Feature

বর্ধমান ও নেতাজী:: একটি পর্যালোচনা

বারিদ বরন গুপ্ত

বর্ধমানের প্রতি নেতাজীর বরাবরই একটা টান ছিল! এখনো বর্ধমানের টাউন হল, বর্ধমান পৌরসভা , মিত্র পরিবার ,বর্ধমান রেল স্টেশন কিংবা নেতাজি মিষ্টান্ন ভান্ডার এ নেতাজির পদচিহ্ন আজও পড়ে আছে, ‌১৯২৮ থেকে ১৯৪০ এই সময় পর্বে বেশ কয়েকবার নেতাজী ছুটে এসেছিলেন বর্ধমানে, তিনি বুঝেছিলেন বর্ধমানের মাটিতে স্বদেশ প্রেমের বীজ রোপন করলে সংগঠনকে জোরদার করা যাবে, সেই উদ্দেশ্যেই হয়তো বর্ধমানের প্রতি নেতাজির একটা টান ছিল।

নেতাজি প্রথমবার বর্ধমান এসেছিলেন খুব সম্ভবত ১৯২৮ সালে রাজনৈতিক গুরু দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের এক তৈলচিত্র উন্মোচনে! সেদিন ভিড়ে ঠাসা টাউন হল ময়দানে তিনি বর্ধমান বাসীর উদ্দেশ্যে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি ব্রিটিশের অপশাসন এবং তা থেকে মুক্তির পথ অন্বেষণের পথ বেছে নেওয়ার জন্য অনুরোধ জানিয়েছিলেন, তার গুরুগম্ভীর বক্তৃতায় সেদিন বর্ধমান টাউন হল আলোড়িত হয়েছিল! তাছাড়া সেদিন বর্ধমান পৌরসভার কমিশনের উদ্দেশ্য তিনি একই কথা বলেছিলেন! সমাজতান্ত্রিক আদর্শে বিশ্বাসী হলেও প্রথম পর্বে গান্ধীজীর সাথে তার সম্পর্ক ভালই ছিল, যদিও আইন অমান্য আন্দোলনের পর্যায়ে কংগ্রেসের কিছু নীতি আদর্শ ও ক্রিয়া-কলাপ এ তিনি বিরক্তি প্রকাশ করেন, এই কারণে ধীরে ধীরে গান্ধীজীর সাথে তার দূরত্ব বাড়তে থাকে, তার চূড়ান্ত রূপ পায় ১৯৩৮ এর ত্রিপুরী কংগ্রেসের সময় পর্বে, গান্ধী মনোনীত প্রার্থী পট্টভি সীতা রামাইয়া কে হারিয়ে দ্বিতীয়বারের জন্য জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার সময়, গান্ধীজি এই পরাজয় কিছুতেই মেনে নিতে পারেননি, তিনি পট্টভির পরাজয় কে নিজের পরাজয় বলে মনে করেছিলেন , নেতাজির এই জনপ্রিয়তা গান্ধীজিকে হয়তো ভাবিয়ে তুলেছিল, তাই গান্ধিজি উঠে পড়ে লিখেছিলেন নেতাজির জনপ্রিয়তা এবং অগ্রগতিকে খর্ব করতে। এর পর গান্ধীজীর ইন্ধনে এবং কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি চরম অসহযোগিতায় অবশেষে নেতাজী জাতীয় কংগ্রেস ছাড়তে বাধ্য হন, এইসময় পর্বে তিনি সংগঠনকে জোরদার করার জন্য উঠেপড়ে লাগেন, বাংলার চারিদিকে ঘুরে বেরিয়েছেন, সেই সূত্র ধরেই তিনি আবার বর্ধমানের মাটিতে পা রাখেন, সেদিন তিনি এক জ্বালাময়ী বক্তৃতায় বলেন- ‘প্রাচীর যতই শক্তিশালী হোক সম্মিলিত শক্তির কাছে তার পরাজয় হতে বাধ্য, একদিন সে ধষে পরবেই!’ তাছাড়া তিনি আরো বলেন যে পরাধীনতা পাপ! আর পরাধীনতা স্বীকার করা মহাপাপ! তার উদ্দেশ্যে ছিল mass জাগরণ, তিনি তার জীবনের আদর্শ তার গুরুদেব বিবেকানন্দের কাছ থেকে এই নীতি শিক্ষা পেয়েছিলেন ,mass না জাগলে পরাধীনতার গ্লানি ঘুচবে না, সেই জন্যই সংগঠন বাড়ানোর জন্য তিনি উঠে পড়ে লেগেছিলেন।

নেতাজি শেষবার বর্ধমানের মাটিতে পা রেখেছিলেন ১৯৪০ সালে ফরওয়ার্ড ব্লক দল গঠনের ঠিক পরেই, সেদিন বর্ধমান স্টেশন চত্বর জনসমুদ্র, সবাই তাকে এক ঝলক দেখতে চায়, তার জ্বালাময়ী ভাষণ শুনতে চায়, সেদিন বর্ধমান পৌরসভা, বর্ধমান টাউন হলে একই ঢঙে ভাষণ দিয়েছিলেন, আলাদা দল গড়লেও বর্ধমানের জাতীয় কংগ্রেস নেতাদের সাথে নেতাজীর যথেষ্ট ভালো সম্পর্ক ছিল, তাছাড়া বর্ধমানের মহারাজ বিজয় চাঁদ মেহতাবের সাথে নেতাজীর সম্পর্কের কথা সবারই জানা, সরাসরি সংগঠনের সাথে যুক্ত না হলেও বর্ধমান মহারাজারা নানাভাবে তাকে সাহায্য করেছেন। বর্ধমানের পিলখানার সেন পরিবারের সাথে নেতাজির একটা আত্মিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, ভামিনী রঞ্জন সেন এর বড় ছেলে সুধীর চন্দ্র সেনের সাথে নেতাজির বন্ধুত্ব ছিল, সেই সূত্রেই বর্ধমানের সেন পরিবার নেতাজীর আপনজন হয়ে উঠেছিল! সুধীর সেনের মাকে নেতাজি নিজের মায়ের মতো দেখতেন, খোঁজ খবর রাখতেন, সেই সূত্রে বর্ধমান হয়ে উঠেছিল নেতাজির আর এক আশ্রয়স্থল! আর এক প্রতিষ্ঠান নেতাজি মিষ্টান্ন ভান্ডার, এই দোকানের প্রতিষ্ঠাতা গোবিন্দ চন্দ্র নাগ এর সাথে বর্ধমান জেলার নামিদামি কংগ্রেস নেতাদের যোগাযোগের সূত্রেই নেতাজির এই দোকানে পা রাখা, যা পরবর্তীকালে তার নামেই স্মৃতি হয়ে আছে-‘নেতাজী মিষ্টান্ন ভান্ডার’, আর স্মৃতি হয়ে আছে তাঁর সেই জ্বালাময়ী ভাষণ-“পরাধীনতা পাপ! পরাধীনতা স্বীকার করা মহাপাপ!”

**লেখক সমাজ সংস্কৃতির গবেষণা মূলক প্রবন্ধ লেখালেখিতে যুক্ত

inbound8325744444115752774-0.png inbound948404236823557993-1.jpg

Barid Baran Gupta

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *