদকদ্বয় যেন তাঁকে আবিষ্কার করেছেন। ইংরেজি কথাসাহিত্যের বিখ্যাত লেখক অক্টাভিয়া ই বাটলার বলেছিলেন:

‘Every story I create, creates me. I write to create myself.’ (Octavia E. Butler) অর্থাৎ আমার তৈরি প্রতিটি গল্প আমাকে সৃষ্টি করে। আমি নিজেকে তৈরি করতে লিখি। এই কবিও নিজেকে তৈরি করেছেন। তাঁর আঁকিবুকি কাটা নিজেকে তৈরি করার জন্যই।
কাল মহাকালের সম্মেলনে আমাদের জাগতিক বোধ কিছু মুহূর্ত নিরীক্ষণ করে। কবিরা সেই বোধের ভাষাকেই শব্দে-চিত্রে উপলব্ধির স্পেসে তুলে আনেন। এরকমই কিছু পংক্তি বারবার আমাদের অনুভূতিতে করাঘাত করে।
১) রূপক চট্টোপাধ্যায়:
‘মোমবাতি গলে পুড়ে যেতে যেতে
নিভে পড়ে আছে হরপ্পা লিপি।’
২) প্রদীপ ঘোষ:
‘মাটির ভিতরে কেউ গাইছে
গান, অনেক জনমোহিনী রূপকথা’
৩) পার্থপ্রতিম বিশ্বাস:
‘শেষ আয়ু চিনে যায় আকাশের জলকণা
রাত্রির বিদায়। পুড়ে যায় হিমঘুম মৈনাক পাহাড়
শুধু দূরে সারাদিন বয়ে যায় পিয়ালের নদীচর অপূর্ণ বেলায়’
৪) নাসির ওয়াদেন:
‘বুক ছুঁয়ে ঝরে যাওয়া বিষণ্নতার কোমল স্বাদে বিভোরে
সুখি ঝড় এসে থেমে যায় বারান্দায়, নীচের করিডোরে’
৫) তাপস মুখোপাধ্যায়:
‘কোনো বিকেলের পড়ন্ত রোদে হয়তো
মন ভালো করা গানের সুর
স্পর্শ করেছিল আমায়’
৬) গৌতম আচার্য:
‘হাতে আমার এক খণ্ড জ্বলন্ত মোমবাতি।
আমার চোখের সেই রঙিন স্বপ্নগুলো
ঢেকে গেছে কুয়াশা ভরা আকাশ।’
৭) ঈশানী রায়চৌধুরী:
‘শালপ্রাংশু বট আজ নিরাপদে শেকড় চালায়…
চেয়ে থাকে তেলছবি, গোপনে কি ডাকে আয় আয়’
৮) অসীম মুরশেদ:
‘বুকের ভিতর ফুটছে ভিসুভিয়াস,
শরীর জুড়ে গোলাপি রঙের আভা।’
অনেক ভালো লাগা কবিতা সংকলনে আছে। প্রেমের উচ্চারণগুলি কখনও ঘনিষ্ঠ হয়ে উষ্ণতা বিকিরণ করেছে। কখনও রোদ্দুরের মতো শুভ্র শরতের আকাশে মেলে দিয়েছে পাখা। পুলক রায় লিখেছেন ‘জীবন কত রসিকতাই না জানে!’ মানবিক আকাশ খুঁজতে খুঁজতে কবির মনেও এই উপলব্ধি আমাদের সচকিত করে। পূর্বা দাস লিখেছেন ‘মৃত্যু—কিছুটা বিলাসিতা/ কিছু উপহার; আবেগ মেশা/ দুর্দম রক্তস্রোত ধমনীতে যতক্ষণ/ মৃত্যু—বড় বিমোহন’ আমাদের তখন মনে পড়ে যায় মৃত্যুর দিকে ঝুঁকে যাওয়া আত্মোপলব্ধির সিলভিয়া প্লাথের সেই কবিতাকে:’I took a deep breath and listened to the old brag of my heart. I am, I am, I am.’
(Sylvia Plath, The Bell Jar)
অর্থাৎ আমি একটি গভীর শ্বাস নিলাম এবং আমার হৃদয়ের পুরোনো বড়াই শুনলাম। আমি আছি, আমি আছি, আমি আছি। এই থাকাটাই পূর্ব দাসের কাছে ‘বিমোহন’ শব্দে রূপ পেয়েছে।
প্রতাপ নন্দীর ‘এ দহন দেহের অহংকার’, মায়া রায়ের ‘কিছু রাত থাকে স্বপ্নের/ কিছু রাত থাকে বেদনার’, মালা চক্রবর্তীর ‘আছে সন্তাপ বুকের মাঝেতে/ মুখেতে ভাসাই হাসি’, সুমিতা চৌধুরীর ‘বিভীষিকাময় উৎসব আজ’ প্রভৃতি কবিতার পংক্তিগুলি আত্মচেতনা থেকে সময়ের বাস্তবতায় গভীর তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে। সংকলনের ২৮ পৃষ্ঠায় ‘আয়নার সামনে মুখ দেখা যায় না আর’ কবিতার প্রথম পঙক্তিতেই একটা শব্দের ভুল ব্যবহার হয়েছে তা বোঝাই যায়। লেখা হয়েছে: ‘গার্হস্থ্য বিষাদগুলি আমার একান্ত নিরিবিলি থেমে যায়’ আসলে ওই পঙক্তিটি হবে ‘গার্হস্থ্য বিষাদগুলি আমার একান্ত নিরিবিলি খেয়ে যায়’। ‘থেমে’ শব্দটির স্থলে ‘খেয়ে’ হবে। একটি শব্দের জন্যই কবিতাটি পড়তে গিয়ে হোঁচট খেতে হয়। তবে আশা করি সংকলটি সকলের কাছেই আদরনীয় হবে।

একই মলাটে: সম্পাদনা গৌতম আচার্য ও ঈশানি রায়চৌধুরী, হৃদয়ের কথা প্রকাশনী, গণেশ অ্যাপার্টমেন্ট, দ্বিতীয় তল, বাগুইহাটি, জর্দা বাগান, কলকাতা-৭০০১৫৯
মূল্য: ১৫০ টাকা।

[jetpack_subscription_form show_subscribers_total=”false” button_on_newline=”false” custom_background_button_color=”#bf14df” custom_font_size=”16px” custom_border_radius=”0″ custom_border_weight=”1″ custom_border_color=”#bf14df” custom_padding=”15″ custom_spacing=”10″ submit_button_classes=”” email_field_classes=”” show_only_email_and_button=”true” success_message=”Success! An email was just sent to confirm your subscription. Please find the email now and click 'Confirm Follow' to start subscribing.”]






Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *