Dr. Taimur Khan

এই কবিতাজীবন (ধারাবাহিক)

🐦

পর্ব-১৮

দূরের আলো এক একটি সম্মোহন

🍁

বোলপুর-শান্তিনিকেতনে চারুচন্দ্র রায় ‘কবিতায়ন’ নামে একটি পত্রিকাটি সম্পাদনা করতেন। ন’য়ের দশকের কিছু আগে থেকেই এবং পরবর্তী কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সময়কাল পর্যন্ত সেই পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে গদ্য ও কবিতা লেখার সুযোগ হয়েছে। শান্তিনিকেতনে সারারাত ধরে ত্রিপল টাঙিয়ে সাহিত্যেবাসর চলেছে। এখানে একদল বাউল এর সঙ্গে কবি-সাহিত্যিকরাও অংশ নিয়েছেন। একবার বাউল গান, তো একবার কবিতা আবৃত্তি; একবার গল্প পাঠ,

তো একবার কবিতা পাঠ। তারপর কেউ একবার আলোচনায় অংশ নিলেন। সাহিত্য পাঠের আসরেই অনেকেই ঘুমিয়ে পড়লেন। ঘুম ভাঙানোর জন্য নামানো হল আশানন্দন চট্টরাজকে। তিনি নেচে নেচে গান ধরলেন: ‘দেশ-বিদেশের মানুষ গো যাও এ বীরভূম ঘুরে’

তাঁর গান ও নাচের যেন বিরাম নেই। হয়তো পুনরায় আবার ধরলেন:

“আয়রে ছুটে বীরভূমের এই গ্রাম কেন্দুলিতে

যেথা প্রেমের উজান বয় অজয়ে

পৌষের শেষে হিম শীতে….”

ঘুমে-জাগরণে সারারাত কেটে যেত কবিতায়নের আসরে। সকালবেলায় ঝোড়ো কাক হয়ে বাড়ি ফিরতাম। বীরভূমের মানুষ বলেই রক্তে মিশে আছে বাউলের টান। তাই জয়দেব-কেন্দুলি, নানুরের চণ্ডীদাসের ভিটেতে বারবার ছুটে যাই। অজয় নদীতে যেখানে জয়দেব স্নান করতে নেমে রাধার মানভঞ্জন এর জন্য কৃষ্ণের কী করণীয় ভাবছিলেন, সেদিন স্বয়ং কৃষ্ণ জয়দেবের বেশ ধারণ করে লিখে দিয়েছিলেন :‘স্মরগরল খণ্ডনং, মম শিরসি মণ্ডনং, দেহি পদপল্লব মুদারম’ (তোমার গরল নাশকারী চরণপদ্ম আমার মাথায় দাও, আমার দেহমনের বিরহ শীতল হোক)। সেই ঘাটে গিয়ে কিছুক্ষণ উদাস হয়ে বসি। জয়দেবের মন্দির দর্শন করি। ভক্তিভবনে গিয়ে বাউল গান শুনি। তেমনি নানুরের সেই পুকুর ঘাট দেখি, যে পুকুর ঘাটের বড় পাথরে বসে রামি কাপড় কাচতেন আর চণ্ডীদাস ছিপ ফেলে বসে থাকতেন। যে প্রেম তাঁকে দিয়েই লেখানো হয়েছিল: ‘কলঙ্কী বলিয়া ডাকে সব লোক তাহাতে নাহিকো দুখ/ তোমার লাগিয়া কলঙ্কের হার গলায় পরিতে সুখ।’ সেই পুকুর ঘাটে গিয়ে অনুভব করি চণ্ডীদাসকেও। শান্তিনিকেতনে ছড়িয়ে আছেন রবীন্দ্রনাথও। ছাতিম গাছের নিচে দাঁড়ালে এখনো তাঁকে মনে মনে ডাকা যায়। আলাপ করা যায়।

—কেমন আছ কবি?

—যেমন থাকে অভিমানের মানুষ! যেমন সবাই নীরব সমাচারে ডুবে থাকে।

—কত ফাল্গুন আসে আর যায়। নীরব কোকিল ডাকে। তুমি লিখে চলো মহাকালের কবিতা।

—তাই বুঝে নাও। তাই বুঝে নাও। জীবন এখানে বহু জীবনের ভিড়ে আজও বয়ে চলে।

—এখানে দাঁড়ালে সেই তো টের পাই:

“বৃথা চেষ্টা রাখি দাও। স্তব্ধ নীরবতা

আপনি গড়িবে তুলি আপনার কথা।

আজি সে রয়েছে ধ্যানে—এ হৃদয় মম

তপোভঙ্গভয়ভীত তপোবনসম।

এমন সময়ে হেথা বৃথা তুমি প্রিয়া

বসন্তকুসুমমালা এসেছ পরিয়া,

এনেছ অঞ্চল ভরি যৌবনের স্মৃতি—

নিভৃত নিকুঞ্জে আজি নাই কোনো গীতি।”

তুমি যেন উচ্চারণ করে চলেছ একাকী ভূমণ্ডল জুড়ে।

সেই শান্তিনিকেতনে একান্ত উপলব্ধির দরজা খুলে রবীন্দ্রনাথকে ডাকতে থাকি। রবীন্দ্রনাথকে স্পর্শ করতে পারি। কিছুটা নীরবতায় ধ্যানের সম্মোহনে তাঁকে জাগাতে পারি।

মনে পড়ে যায় বীরভূমের ভাঙা পথের রাঙা ধুলোয় সাইকেল চালিয়ে বহুদূর চলে গেছি। কোথাও কবিগানের আসর, তো কোথাও বাউল গানের আখড়া। রামায়ণ-মনসামঙ্গল-কীর্তন তো আমার চারিপাশ জুড়ে। একবার গাবগুবি বেজে উঠলে আর ঘরে থাকতে মন চায় না। মৃদঙ্গের তালে তালে মন নৃত্য শুরু করে দেয়। চারণ কবি গুমানি দেওয়ান একবার গান করতে এসেছিলেন নারায়ণপুর গ্রামে। তখন চার বছর বয়স। বাবার ঘাড়ে চেপে সাত মাইল রাস্তা অতিক্রম করে সেই গুমানি দেওয়ানের আসরে উপস্থিত হয়েছিলাম। গান শুনতে শুনতে শুয়ে পড়েছিলাম আসরেই। সাদা সাদা বড় বড় গোঁফওয়ালা মানুষটির ভরাট গলার আওয়াজ এখনো আমি আমার অবচেতন মনে শুনতে পাই:

“এই গানের আসরে কত মানুষ আসেরে

মানুষ তবে খুঁজতে হয় এই মানুষের ভিড়ে।

অর্থ সম্পদ টাকাকড়ি যতই থাকুক ভাই

মান আর হুঁস না থাকিলে মানুষ কেহ নয়।”

সুরের মাধুর্যে গানের মরমি বার্তা কানের ভিতর দিয়ে হৃদয়ে প্রবেশ করেছিল। ঢোল-তবলা সহযোগে সেই গানের পরিবেশনায় আমার অন্তর উদ্বেলিত হয়ে উঠেছিল। কখন ঘুমে ঢলে পড়েছিলাম বুঝতে পারিনি।

কলেজে পড়ার সময় একখানা সাইকেলই আমার একমাত্র বাহন ছিল। ট্রেন-বাসের ভরসা না করেই সকাল সকাল বেরিয়ে পড়তাম। অনেক দূরের পথ হলে রাস্তার ধারে কোনো চায়ের দোকানে বসে চপ-মুড়ি খেয়ে এক কাপ চা পান করে আবার রওনা হতাম। তখন বীরভূম ছাড়াও মুর্শিদাবাদের খড়গ্রাম, কান্দি, নবগ্রাম, গোকর্ণ, নগর, কর্ণসুবর্ণ, আলিনগর প্রভৃতি কত কত গ্রামাঞ্চলে যে ঘুরেছি তার হিসেব নেই। সব জায়গা থেকে একদিনে ফিরতেও পারতাম না। সব জায়গাতেই কিছু আমার মতো সাহিত্যপাগলকে পেয়ে যেতাম। আর নিজেরাই নিজেদের লেখা পাঠ করে আলোচনা করতাম। ঘাড়ে একটা সাইড-ব্যাগে কবিতার পাণ্ডুলিপি, উসকো-খুসকো চুল, না আছে পরিপাটি পোশাক-আশাক। এক ধরনের শব্দভিখারি হয়েই যেন ভিক্ষা করতে বেরিয়েছি। তখন যশ-খ্যাতির প্রতি আগ্রহ ছিল তা কিন্তু নয়। কবিতা লিখে কী পাব সে বিষয়েও ভেবে দেখিনি। কী এক অনির্বচনীয় টান ছিল তা বলতে পারব না। সারাদিন খাবার না জুটলেও তেমন কষ্ট হত না। মফসসলের ছোটখাটো পত্রিকাগুলি একটা লেখা ছাপলেই আনন্দে আটখানা হতাম। পত্রিকাটা হাতে নিয়েও গর্ব বোধ করতাম। নিজের মধ্যে এক অফুরন্ত প্রাণশক্তির টের পেতাম। মনে হত পৃথিবীতে কবি-সাহিত্যিকদের থেকে আর কিছুই শ্রেষ্ঠ হতে পারে না। নতুন কবিতার কোনো বই কিনে এনে গোগ্রাসে গিলতে শুরু করতাম। একটা লেখা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বারবার পড়ার অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছিল। রাতের বেলা হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলে আবার একবার উঠে পড়ে নিয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়তাম। কত পত্রিকায় তখন লেখার ইচ্ছে জাগত। কলকাতায় প্রথম ‘দৌড়’ পত্রিকায় লেখা প্রকাশিত হওয়ার পর আরও কয়েকটি পত্রিকায় লিখেছিলাম। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ‘কবিতা কবিতা’।কার্তিক দেবনাথের সম্পাদনায় কলকাতার বাঁশদ্রোণী থেকে প্রকাশিত হত। এখান থেকেই দীপংকর রায়ের সম্পাদনায়ও প্রকাশিত হত ‘এবং কথা’ পত্রিকাও। আজ থেকে ২৫ বছরের অধিক সময় অতিবাহিত হয়ে গেছে। যৌবনের দীপ্ত দিনগুলিতে কীভাবে এই পত্রিকা দুটি আমাকে উৎসাহিত করেছিল সেই অনুভূতি আজও নাড়া দেয়। দেশের ভূখণ্ড ভাগ হলেও মানব হৃদয়ের চিরন্তন ভূখণ্ডের বিভাজন তাঁরা কখনো মানতে পারেননি। মূলস্রোতের বাইরে থাকা গ্রাম গঞ্জের অনামি-অখ্যাত লেখক-কবিদের তাঁরা খুঁজে খুঁজে তুলে আনতেন। আমার সঙ্গে সংযোগ ছিল সেই সূত্রেই প্রাণের সংযোগ।পরম প্রিয়জন হিসেবে তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতায় সর্বদা মন ভরে আছে। কত প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও তাঁরা পত্রিকা বের করতেন তা জানতাম। সেই সময় দারিদ্র্য আর কবিতা আর এই দুই সম্পাদক ও কবির সান্নিধ্য আমার জীবনের পরম প্রাপ্তি।

একাদশ শ্রেণিতে পড়ার সময় ‘কাফেলা’ পত্রিকার গ্রাহক হয়েছিলাম। তখন মাত্র ৫০ টাকায় এক বছরের গ্রাহক হওয়া যেত। নতুন কাফেলা ঠিকানা লেখা কাগজের লেভেলে ডাকযোগে হাতে পৌঁছালে খুব উৎসাহিত হতাম। পাতা উল্টেই প্রথমেই কবিতাগুলি একে একে পড়ে ফেলতাম। কবিরুল ইসলাম, জালাল উদ্দিন বিশ্বাস, রবিউল হোসেন খান, মাহমুদুল হক, আব্দুর রব খান, আবু আতাহার প্রমুখ কবির কবিতায় ভীষণভাবে আকৃষ্ট হতাম। ইবনে ইমাম, মুজতবা আল মামুন আবদুর রাকিবের গদ্য ও গল্পগুলি ভীষণ ভালো লাগত। ‘বাতায়ন’ নামে একটি বিভাগে কাব্য সমালোচনা করতেন আবদুর রাকিব। সেখানে বহু নতুন নতুন কবির কবিতা সম্পর্কে সম্যক ধারণা হত। আব্দুল আজিজ আল আমান লিখতেন ‘কাবার পথে’। তাঁর মক্কা ভ্রমণের চমৎকার বৃত্তান্ত আমার মতো কিশোরকেও আকৃষ্ট করেছিল। বাংলা সাহিত্যে ‘কাফেলা’ পত্রিকাটি শান্ত স্নিগ্ধ পবিত্র একটি আয়নার মতো মনে হত। লেখাগুলি পাঠ করে শুধু আনন্দই নয়, আরামও বোধ করতাম। নিজের লেখার ক্ষুধাও জেগে উঠত। মাহমুদুল হকের লেখায় রহস্যময় চিত্রকল্পগুলিতে যেমন বিচরণ করতাম তেমনি ছন্দের মধ্যেও পুলকিত হতাম। জালাল উদ্দিন বিশ্বাস কোনো আধ্যাত্মিক লোকের সন্নিধানে আমাকে পৌঁছে দিতেন। কবিরুল ইসলাম দিতেন তাঁর জীবন-বাউলের পরিচয়। রবিউল হোসেন খান ‘সুন্দর কাঁপে থরো থরো’ লিখে আমাকে বহুদিন উজ্জীবিত করেছেন। দূর থেকেই মনে হত, আমিও কাফেলার দলের লোক। আমারও দীর্ঘ ছায়া পৃথিবীতে পড়েছে আর কোনো রহস্যময় অন্তর্লোকের ঠিকানায় এগিয়ে চলেছি।

🐦

চলবে…

FA-6.png

তৈমুর খান

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *