” এসো পৌষ যেও না:: পৌষ পার্বণের সেকাল একাল
কলমে: বারিদ বরন গুপ্ত
চির ঐতিহ্যবাহি পৌষ পার্বণে মেতে উঠেছে বর্ধমান।সেই সুদীর্ঘ কাল ধরে কৃষিভিত্তিক পরিবারগুলি পৌষের শেষ দিনে লক্ষ্মীর আরাধনার অঙ্গ হিসেবে পৌষ সংক্রান্তি বা পৌষ পার্বণ পালন করে আসছে। পৌষ মাসের সঙ্গে গ্রামবাংলার যেন নাড়ির টান, বাঙালি কৃষিভিত্তিক পরিবারগুলির কাছে পৌষ মাস হলো লক্ষ্মী মাস, এক সময় পাকা ফসল ঘরে উঠতো পৌষ মাসে, এই উপলক্ষে পৌষের শেষ দিনে চাওড়ি বাউরী উৎসব পালন করা হয়। নতুন করে লক্ষ্মী পাতা হয়! বলতে গেলে ক্ষেতে-খামারে লক্ষ্মীর আরাধনায় মেতে উঠে বাঙালি। সুদীর্ঘকাল ধরে বাঙালি যৌথ পরিবার গুলিতে এই অনুষ্ঠান খুব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করা হতো। কিন্তু বর্তমানে সেই ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠানের আভিজাত্য অনেকটা ফিকে হয়ে গেছে!
এই অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে বাড়িতে বাড়িতে মেয়েরা নানান আলপনায়,ঘরদোর সাজিয়ে তোলে, লক্ষ্মীর আগমনের অপেক্ষায় ঘরদোর পরিষ্কার করা বাসনপত্র ধোয়া এমন কি জামা কাপড় পরিষ্কার করার রীতি আছে দীর্ঘকাল ধরে। তবে এই পোষসংক্রান্তি কে ঘিরে রয়েছে অনেক আচার-বিচার। এই শুভ দিনে বাইরে যেমন কেউকে যেতে নেই, তেমনি যারা দূরে থাকে তাদেরকে ঘরে ফিরে আসতে হয়, কি সুন্দর একটা লোক আচার! আমার মনে হয় সকল কি সঙ্গে নিয়ে লক্ষ্মী দেবীর আরাধনায় সামিল হওয়ার আনন্দ অনুষ্ঠান! সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে জৈব সমিতির যুগে এটা পারিবারিক সংহতি কে ধরে রেখেছিল। শুধু তাই নয় চাষে ব্যবহৃত সমস্ত যন্ত্রপাতিকে ঘরে এনে বাউরি দেওয়ার প্রথা দীর্ঘকাল ধরে এই কৃষিভিত্তিক পরিবারগুলোতে চালু রয়েছে। সেই সুদীর্ঘকাল ধরে এই প্রথা গ্রাম বাংলাকে একটা অন্য মাত্রা দিয়েছে, বলতে গেলে পৌষ সংক্রান্তি অনুষ্ঠান বাঙালি সংস্কৃতি জীবনের এক আনন্দ অনুষ্ঠান, আর এই অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে পালিত হয় নানা লোকাচার, যা স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রাম সমাজের এক অন্যতম বৈশিষ্ট্য বলা যায় ।
এই পৌষপার্বণ কে কেন্দ্র করে নতুন ধানের চাল গুড়ো করে পৌষ ডাকা, পিঠে তৈরি ইত্যাদি নানা ধরনের কাজ করা হয়।আগে যখন ধান ভাঙ্গার মেশিন আবিষ্কার হয়নি তখন প্রত্যেক বাড়িতে বাড়িতে চাল তৈরি করার জন্য ঢেঁকি থাকতো, বর্তমানে মেশিনের সাহায্যে চাল গুঁড়ো করা হয়, কারণ বাঙালির ঐতিহ্যবাহী ঢেঁকি, নাঙ্গল, জোয়ান মই ইত্যাদি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির কল্যাণে প্রায় জাদু ঘরে ঢুকে গেছে। তাই বর্তমানে আচার অনুষ্ঠান গুলো যেন অনেকটা প্রথা সর্বস্য হয়ে উঠেছে, সেই আবেগ, সেই অনুভূতি আজ আর নেই, বলতে গেলে পৌষ সংক্রান্তি আছে, কিন্তু পৌষ মাস নেই, এখন অঘ্রান মাসেই ধান উঠে যায়, আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়া যেমন ক্ষেত-খামারে লেগেছে, তেমনি বাঙালির ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ও তার প্রভাব পড়েছে! তাই কৃষিভিত্তিক পরিবারগুলির আচার অনুষ্ঠান গুলো অনেকটা যেন দায়সারা গোছের হয়ে উঠেছে! তাই বলতে ইচ্ছা করে–
‘পৌষ আছে পৌষ নেই
হারিয়েছে সব যান্ত্রিক সভ্যতার আড়ালে
শুধু টিকে আছে ঠাট বাট
আর কয়েকটা প্রথা!’
এই পৌষপর্বন কে কেন্দ্র করে সেই প্রাচীন কাল থেকেই ঘরে ঘরে নতুন চাল, নলেন গুড়, দুধ ,নারকেল সহযোগে পিঠা তৈরি হয়। আগে যখন উচ্চফলনশীল ধান আসেনি তখন পৌষ মাসে ধান ঘরে উঠতো, সম্ভবত গোলায় ধান উঠা কে কেন্দ্র করে লক্ষ্মীর আরাধনার অঙ্গ হিসেবেই পৌষ মাসের শেষ দিনে এই উৎসব পালন করা হতো। কিন্তু বর্তমানে জলদি উচ্চ ফলনশীল ধান অঘ্রান মাসের মধ্যে উঠে যায়, তবুও চির ঐতিহ্য মেনে শেষ পৌষে এই উৎসব পালন করার রীতি এখনও প্রচলিত আছে।
শুধু তাই নয় এই পৌষ উৎসবকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন জায়গায় মেলা বসে, কৃষিজীবী পরিবারগুলি আনন্দ অনুষ্ঠানের জন্য এই মেলায় ভিড় করে, নতুন ধান বেচে টাকা পয়সা পায়, তাই বিভিন্ন জিনিস কেনাকাটা ও করে থাকে।মনে করা যেতে পারে যে কৃষিভিত্তিক পরিবারগুলি ফসল তোলার আনন্দের মেতে ওঠার জন্য এক জায়গায় জড়ো হয় এবং তারই অঙ্গ হিসেবে মেলা বসে।
তবে একথাও ঠিক চির ঐতিহ্যবাহি এই প্রথার কৌলিন্য আর আগের মত নেই, যেন প্রথা সর্বস্য হয়ে উঠেছে।যান্ত্রিকতার যুগে নতুন প্রজন্মের কাছে এসব অনুষ্ঠানর গ্রহণযোগ্যতা অনেকটাই কমে গেছে। নতুন প্রযুক্তি এই ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন সংস্কৃতিকে আঘাতপ্রাপ্ত করেছে,তাই এর অস্তিত্ব আর কতদিন থাকবে তা জোর করে বলা যাচ্ছে না, কারণ অনান্য প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী প্রথাগুলি কালের অন্তরালে তলিয়ে গেছে। আশায় বাঁচে চাষা, বেঁচে থাক ধানের গোলা বর্ধমান, বেঁচে থাক চাষ বাস,বেঁচে থাক এই চির ঐতিহ্যবাহী উৎসব পৌষ পার্বণ।
* লেখক পরিচিতি# বারিদ বরন গুপ্ত, মন্তেশ্বর পূর্ব বর্ধমান, কবি সাহিত্যিক প্রাবন্ধিক গবেষণামূলক লেখালেখিতে যুক্ত আছেন।।
Barid Baran Gupta