চড়ুইভাতি বনাম পিকনিক
বারিদ বরন গুপ্ত
শীত এলেই ছাত্র-ছাত্রী সব আবদার করে স্যার পিকনিক ! আমিও ওদের সাথে একদিনের আনন্দে হারিয়ে যাই! সত্যিই ধূলিধ্বসারিত মলিন জীবনের অন্তরালে একদিনে সকলের সাথে আনন্দের ঝর্ণাধারায় একটু ভিজতে বনভোজন বা চড়ুইভাতির জুড়ি মেলা ভার!
বনভোজন বা চড়ুইভাতি আদিম সংস্কৃতির একটা ক্ষুদ্র সংস্করণ যা বর্তমান সমাজে এসে গেছিল। বহুদিন গ্রাম বাংলাকে একটা আনন্দ উৎসবের দিক যেমন সূচিত করেছিল, তেমনি গোষ্ঠী বা সমাজকে একটা সংহতির সূত্রে বেঁধে রেখেছিল! ফরাসি সমাজতাত্ত্বিক এমিল দুরখেইম এই ধরনের অনুষ্ঠানকে জৌব সংহতির যুগের সমাজ সংগঠনের অতি আবশ্যকীয় উপাদান হিসেবে চিহ্নিত করেছেন! সেই আদিম সংস্কৃতি বনভোজন বা চড়ুইভাতি বর্তমানে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির ছোঁয়ায় যান্ত্রিক সমাজে পিকনিক নামক উদ্দাম সংস্কৃতির রূপ নিয়েছে!
চড়ুইভাতি থেকে পিকনিক একটা সমাজ উত্তোরনের পর্যায় হিসেবে চিহ্নিত করা যায় ! বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বর্তমান সমাজকে যেভাবে গতিশীল করেছে তাতে করে দেশীয় সংস্কৃতি অনেকটা পিছু হটে পাশ্চাত্য সাংস্কৃতির ছোঁয়ায় নতুন রূপ পেয়েছে, বনভোজন বা চড়ুইভাতি থেকে পিকনিকে উত্তরণ গতিশীল সমাজের বিনোদনের একটা উপাদান হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে।
এই সেদিন পিকনিক প্রসঙ্গে একটা ছাত্রকে জিজ্ঞেস করলাম-‘তোদের চড়ুইভাতি কবে রে?’
তো সে আমার দিকে হাঁ করে চেয়ে রইল! বুঝলাম ছাত্রটি এই পদের সাথে পরিচিত নয়! পরে যখন পিকনিক বললাম একমুখ হাসিতে -‘ও তাই বলুন! অপনি যেদিন করাবেন!’বুঝলাম প্রাচীন সভ্যতা সংস্কৃতি যান্ত্রিক সমাজে এসে নতুন রূপ নিচ্ছে, শুধু তাই নয় তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য পুরোপুরি পাল্টে যাচ্ছে। এই প্রসঙ্গে অতীতের একটা অপার আনন্দ অনুভূতির স্মৃতি আজ ভেসে এলো!
তখনো শীতকালে ঘন ঘন চড়ুইভাতি বা বনভোজন হতো! স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষা-পর্ব পৌষ মাসে শেষ হয়ে যেত, মাঠ থেকে আমন ধান ও প্রায় উঠে যেত, বলতে গেলে মাঠ ফাঁকা হয়ে যেত। তখন আমাদের কাজ ছিল মাঠে গরু চড়ানো এবং তার সাথে উপরি পাওনা ঘুড়ি উড়ানো! গ্রামের প্রায় সব ছেলেপিলেরা মাঠে ছুটতো, গরু চড়াই এর সাথে ঘুড়ি ওড়ানোর সুযোগ কেউ ছাড়তো না!
সময়টা সাত এর দশকের শেষ পর্বের হবে, বিদ্যালয়ের বার্ষিক পরীক্ষার ফলাফল উত্তীর্ণ হয়েছে, আমরা গ্রামের ছেলেরা সব মাঠে, শীতের রূক্ষতায় মাঠ ধূ ধূ করছে, বন বন করে উত্তরে হাওয়া বইছে! মাঠের মাঝে গরু ছেড়ে দিয়ে ‘ঝুমনা পুকুর’ পাড়ে মনের আনন্দে ঘুড়ি দিয়েছি উড়িয়ে , নীল আকাশে চীলের সাথে সে পাক খাচ্ছে! হঠাৎ পাড়ার এক কাকা বললো- ‘আজকে চড়ুইভাতি হবে, যা বাড়ি থেকে চাল ডাল সব নিয়ে আয়?’ ছুটলাম উর্ধ্বশ্বাসে! জীবনের প্রথম বনভোজন বা চড়ুইভাতি! সেদিনের সেই আনন্দ অনুভূতি বর্তমান সময়ে এসে যেন মনে হয়, কোথায় যেন হারিয়ে গেছে সব, চারিদিকে অভাব, এককোনে পড়ে আছে অসার দুনিয়া, পাহাড় প্রমাণ অট্টালিকা, হাঁপিয়ে মরে যান্ত্রিকতার আড়ালে! নেই চড়ুই, নেই বন, যান্ত্রিক সভ্যতার গ্ৰাসে সব গেছে উড়ে, বনের চড়ুই এর কিচিরমিচির শব্দের সাথে খাওয়ার সেই আনন্দ অনুভূতি আর হয়তো কোনদিন ফিরে আসবেনা ! এসেছে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির পিকনিক, এই নিয়েই বাঁচি!!
Barid Baran Gupta