
প্রবন্ধ
ফ্রান্ৎস কাফকা
শংকর ব্রহ্ম
সপ্তম পর্ব
শেষ বিচারে এটাই মনে হয় যে, এই চিঠি ছিল কাফকার নিজের উদ্ভাবিত, নিজেকে শান্ত করার, সুস্থ করার থেরাপি। কাফকা এখানে, বাবার কাছ থেকে দূরে সরে গিয়ে স্বাধীন হওয়ার জন্য, তাঁর সঙ্গে তাঁর বাবার সম্পর্ককে নিজের দিক থেকে বুঝতে চেষ্টা করেছেন। এই বোঝার মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই ঢুকেছে কাফকার অতিশয়োক্তি, আত্মপক্ষ সমর্থনের স্বার্থে বাবাকে ছোট করে দেখানো এবং তাঁর লেখকসুলভ সহজাত অনেক কল্পনা প্রবণতা। তবু এটাও বলা যাবে না এই চিঠির সব দাবি মিথ্যা। চরম দারিদ্র্যের মধ্যে বোহেমিয়ার ওসেক্ নামের এক গ্রামে ফেরিওয়ালার গাড়ি ঠেলে বেড়ানো হারমান কাফকার প্রাগে এসে মোটামুটি বড় এক ব্যবসায়ী হয়ে ওঠার সংগ্রামের গল্প থেকেই বোঝা যায়, কতটা শক্তিশালী ব্যক্তিত্ব ও চারিত্রিক দৃঢ়তা ছিল এই লোকের। তাঁর হিসাবেই তিনি মাপতে চাইতেন বাকি সবাইকে, সবাইকে মনে করতেন তারা যেহেতু জীবনসংগ্রাম কী তা দেখেনি, তাই বড় আরামে আছে। কাফকার চিঠিতে বাবার প্রতি তাঁর অনুভূতিগুলো বিধৃত থাকলেও এটা তো নেই যে বাবারও কী পরিমাণ হতাশা ছিল তাঁর খামখেয়ালি, অদ্ভুত স্বভাবের একমাত্র পুত্রসন্তানটিকে নিয়ে (মনে রাখতে হবে এই বাবা-মায়ের অন্য দুই ছেলে মারা গিয়েছিল তাদের ১৫ মাস ও ৭ মাস বয়সে)। কাফকার বাবা-মা কাফকার আপন চাচাতো ভাই ব্রুনো কাফকার (ব্রুনো ছিলেন প্রাগের নামকরা আইনের অধ্যাপক এবং পরে খ্যাতিমান এক রাজনীতিবিদ) সাফল্যের মাপে তাঁদের ছেলের পার্থিব ব্যর্থতাগুলো, বিশেষ করে তাঁর বিয়েশাদি করে সংসার করতে না-পারা ও মেয়ের জামাইয়ের সঙ্গে অ্যাজবেস্টসের ব্যবসা শুরু করেও হাল ছেড়ে দেওয়ার বিষয়টিকে মাপতেন।
বাবা-ছেলের এই সম্পর্কের ফ্রয়েডীয় মনঃসমীক্ষণবাদী ব্যাখ্যা হয়েছে বিস্তর। কাফকা চিঠিতে ফ্রয়েডের বলা ইডিপাল সম্পর্কের কথাই যেন লিখেছেন (যার মূল কথা, ছেলেকে বড় হতে হলে, তাকে তার বাবার মতোই হতে হয়, যৌন দিক থেকে ওরকম পাকা হতে হয়; কিন্তু ছেলেকে একই সঙ্গে বাড়ির একমাত্র যৌন বিষয়ে অভিজ্ঞ পুরুষের জায়গাটি থেকে বাবাকে সরিয়েও দিতে হয়, বাবার অনুকরণ করার স্বার্থে বাবার বিরুদ্ধেই তাকে দাঁড়াতে হয়)। কাফকা লিখছেন: ‘তোমার সঙ্গে আমার যে অসুখী সম্পর্ক তার থেকে মুক্তি পেতে হলে আমাকে এমন কোনো কাজ করতে হবে, যার সঙ্গে তোমার সম্পর্ক সবচেয়ে দূরতম; বিয়ে করা সবচেয়ে বড় কাজ, ও থেকেই সবচেয়ে প্রশংসাযোগ্য স্বাধীনতা আসতে পারে, কিন্তু আমি দেখছি যে বিয়ের সঙ্গেই তোমার সম্পর্কটা সবচেয়ে কাছের।’ কাফকা এখানে তাঁর বাবাকে দোষ দিচ্ছেন, কেন ছেলে বিয়ে করছে না তা নিয়ে হইচই করার জন্য, কিন্তু কাফকার মতে, তাঁর বাবাই তাঁকে এমন আত্মগ্লানি ও পাপবোধে ভোগা, খোঁড়া এক মানুষ বানিয়ে রেখেছেন যে তাঁর পক্ষে বিয়ে করা অসম্ভব। সন্দেহ নেই, এ চিঠির মূল উদ্দেশ্য ছিল বাবার প্রভাবের বলয় থেকে তাঁর নিজের মন ও মানসকে বের করে আনা, মুক্ত হওয়া; কিন্তু এ চিঠিতে কাফকা নিজেকে তাঁর বাবার এতখানিই সৃষ্ট এক চরিত্র করে দেখিয়েছেন যে সেই বাবার থেকে তাঁর একটামাত্র চিঠি লিখে মুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা অসম্ভব ঠেকে। তাহলে কাফকা কি সেই সময়ের এক্সপ্রেশনস্টিক সাহিত্যের রীতি মোতাবেক পিতা-পুত্রের দ্বন্দ্ব নিয়ে রোমান্টিকতায় ভুগতেন? তখনকার দিনে শিল্পসাহিত্যের অন্যতম বিষয়ই ছিল সাহসী, শিল্পীমনের পুত্রের সঙ্গে কর্তৃত্বপরায়ণ বুর্জোয়া পিতার দুর্বোধ্য সংগ্রামকে ফুটিয়ে তোলা। পিতারা ওখানে হতেন মিথ্যা বিশ্বাস ও মিথ্যা নৈতিকতার ধারক ও বাহক, আর তাঁদের সন্তানেরা আধুনিক, মুক্তমনা, প্রথাবিরোধী চরিত্র। এই দুজনের ক্ষমতার দ্বন্দ্ব নিয়ে কম সাহিত্য হয়নি গত শতাব্দীর শুরুর দিকে।
হয়তো তা-ই হবে, হয়তো না। হয়তো ‘বাবার কর্তৃত্বের সামনে নির্যাতিত, অসহায় কাফকা’ একটি মিথ, কিংবা হয়তো তা কিছুটা সত্য, কিছুটা মিথ্যা। কিন্তু এটুকু নিশ্চিত যে কাফকার বাবাকে লেখা চিঠি একটি দারুণ গল্প; কাফকার নিজের জীবন নিয়ে নিজেকে বলা একটি চমৎকার কাহিনি। তাতে আমাদের কোনো আপত্তিও থাকার কথা না: সেরা মনঃসমীক্ষণের কাজও তো তাই ; আমরা কী করে আমরা হয়েছি তার একটা সন্তোষজনক গল্প খাড়া করতে পারা।
আমাদের জন্য জরুরি এটুকুই যে, এই ‘চিঠি’ আমাদেরকে কাফকার অপরাধবোধ ও পাপবোধে আকীর্ণ সাহিত্যকর্মগুলোর খুব কাছে নিয়ে আসে এ কথা, বিশেষ করে তাঁর আমেরিকা উপন্যাস থেকে শুরু করে পরের সব লেখার জন্য সত্য (অর্থাৎ ১৯২২ থেকে ১৯২৪ পর্যন্ত)। এই চিঠিতে কাফকার টাকা চুরি করা এক ব্যাংকারের সঙ্গে নিজেকে তুলনা করার মধ্যে আমরা তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকর্ম বিচার উপন্যাসের (যেখানে ব্যাংকার জোসেফ কে. বিনা অপরাধে একদিন গ্রেপ্তার হয়ে যায়, কিন্তু তাকে কখনো আটক করা হয় না, সে জীবনভর ঘুরে বেড়ায় ; শেষ দৃশ্যে নিষ্ঠুরভাবে খুন হয়ে যাওয়া পর্যন্ত তার অপরাধ কী তা জানার জন্য) বীজ খুঁজে পাই।
কাফকার মা — ইয়ুলি কাফকা
এই বিশাল বাবাকে লেখা চিঠিতে কাফকার মা ইয়ুলি কাফকা কত ছোট যে একটা চরিত্র তা ভাবতে অবাক লাগে। বাবার সঙ্গে তুলনায় তাঁর মা খুব শান্ত ও লাজুক এক মহিলা ছিলেন। এ চিঠিতে তাঁর ভূমিকা স্বামীর সহকারী একজন হিসেবে, যিনি তাঁর সন্তানদের বাবার সঙ্গে এতই ঘনিষ্ঠ যে বাবার অত্যাচারের হাত থেকে তাদের রক্ষা করতে ব্যর্থ; কিন্তু তা সত্ত্বেও তাঁকে আমরা দেখি একজন অসহায় মধ্যস্থতাকারী হিসেবে, অসহায় কারণ তিনি পিষ্ট দুদিকেরই চাপে একদিকে তাঁর স্বামী, অন্যদিকে তাঁর সাহায্যের জন্য তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকা চার সন্তান। কাফকা বাবাকে লিখেছেন: ‘আমরা তাঁকে (মাকে) সমানে হাতুড়ির বাড়ি মেরে যাচ্ছি, তোমার দিক থেকে তুমি, আমাদের দিক থেকে আমরা।’ ঐ দুটি গল্পেও ‘রায়’ ও ‘রূপান্তর’ যেখানে কাফকা-পরিবারের সবচেয়ে কাছাকাছি এক ছবি পাওয়া যায়, মা চরিত্রটি লক্ষণীয়: ‘রায়’ গল্পে মা মৃত; আর ‘রূপান্তর’ গল্পে তিনি তাঁর ‘দুর্ভাগা ছেলের’ প্রতি মমতায় ভরা, কিন্তু ছেলের বিপদে জ্ঞান হারিয়ে ফেলা ছাড়া তাঁর আর কোনো ভূমিকা নেই। মনঃসমীক্ষণবাদী চোখ দিয়ে দেখলে মনে হয়, কাফকার অরক্ষিত মানসিক অবস্থার কারণ শুধু তাঁর বাবার কর্তৃত্বপরায়ণতাই নয়, তাঁর প্রতি খুব কম বয়সেই তাঁর মায়ের স্নেহ-ভালোবাসা বন্ধ করে দেওয়ার ব্যাপারটাও এর একটা কারণ বটে। কাফকার ডায়েরিতে ইয়ুলি কাফকাকে আমরা দেখি ছেলের অদ্ভুত ব্যাপারস্যাপারগুলো নিয়ে ‘ঘ্যানঘ্যান’ করছেন, ছেলের বিরক্তি শুধুই বাড়াচ্ছেন আর তাঁকে বুঝতে পুরো ব্যর্থ হচ্ছেন। কাফকা ডায়েরিতে নালিশ জানাচ্ছেন যে তাঁর মা তাঁকে সাধারণ আর দশটা যুবকের মতোই ভাবেন, তাই ‘ঘ্যানঘ্যান’ করেন তাঁর ছেলে কেন ওসব ‘সাহিত্য’ ছেড়ে অন্য সবার মতো বিয়ে-থা করে সংসারী হচ্ছে না। কাফকার দীর্ঘদিনের প্রেমিকা ফেলিস বাউয়ারকে লেখা একটি চিঠির পুনশ্চঃ অংশে আমরা মা ও ছেলের এই পর হয়ে যাওয়া এবং একই সঙ্গে পারস্পরিক স্নেহ-ভালোবাসার এক মর্মস্পর্শী বর্ণনা পাই:
আমি কাপড়চোপড় ছাড়ব এমন সময় মা কী যেন সামান্য একটা কাজে আমার ঘরে ঢুকলেন, তারপর তিনি চলে যাচ্ছেন এমন সময় আমাকে শুভ রাত্রি জানিয়ে একটা চুমু খেলেন, এরকম ঘটেনি অনেক বছর। ‘ঠিক আছে’, আমি বললাম। ‘আমার কখনো সাহস হয়নি’ আমার মা বললেন, ‘আমি ভাবতাম তুমি এসব পছন্দ করো না। কিন্তু তুমি যদি পছন্দ করে থাকো, তো আমিও করি।’
ব্যক্তিগত জীবন ও কাফকা সাহিত্যে যৌন অনুষঙ্গ
কাফকার যৌন জীবন ছিল বেশ সক্রিয়। ম্যাক্স ব্রডের ভাষায়, কাফকা যৌন কামনার হাতে ‘উৎপীড়িত’ হতেন। কাফকার অন্যতম প্রধান জীবনীকার রাইনার স্টাখের মতে, কাফকা জীবনভর ‘অবিরাম মেয়েদের পেছনে ছুটেছেন’, আর তাঁর মধ্যে সব সময় কাজ করত ‘বিছানায় ব্যর্থ হওয়ার ভয়।’ কাফকা অনেকবার পতিতা সংসর্গ করেছেন; আর পর্নোগ্রাফিতেও তাঁর আগ্রহ ছিল। তাঁর জীবনে প্রেম এসেছে মোট ছয় বার; একেকবার একেক রূপে।
কাফকার ডায়েরি ও চিঠিগুলো পড়লে এরকম মনে হয় যে, বিয়ে করাকে তিনি জীবনের মুখ্যতম ব্যাপার বলে ভাবতেন।
বিয়ে করা, পরিবার গড়ে তোলা, যতগুলো সন্তান ঘরে আসে তাদের গ্রহণ করা, এই অনিশ্চিত পৃথিবীতে তাদের পাশে দাঁড়ানো, এমনকি অল্পস্বল্প পথ দেখানো, আমার হিসেবে এই-ই হচ্ছে মানুষের পক্ষে অর্জনযোগ্য সবচেয়ে বড় সফলতা।
বাবাকে লেখা চিঠিতে কাফকার এই ঘোষণা তিনি নিজের জীবনে বাস্তবে রূপ দিতে পারেননি কোনো দিন। তাঁর সঙ্গিনী নির্বাচনে সব সময়ই সমস্যা ছিল, সেই সঙ্গে ছিল বিয়ে করে সংসার শুরু করলে, ঘরে সন্তান এলে, সাহিত্যচর্চায় ব্যাঘাত ঘটবে– এই ভয়।
কাফকার প্রথম প্রেমিকা ফেলিস বাউয়ারের কথা বলা যাক। বন্ধু ম্যাক্স ব্রডের বাসায় ১৯১৩ সালের ১৩ আগস্ট কাফকার সঙ্গে ফেলিসের দেখা হয়। ফেলিস বয়সে ছিলেন তাঁর চেয়ে চার বছরের ছোট এক বুদ্ধিদীপ্ত, অল্পবিস্তর পড়ালেখা করা, অনাকর্ষণীয় চেহারার, ভালো চাকরি করা বার্লিনের মেয়ে। কাফকা তাঁকে ভক্তি করতেন, কিন্তু তাঁর প্রতি কামনা-বাসনা বোধ করতেন না। ১৯১৫ সালে ফেলিসের সঙ্গে সময় কাটানোর পরে কাফকা ডায়েরিতে লেখেন: ‘চিঠির ভুবনে ছাড়া বাস্তবে আমি কখনো ফেলিসের সঙ্গে সম্পর্কের সেই মধুরতাটুকু অনুভব করিনি, যেটা মানুষ প্রেমিকার সঙ্গে করে; তাঁর প্রতি আমার শুধু অসীম ভক্তি।’ এই স্মার্ট ও আত্মবিশ্বাসী ফেলিসের সঙ্গে কাফকার যখন বিয়ের কথা শুরু হয়, তিনি বোধ হয় নিজের অসম্পূর্ণতাগুলো নিয়ে ভয় পেয়ে যান, সঙ্গে তো সাহিত্য ও বিয়ের মধ্যেকার বৈসাদৃশ্য ঘিরে দুশ্চিন্তা এবং নিজের জীবনে বাবার সংসারেরই পুনরাবৃত্তি ঘটানোর ভয় ছিলই। ফেলিস তাঁকে নিয়ে বাসার আসবাব কিনতে গেলে, কাফকার কাছে সেগুলো মনে হয় ‘কবরফলক’; আর ফেলিস যখন বলেন যে তাঁদের দুজনের বাসায় থাকবে তাঁর (ফেলিসের) পছন্দের ছোঁয়া, কাফকার কাছে খুব অসহ্য লাগে কথাটা। ফেলিসের সঙ্গে বাগ্দানের অনুষ্ঠানে কাফকার নিজেকে মনে হয় ‘কোনো আসামির মতো হাত-পা বাঁধা’। ফেলিসকে লেখা ৫০০ চিঠির মধ্যে (Letters to Felice নামে কাফকার বেস্টসেলার বইটি বাজারে সহজলভ্য) আমরা পাই কাফকার মানসিক ও আবেগগত চাহিদার এক রক্তাক্ত ছবি; ফেলিসের জীবনযাপনের প্রতিটি খুঁটিনাটি জানতে চাওয়ার মধ্যে আমরা দেখি হবু বধূর ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার কলাকৌশল আঁটা এক চতুর কাফকাকে, আর সবচেয়ে বেশি দেখি দুজনের মধ্যে অন্তরঙ্গতার এক প্রগাঢ় অভাব। ফেলিসের চিঠিগুলো যদিও পাওয়া যায়নি, তবু এটুকু নিঃসন্দেহে অনুমান করা যায়, তিনি কাফকা নামের ৬ ফুট লম্বা, সুদর্শন ও আকর্ষণীয় যুবকের খামখেয়ালি, কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা ও তাঁর প্রতি অবিশ্বস্ততার কারণে মানসিকভাবে যথেষ্ট বিরক্ত ছিলেন। ১৯১৪-র ১২ জুলাই ফেলিস নিজেই তাঁদের প্রথম বাগ্দান ভেঙে দেন; পরে অবশ্য তাঁরা আবার যোগাযোগ শুরু করেন; দ্বিতীয়বারের মতো বাগ্দান হয় ১৯১৭-র জুলাইতে, পরে সে-বছরেরই ডিসেম্বরে এটিও ভেঙে যায়।
ফেলিসের সঙ্গে সম্পর্ক চলাকালীন কাফকা গোপনে ফেলিসের প্রিয়তম বান্ধবী গ্রেটে ব্লখের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলেন। গ্রেটে বার্লিনেরই এক ইহুদি পরিবারের মেয়ে। ম্যাক্স ব্রড দাবি করেন যে গ্রেটের গর্ভে কাফকার একটি পুত্রসন্তান হয়, যার কথা কাফকা কখনো জানতেন না। যদিও সবচেয়ে বিখ্যাত দুই কাফকা-জীবনীকার পিটার-আন্দ্রে অল্ট ও রাইনার স্টাখের মতে এ দাবি সত্য নয়; গ্রেটের সঙ্গে কাফকার ওরকম ঘনিষ্ঠতা কখনোই হয়ে ওঠেনি। গ্রেটে ও কাফকার মধ্যেকার গোপন সম্পর্কের কথা গ্রেটেই বান্ধবী ফেলিসকে জানিয়ে দেন। ফেলিস গ্রেটেকে লেখা কাফকার চিঠিগুলো পড়ে চরম প্রতারিত বোধ করেন।
১৯২০ সালে, অসুস্থ অবস্থায়ই, কাফকা প্রেমে পড়েন চেক সাংবাদিক ও লেখক, সুন্দরী মিলেনা য়েসেন্স্কার। মিলেনাকে লেখা তাঁর চিঠিগুলো Letters to Milena নামের আরেক বেস্টসেলিং বই। এই চিঠিগুলো ফেলিসকে লেখা চিঠিগুলো থেকে অনেক বেশি আন্তরিকতা ও উষ্ণতায় ভরা। এঁদের মূল বৈশিষ্ট্য নিরাপত্তাহীনতার বোধ, তাঁর ভীতি ও নিজের প্রতি ঘৃণার অনুভূতি। তিনি নিজেকে তুলনা করেন ‘নোংরা বিছানায় শোয়া, মৃত্যুর অপেক্ষায় থাকা এক লোক, যাঁকে দেখতে এসেছে মৃত্যুর ফেরেশতা’ হিসেবে। এই দফায় আমরা কাফকার প্রতি তাঁর প্রেমিকার অনুভূতির কথাগুলোও জানতে পারি। ম্যাক্স ব্রডকে লেখা মিলেনার অসংখ্য চিঠির মধ্যে দিয়ে জানা যায়, কাফকার ছোটখাটো বিষয়গুলো সামলানোর (যেমন পোস্ট অফিসে যাওয়া) অপারগতা দেখে মিলেনা বিস্মিত; আর অন্যান্য লোকদের স্মার্টনেস দেখে (যেমন ফেলিসের, সেই সঙ্গে মিলেনার মেয়েবাজ স্বামী আরনস্ট্ পোলাকের) কাফকা কীভাবে হীনম্মন্যতায় ভুগতেন তা বুঝতে পেরে তিনি কাফকার প্রতি সহানুভূতিতে আর্দ্র। মিলেনা লেখেন:
সে (কাফকা) ভাবে যে সে অপরাধী ও দুর্বল, তার পরও এই পৃথিবীতে তাঁর মতো বিশাল শক্তির আর কেউ নেই; আর কারো নেই উৎকর্ষের পূর্ণমাত্রা অর্জনের, শুদ্ধতা ও সত্য অর্জনের এরকম পরম ও তর্কাতীত প্রয়োজন।
মিলেনাকে কাফকা লেখেন: ‘আমি নোংরা, মিলেনা, আমার ভেতরকার নোংরার কোনো শেষ নেই, সে কারণেই আমি শুদ্ধতা নিয়ে এত জোরে চিৎকার করি।’ (২০ আগস্ট, ১৯২০)।
১৯২০-এর আগস্টে মিলেনা ব্রডকে আরো একটি চিঠি লেখেন, যেটি কাফকার অপাপবিদ্ধ, সাধু-সন্তের ইমেজ (বা মিথ) আরো গাঢ় করে তোলে।
তাঁর [কাফকার] কাছে জীবন অন্যদের কাছে যেমন সেরকম মোটেই নয়…সে একদম সাধারণ জিনিসগুলোও বুঝতে পারে না…এই পুরো পৃথিবীই তাঁর কাছে একটা ধাঁধা…আমি যখন তাকে আমার স্বামীর কথা বললাম, আমার স্বামী যার আমার প্রতি অবিশ্বস্ততার ঘটনা বছরে শতবার ঘটছে, তাঁর মুখটা [আমার সেই স্বামীর প্রতি] সেরকম শ্রদ্ধায়ই উজ্জ্বল হয়ে উঠল যেমনটা হয়েছিল সে আমাকে তার অফিসের বস্ নিয়ে বলার সময়… তাঁর বস্ দ্রুত টাইপ করতে পারেন, আর সেকারণেই [কাফকার হিসেবে] কী চমৎকার একজন মানুষ তিনি… সে [কাফকা] মিথ্যা বলতে সম্পূর্ণ অসমর্থ।
(ক্রমশঃ)