
প্রবন্ধ
ফ্রান্ৎস কাফকা
শংকর ব্রহ্ম
[ দ্বাদশ পর্বে সমাপ্ত ]
প্রথম_পর্ব
১৮৮৩ সালে ৩ জুলাই তৎকালীন অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি সাম্রাজ্যের প্রাহা (প্রাগ) শহরে (বর্তমানে চেক প্রজাতন্ত্রের রাজধানী) একটি মধ্যবিত্ত জার্মানভাষী পরিবারে ফ্রান্ৎস কাফকার জন্ম হয়। তাঁর বাবার নাম হারমেইন কাফকা এবং মায়ের নাম জুলি৷
ফ্রান্ৎস কাফকার প্রাথমিক পড়াশুনা শুরু হয় ডয়েশ ন্যাবেন্সচুল জার্মান বয়েজ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে (Deutsche Knabenschule German boys’ elementary school) ৷ তিনি ১৮৮৯ থেকে ১৮৯৩ সাল পর্যন্ত এই বিদ্যালয়ে পড়েছিলেন৷ তেরো বছর বয়সে তাঁর ইহুদি শিক্ষা সম্পন্ন হয়৷ কাফকা উপসনা গৃহে যেতে পছন্দ করতেন না বরং বাবার সঙ্গে ঘুরতে যাওয়ায় তিনি বেশি আনন্দ পেতেন৷ জার্মান ভাষায় পড়াশোনা করলেও চেক (Czech) ভাষায় তিনি কথা বলতে এবং লিখতে পারতেন৷
কাফকা আট বছর ধরে জিমনেসিয়ামে পড়াশোনা করেছিলেন। ১৯০১ সালে তিনি মাতুরা (Matura) পরীক্ষায় পাশ করে কার্ল- ফার্ডিনান্দস-ইউনিভার্সিটিতে (Karl-Ferdinands-University) ভর্তি হন৷ এই বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি রসায়ন নিয়ে পড়া শুরু করলেও দু সপ্তাহের মধ্যে বিষয় বদলে আইন নিয়ে পড়া শুরু করেন৷ যদিও আইন নিয়ে পড়তেও তিনি বিশেষ উৎসাহিত ছিলেন না তবুও তাঁর বাবার খুশির জন্য তিনি পড়া চালিয়ে যেতে থাকেন৷ এর পাশাপাশি তিনি জার্মান ভাষা এবং সাহিত্য ও ইতিহাস পড়তে থাকেন। কাফকা বরাবরই আগ্রহী পাঠক ছিলেন।
তিনি এবং তাঁর বন্ধু ব্রড এক সঙ্গে মূল গ্রীক ভাষায় প্লেটোর ‘প্রোটাগোরাস‘(Protagoras) থেকে শুরু করে গুস্তাব ফ্লবেয়ারের ‘সেন্টিমেন্টাল এডুকেশন’ (Sentimental Education)পর্যন্ত পড়েছেন, আলোচনা করেছেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা।
ফ্রান্ৎস কাফকার কর্মজীবন শুরু হয় ১৯০৭ সালের ১ নভেম্বর। তিনি আশিকুরাজিওনি জেনারেলির একটি বীমা সংস্থায় প্রায় একবছর কাজ করেছিলেন৷ কাফকা এই কাজে খুশি ছিলেন না কারণ দিনের বেশীর ভাগ সময়ে কর্মক্ষেত্রে থাকার জন্য নিজের সাহিত্য চর্চায় বাধা পড়ছিল৷ ১৯০৮ সালের ১৫ জুলাই তিনি কাজ থেকে ইস্তফা দেন। এরপর তিনি চাকরি নিলেন শ্রমিকদের দুর্ঘটনা সংক্রান্ত একটি বীমা সংস্থায়। দিনে ছয় ঘন্টার কাজ, সঙ্গে চালিয়ে গেলেন লেখালেখি।
ফ্রান্ৎস কাফকা ছিলেন একজন জার্মানভাষী উপন্যাস ও ছোটগল্প লেখক। তিনি বিংশ শতাব্দীর সর্বাধিক প্রভাবশালী লেখক এবং সমালোচক হিসেবে খ্যাত ছিলেন৷ কাফকা মূলত জার্মান ভাষায় সাহিত্য রচনা করলেও চেক ভাষায় মাইলেনা জেসেনস্ককে তিনি কয়েকটি চিঠি লিখেছিলেন, যার সাহিত্যমূল্য অপরিসীম। জীবদ্দশায় তাঁর সাহিত্যকীর্তির যা সামান্য কিছু প্রকাশিত হয়েছিল তা জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
কাফকা এমন একজন সাহিত্যিক যিনি তাঁর পূর্ণ দৈর্ঘ্যের কোনও উপন্যাসই শেষ করেননি এবং প্রায় তাঁর প্রায় নব্বই শতাংশ কাজই তিনি পুড়িয়ে দিয়েছিলেন৷ ১৯০৮ সালে প্রকাশিত হয় কাফকার প্রথম বই ৷ এতে আটটি গল্প ছিল যা Betrachtung নামে সাহিত্য জার্নাল Hyperion এর প্রথম সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল।
১৯১২ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর লেখা ‘Das Urteil’ – এই গল্পের ভিত্তি নির্মাণ হয়েছে বাবা আর ছেলের সম্পর্কের টানাপোড়নের বুননে। ১৯১৫ সালে জার্মানির লিপজিগ থেকে প্রকাশিত হয় কাফকার সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্যকর্ম দ্য মেটামরফসিস(‘The Metamorphosis’)। এরপর একে একে প্রকাশিত হয়েছে ‘ইন দি পেনাল কলোনি'(In the Penal Colony), ‘আ হাঙ্গার আর্টিস্ট’(A Hunger Artist) এর মতো কালজয়ী সব সাহিত্যকর্ম।
কিন্তু তাঁর শারীরিক অসুস্থতা(যক্ষা-রোগ) তাঁকে ক্রমশ দুর্বল করে দিচ্ছিল। তাঁর গলার অবস্থা এতই খারাপ ছিল যে তিনি ভালো করে খেতেও পারতেন না৷ অনাহারে তাঁর শরীরে পুষ্টির মান কমে যায় ৷ কাফকা মৃত্যু শয্যাতে শুয়েও ” A Hunger Artist ” গল্পটি সম্পাদনা করেছিলেন৷
১৯২৪ সালের ৩ জুন মাত্র একচল্লিশ বছর বয়সে কাফকার মৃত্যু হয়।
জীবদ্দশায় তিনি তেমন ভাবে খ্যাতি পান নি৷ মৃত্যুর পর তিনি দ্রুত খ্যাতি অর্জন করেন৷
একত্রিশ বছর বয়সে ১৯১৪ সালে কাফকা ‘ডের প্রসেস ‘ উপন্যাস লেখা শুরু করেছিলেন। এই উপন্যাসটিও তিনি শেষ করতে পারেননি কিংবা বলা ভালো শেষ করেননি৷
আবার ১৯২১ সালে তিনি উপন্যাস লেখা শুরু করেন আটত্রিশ বছর বযসে ৷ তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘ডের হেইজার’ অসম্পূর্ণ।
তাঁর প্রথম আটটি গল্প সাহিত্যের সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়েছিল। কাফকা একশোটির বেশী চিঠি তাঁর আত্মীয় স্বজন পরিচিত বন্ধুদের লিখেছিলেন ৷ মিলেনা নামের এক সাংবাদিকের প্রেমে পড়ে কাফকা লিখেছেন শয়ে শয়ে চিঠি। মিলেনাকে লেখা কাফকার চিঠিগুলো নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে কাফকার অন্যতম সর্বাধিক বিক্রিত বই ‘Letters to Milena।
সাহিত্যে উইলিয়াম শেক্সপিয়ার এর পর যাকে নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনা হয়েছে তিনি আর কেউ নন, জার্মান ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রভাবশালী লেখক ফ্রানৎস কাফকা।
কবি W. H. Auden কাফকাকে বিংশ শতকের দান্তে বলে অভিহিত করেছেন ৷ ১৯১৬ সালের প্রথম দিকে বার্লিনার বিট্রিজে অস্কার ওয়ালজেলের “ডাই ভার্ভান্ডলং” এবং “ডের হেইজার” এর পর্যালোচনাতে কাফকার স্টাইলটি ক্লেইস্টের সাথে তুলনা করা হয়। কাফকার গদ্যের প্রকৃতি বিভিন্ন বর্ণনার ব্যাখ্যা দেয় ; তাঁর লেখা বিভিন্ন বিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে স্থান পেয়েছে । কাফকার লেখাকে কেউ কেউ অভিযোগ এনেছেন বাস্তবতা বিকৃত করার আবার অন্যরা দাবী করেছেন যে তিনি পুঁজিবাদের সমালোচনা করছেন। তাঁর কাজগুলির মধ্যে সাধারণ হতাশা ও অযৌক্তিকতা অস্তিত্ববাদের প্রতীক হিসাবে দেখা হয়৷ ১৯৬১ সালে ম্যালকম পাসলি অক্সফোর্ড বোডলিয়ান লাইব্রেরির জন্য কাফকার বেশিরভাগ হাতে লেখা পান্ডুলিপি সংগ্রহ করেছিলেন ।
১৯৯০ এর দশক থেকে বিশ্বজুড়ে গড়ে প্রতি ১০ দিনে একটি করে বই প্রকাশিত হয়েছে, কাফকার সম্পর্কে। এখন পর্যন্ত নোবেল পাওয়া চৌত্রিশ জন নোবেলজয়ী সাহিত্যিক তাদের মধ্যে কাফকার লেখার প্রভাব রয়েছে বলে স্বীকার করেছেন।
কলম্বিয়ার নোবেলজয়ী সাহিত্যিক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস একবার তার দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেনঃ-
” আমি যখন কলেজে ভর্তি হই, সাহিত্যের সাধারণ পড়াশোনা আমার ভালোরকমই ছিল, আমাদের বন্ধুদের চেয়ে গড়পরতা অনেক বেশি। বোগোতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে আমার নতুন নতুন বন্ধু তৈরী হতে থাকে, যারা আমাকে সমকালীন লেখকদের সঙ্গে পরিচিত করানো শুরু করে। এক রাতে এক বন্ধু আমাকে ফ্রানৎস কাফকার ছোটগল্পের একটি বই ধার দেয়। আমি যে মেসে থাকতাম, সেখানে যাই, আর সে রাতেই কাফকার ‘রূপান্তর’ গল্পটি পড়া শুরু করি। প্রথম লাইনটা পড়ামাত্র আমার প্রায় বিছানা থেকে পড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। কী যে অবাক হই আমি।
প্রথম লাইনটা ছিলঃ- ‘এক ভোরে গ্রেগর সামসা অসুখী সব স্বপ্ন থেকে জেগে উঠে দেখে সে তার বিছানায় প্রকাণ্ড এক পোকায় রূপান্তরিত হয়ে পড়ে আছে …।’ আমি লাইনটা নিজেকে নিজে পড়ে শোনাতে লাগলাম, ভাবলাম , এভাবে যে কেউ লিখতে পারে তা-ই তো আমার জানা ছিল না। যদি জানতাম, তাহলে আমি নিশ্চয় আরও কত আগেই লেখালেখি শুরু করতাম। তারপরই, আর দেরি না করেই, আমি ছোটগল্প লেখা শুরু করলাম।
এরপরই… আমার সাহিত্যে পদচারণার শুরু।”
কাফকা যক্ষা রোগে ভুগছিলেন ৷ কিছুতেই সুস্থ হচ্ছেন না দেখে তিনি অর্ধ সমাপ্ত পান্ডুলিপিগুলো পুড়িয়ে ফেলেন আর পরম বন্ধু ব্রডকে চিঠি লিখে জানান “Dearest Max, my last request: Everything I leave behind me … in the way of diaries, manuscripts, letters (my own and others’)। বন্ধুকে বলেছিলেন তাঁর অসমাপ্ত কাজগুলো যাতে পুড়িয়ে ফেলা হয়৷ তিনি কাফকার অনুরোধ রাখেননি।
১৯২৫ থেকে ১৯৩৫ সালের মধ্যে তিনি কাফকার সাহিত্য কীর্তিগুলো প্রকাশ করেছিলেন৷ প্রকাশিত হয় কাফকার বিখ্যাত উপন্যাস ‘The Trial’, এছাড়াও তাঁর চিঠি-পত্রের সংকলন, অসম্পূর্ণ উপন্যাসও প্রকাশের ব্যবস্থা করেন তিনি। সাহিত্যের এক নতুন ধারা তিনি এনে দিয়েছিলেন যেটি ‘Kafkaesque’ নামে পরিচিত।
যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়ে ক্ষণে ক্ষণে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে রোগা আর ছিমছাম গড়নের এক ব্যক্তি। অন্তিম এক মূহুর্তে তার জীবনের সব কাজ পুড়িয়ে দেওয়ার অদ্ভুতুড়ে এক অনুরোধ করে গেলেন প্রিয় বন্ধুকে। শুধু বন্ধুকে অনুরোধ করেই ক্ষান্ত হননি, হাতের আশেপাশে থাকা নিজের কাজের একটা বড় অংশ নিজেই পুড়িয়ে দিয়েছেন। শরীরে শক্তি ছিলো না আর পাণ্ডুলিপিগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিলো বলে সব পুড়িয়ে দিতে যেতে পারেননি। তাই বন্ধুকেই অনুরোধ করে গেলেন বাকী কাজটুকু সমাধা করার জন্য।
বন্ধু ম্যাক্স ব্রড বরং যত্ন করে সেই লেখাকে প্রকাশ করে দিলেন। পাণ্ডুলিপিতে অক্ষরের বেড়াজাল থেকে বের করে আনলেন পৃথিবীর ইতিহাসের অন্যতম বিখ্যাত এক উপন্যাস ‘The Trial’ কে। ধরাধাম ছেড়ে চলে যাবার অনেক পরে পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম প্রভাবশালী লেখক হিসেবে জায়গা করে নিলেন ফ্রান্ৎস কাফকা। তার উপন্যাসে, ছোটগল্পে প্রভাবিত হয়ে সাহিত্য রচনা শুরু করলেন শত শত লেখক। নিজের অজান্তেই জন্ম দিয়ে গেলেন ‘Kafkaesque’ বলে নতুন এক ধারার।
উনিশ শতকের শেষ ভাগে জন্ম হয়েছিলো কাফকার। ইউরোপে তখন শিল্পায়নের ছোঁয়া লাগছে একটু একটু করে। চারপাশে হাজারও সমস্যা, অবিচার-অনাচারের ভাঙা-গড়ার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে পুরো পৃথিবী। ইউরোপের অন্যতম শহর প্রাগ তখন শিল্প সংস্কৃতির অন্যতম চর্চা কেন্দ্র। বর্তমানে চেক প্রজাতন্ত্র হিসেবে পরিচিত হলেও ১৮৮৩ সালে সেই অঞ্চলটি অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্যের অধীনে বোহেমিয়া নামে পরিচিত ছিলো। জার্মান আর চেক দুই ভাষাভাষীদের সেই শহরে এক মধ্যবিত্ত ইহুদী পরিবারে জন্ম ফ্রান্ৎস কাফকার।
হারমান কাফকা আর ইয়ুলি কাফকার প্রথম সন্তান ফ্রান্ৎস কাফকা। জীবিকার প্রয়োজনে ব্যস্ত বাবা-মায়ের সঙ্গ শৈশবে খুব একটা না পেলেও তিন বোন এলি, ভ্যালেরি আর ওটলির সাথে শৈশব কেটেছে কাফকার। এর মধ্যে ওটলি ছিলেন ফ্রান্ৎসের সবচেয়ে কাছের মানুষ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইহুদি বন্দীশিবিরেই প্রাণ হারিয়েছেন তিন বোনের সবাই।
যেভাবে কাফকা হয়ে উঠলেন সাহিত্যিক
প্রাগের মাসনা স্ট্রিটে ‘জার্মান বয়েজ এলিমেন্টারি স্কুলে’ হাতেখড়ি কাফকার। ১৮৮৯ থেকে ১৮৯৩ সাল পর্যন্ত এই স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষার পাট চুকিয়ে ওল্ড টাউন স্কয়ারের জার্মান মাধ্যমিক স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন। পাঠ্যক্রম ছিলো জার্মান ভাষায়, বাড়িতে সবাই কথা বলতো ইদ্দিশ ভাষায় আর প্রাগের সাধারণ মানুষ কথা বলতো চেক ভাষায়। তাই কাফকা অনেকটা নিজের গরজেই তিন ভাষাই শিখে নিয়েছিলেন। কাফকা ছিলেন অসাধারণ রকমের এক মনোযোগী পাঠক। হাতের পাশে জার্মান কিংবা চেক ভাষায় লেখা কোনো কিছু পাওয়া মাত্রই পড়ে ফেলার জন্য অনেকটা উদগ্রীব হয়ে পড়তেন এই তরুণ।
মাধ্যমিকের গণ্ডি পাড়ি দিয়ে কাফকা পাড়ি জমালেন কার্ল-ফার্দিনান্দ বিশ্ববিদ্যালয়ে। সময়টা ১৯০১ সাল, নতুন সেই শতাব্দীর শুরুতে জার্মানী জুড়ে বয়ে যাচ্ছে বিজ্ঞানের জোয়ার। ম্যাক্স প্লাংকের মতো বিজ্ঞানীরা তখন তরুণদের আদর্শ। অনেকটা সে জোয়ারেই কাফকাও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে গেলেন রসায়ন পড়বেন বলে।
কিন্তু রসায়নের সাথে তার বোঝাপড়া হয়ে উঠছিলো না। তার বিষয় পরিবর্তনের ব্যাপারটি জেনে বাবার পরামর্শ অনুযায়ী ভর্তি হলেন আইন বিষয়ে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রথম বছরেই দেখা হয় তার সারা জীবনের সঙ্গী হয়ে যাওয়া ম্যাক্স ব্রডের সাথে। ম্যাক্সের শুরুতেই ভালো লাগে কাফকাকে। সবাই যখন কথা বলে যেতেন কাফকা ধীর স্থিরভাবে সেই কথা শুনে যেতেন।
সবার সঙ্গ এড়িয়ে চলা এই ছেলেটির সাথে কথা বলে ম্যাক্স ব্রড ধারণা পেলেন কতটা জ্ঞান আর প্রজ্ঞার অধিকারী সে। কাফকা আর ব্রড দুজন মিলে প্লেটোর ‘Protagoras‘ থেকে শুরু করে গুস্তাব ফ্লবেয়ারের ‘Sentimental Education‘ পর্যন্ত পড়েছেন, আলোচনা করেছেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। তবে দস্তইয়েফস্কি, ফ্লবেয়ার, ফ্রানৎস গ্রিলপারসার আর হাইনরিখ ফন ক্লাইস্ট এই চার লেখকের লেখা পড়ে মুগ্ধ কাফকা তাদের ‘সত্যিকার অর্থে নিজের রক্তের ভাই’ বলেই ঘোষণা করেছিলেন।
জার্মান সাহিত্যের আরেক দিকপাল গ্যোয়েটের সাহিত্যকর্ম পড়েও বেশ অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন তরুণ কাফকা। কিন্তু লেখালেখির জগতে কাফকার পদচারণা তখনও শুরু হয়নি। হয়তো বিশ্বকে জয় করবেন প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন ভিতরে ভিতরে।
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনে পাশ করে চাকরিতে ঢোকেন কাফকা। পাশাপাশি লেখালেখিও শুরু করেন। প্রথম কর্মস্থল হিসেবে ইতালিয়ান বিমা কোম্পানি ‘Assicurazioni Generali’ তে যোগ দিলেন। তবে অভিজ্ঞতা সুখের ছিল না। সকাল আটটা থেকে শুরু করে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত কাজ করে লেখালেখিতে সময় দিতে পারছিলেন না বলে চাকরিটাই ছেড়ে দিলেন।
চাকরি নিলেন ‘Workers’ Accident Insurance Institute for the Kingdom of Bohemia’-তে। দৈনিক ছয় ঘন্টার চাকরি, সাথে চলছে লেখালেখি। ১৯০৮ সালে কাফকা তার প্রথম লেখা ছাপেন। ১৯১২ সালে প্রকাশিত হয় তার লেখা ‘Das Urteil’ (literally: ‘The Verdict’)।
কাফকা প্রথম উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্মের মধ্যে ‘Das Urteil’ একটি। মূলত এই গল্প নির্মিত হয়েছে বাবা আর ছেলের সম্পর্কের টানাপোড়নের বুননে। বিশ্লেষকদের মতে কাফকার নিজের জীবনের প্রতিচ্ছবিই ফুটে উঠেছে এই গল্পে। কাফকার জীবনজুড়ে তার বাবা তার উপর এত বেশি প্রভাব খাটিয়েছেন যে তিনি অনেকটা দুঃখের সাথেই লিখেছিলেন,
“বাবা আমার পৃথিবীর পুরো মানচিত্রের উপর শুয়ে ছিলেন। তিনি আমার জন্য খুব কম জায়গাই রেখেছিলেন।”
(ক্রমশঃ)