এই কবিতাজীবন(ধারাবাহিক)
🐦
পর্ব-১৭
কবিতা প্রেমের, কবিতা কষ্টের,কবিতা শূন্যের
🍁
২০০৩ সালে কবি জয় গোস্বামীর দু-খানা চিঠি পেয়েছিলাম। একখানা চিঠিতে তিনি ‘ঘাসকাটা’ কবিতাটির সুনাম করে লিখেছিলেন, এরকম একটি ভালোলাগার কবিতা থেকে বোঝা যায় কবি অনেকদূর যাবেন। দ্বিতীয় চিঠিটিতে লিখেছিলেন ‘দেশ’ পত্রিকার জন্য আরও কিছু কবিতা পাঠাতে। তখন মোবাইল ছিল না। ‘দেশ’ পত্রিকার খামেই দুটি চিঠি এসেছিল। কয়েকটি কবিতা সেই সময় পাঠিয়েছিলাম। তখন শারদীয় সংখ্যা বেরোনোর কিছুদিন আগের মুহূর্ত। তাই পাঠানো কবিতা থেকে সবচেয়ে ছোট কবিতাটিই শারদীয়া ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। কবিতাটি এখনো কোনো সংকলনের অন্তর্ভুক্ত হয়নি। কবিতাটি ছিল:
“সম্রাট
🍂
তুমি খুব ভাল মেয়ে বাড়িতে তোমার আলোচনা
তবুও তোমাকে প্রেম জানানো হলো না।
টেলিফোন করতে ভয়, চিঠিও লিখি না—
তোমাকেই মনে মনে রাত, সারারাত…
জ্যোৎস্না ক’রে ঝরিয়েছি মেসের সম্রাট।”
হ্যাঁ, কবিতাটির নাম ছিল ‘সম্রাট’। ব্যর্থ প্রেমিক ঠিক বলা যায় না, কিন্তু প্রথম প্রেম যার জন্ম হৃদয়ের মধ্যেই। যা প্রকাশ উন্মুখ, কিন্তু প্রকাশ করতেও ভয়। তাই জোৎস্নার মধ্যেই প্রেমিকাকে খুঁজে পাওয়া। সম্রাট শাহজাহান তাজমহল নির্মাণ করেছিলেন শুধু প্রেমের কারণেই। কিন্তু মেসের সম্রাট? তার তো ছাত্রজীবনই শেষ হয়নি। তার মাঝেই প্রেম এসে হানা দিয়েছে। বাড়িতেও সেই মেয়েটিরই আলোচনা। সবকিছু সহ্য করেই নিজেকে উদাসীন প্রেমিক হিসেবেই ঘোষণা করেছিলাম। আর সেই কবিতাটিই ‘দেশ’ পত্রিকার জন্য নির্বাচিত হয়েছিল। চিলির কবি পাবলো তাঁর একশো প্রেমের সনেটের একটি অংশে লিখেছেন :
“Green was the silence, wet was the light,
the month of June trembled like a butterfly.”
অর্থাৎ সবুজ ছিল নীরবতা, ভেজা আলো,
জুন মাস প্রজাপতির মতো কেঁপে উঠল।
প্রেমের সঞ্চার হলে প্রকৃতির মধ্যেও প্রাণ ফিরে আসে। আনন্দের পরিচয় তো তখনই পাওয়া যায়। রোমান্টিক ইচ্ছার জাগরণে আত্মস্ফুরণ এভাবেই ঘটে। কলেজে থাকাকালীন রঙিন উঠতি যুবতীর চোখে চোখ পড়লে ভেতরটা কেঁপে ওঠে। কথা হারিয়ে যায়। ক্লাস থেকে বেরিয়ে এসে অনেকক্ষণ ভাবতে থাকি। কলেজ বন্ধ হলে আর দেখা হবে না। ছাত্রীকে ভালোবাসার কথা বলাও যাবে না। তাহলে চিঠিও কি লেখা যাবে না? কিন্তু ঠিকানাই বা কোথায় পাব? ঠিকানা তো চাওয়া যেতে পারে! এসব ভাবনা ভাবতে ভাবতেই কখন লিখে ফেলি:
“গাঁয়ের মেয়ে বাংলা অনার্স পদাবলীর রাধা
তোমার চোখে চোখ রেখে মনের ভিতর ধাঁধাঁ।
অশান্তি আজ নিজেই আমি নিজের ঘরে আগুন
বাংলা অনার্স,যখন তখন ডাকিস কেন এখন?
ক্লাসরুমে বর্ষা নামে বিদ্যুৎ আর ঝড়
বুকের মাঝে অথই সাগর কেমনে অভিসার!
বাংলা অনার্স, চিঠি লিখিস, চিঠিতে ঠিকানা
বাংলা অনার্স,পুজোর ছুটি দেখা আর হবে না।”
‘আঙিনার মাঝে বঁধুয়া ভিজিছে দেখিয়া পরান ফাটে’ যদি এরকম কখনো হয়, তাই বৈষ্ণব পদাবলীর কৃষ্ণের অভিসার যাত্রা হয়ে উঠেছে ক্লাসরুম। বুকের ভেতর কষ্টকে লালন করেও কষ্টকে বলা যায় না। আবার কষ্টেরও সুখ আছে, কেননা প্রেমের কষ্ট হাসিমুখেই বরণ করা যায়। ‘ভালোবাসি বলব না কখনো’ এ তো সত্যি কথাই, প্রকৃত ভালোবাসা তো বলাও যায় না। তাই জ্যোৎস্নায়, রোদ্দুরে, বৃষ্টিতে, নক্ষত্রে, আকাশে-নিসর্গে সেই ভালোবাসাকে খুঁজে পাওয়া যায়। রোদে রোদে টিউশনি করে এসে বিবাহিতা প্রেমিকার জানালার পাশে উটের মতো দাঁড়িয়ে থাকা যায়। অনেক কষ্ট গোপন করেও মুখে বলা যায় ‘হ্যাঁ খুব ভালো আছি’। প্রেমিকার সঙ্গে শেষ সংলাপ যখন এরকমই:
—অবশ্যই যাবেন আমার বিয়েতে!
—তা তো যেতেই হবে, শেষ দেখাটুকু দেখার চেষ্টা করব।
—শেষ কেন? তারপর কি আর দেখা হবে না?
—হয়তো হবে, কিন্তু আমার স্বপ্নের কুমারীকে আর দেখতে পাব না। হয়তো সে অন্য পুরুষের পাশে, কিংবা অন্যের সন্তান কোলে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে হন হন করে চলে যাচ্ছে। দেখা হলে দূর থেকে বলবে, ‘কেমন আছেন?’ আমি জানাব, ‘হ্যাঁ আমি খুব ভালো আছি!’
—আমাকে মনে থাকবে?
—মনে তো রাখিয়েই চলে যাচ্ছ, জানোই তো, কতটা মন তুমি দখল করে নিয়েছিলে!
—সবকিছু ভাগ্যের উপর ছেড়ে দিন। ইচ্ছে করলেও কিছু হয় না। ভাগ্যে থাকতে হয়।
—সবাই তো ভাগ্যের উপর দোহাই দিয়েই নিজের ত্রুটি ঢাকতে চায়। এটাই মানুষের কর্তব্য ভাবে।
—তা আপনি বলতে পারেন। আমি ভাগ্য মানি। ভাগ্যে নেই তাই হয়নি।
—তুমি ভাগ্যবতী হও এটাই আমার শেষ আশীর্বাদ।
তারপর সে চলে যাবে। যেতে যেতে একবার পেছন ফিরে তাকাবে। তারপর অনেক দূর চলে যাবে। আর দেখা যাবে না। বাড়ি ফিরে এসে সেদিন আর কিছুই খাবার পেটের মধ্যে ঢুকবে না। রাত্রে ভালো ঘুম হবে না। আত্মহত্যার পরামর্শ বারবার জেগে উঠবে। জীবনের সঙ্গে তার ঝগড়াও হবে। শেষপর্যন্ত জীবন জিতবে। কিন্তু জীবন অনেকটা দুর্বল। ক্লান্ত বিপন্ন সর্বহারার মতো। অসহায় দৃষ্টিতে চেয়ে থাকবে কোনো দূরাগত দুর্গম রহস্যের দিকে। তারপর কবিতারা আসবে। কবিতারা এসে খুব বোঝাবে। সারারাত বোঝাবে। গরম মাথায় কত নক্ষত্রের সমাগম মনে হবে। শব্দেরা ফুটে উঠবে। ছোট ছোট শব্দেরা জোনাক পোকার মতো জ্বলজ্বল করবে। সবাই পথ দেখিয়ে স্তব্ধতার দিকে নিয়ে যাবে। তখন প্রেমিকা সত্তার অদৃশ্য আবির্ভাব টের পাব। রুমির কথার সঙ্গে আমার কথাও একই রকম শোনাবে:
“Out beyond ideas of wrongdoing
and rightdoing there is a field.
I’ll meet you there.
When the soul lies down in that grass
the world is too full to talk about.”
অর্থাৎ
“অন্যায় ও ন্যায়ের ধারণার বাইরেও
একটি ক্ষেত্র রয়েছে।
আমি তোমার সাথে সেখানে দেখা করব।
যখন আত্মা সেই ঘাসে শুয়ে থাকে
তখন পৃথিবী কথা বলার জন্য খুব পূর্ণ হয়।”
তখনই তো একজন কবির জন্ম হয়। তার শূন্যতা থেকেই বেরিয়ে আসে কবিতা। হৃদয় শূন্য অথচ পৃথিবী পূর্ণ। কিছুই নেই অথচ কত কিছু আছে। কত কথা একা একা বলে যেতে হয়। একা একা শুনতে হয়। একা একা উত্তর দিতে হয়। তখন সব কবিতাই শূন্যের কবিতা।
“শূন্যের কবিতা
🍂
রাস্তা খুঁজেছি শুধু, কোথাও রাস্তা আছে?
কত হৃদয় ভেসে গেল প্রেম নেই বলে
কত জ্যোৎস্না ফিকে হল, কেউ এল না আর
সমস্ত জীবন শুধু বিরহের একটি কবিতা
কয়েকটি দিন স্মৃতির বারান্দায় নেমেছে পাখি
দেখেছি তাদের ঠোঁটে মুহূর্তের আলো ওঠে জ্বলে
বিচিত্র নকশার ডানায় উড়ানের চিহ্ন লেগে আছে
কখনও কখনও চোখের কোণে দিগন্তের ভাষা
পড়তে পড়তে সম্মোহন তীব্র হয়ে গেছে
আসঙ্গ লিপ্সার হাতছানি অনুভব করে
বারবার ডেকেছি তাদের নাম ধরে
এজগতে কোন্ পাখি বলো খাঁচা ভালোবাসে?
অনেক বৃষ্টির দিন, অনেক রোদ্দুরের দিন
একা একা ঘর-বাহির করে নিরন্তর উদ্বেগে
স্তব্ধতায় নিজেকে মেলেছি আরও গভীর স্তব্ধ হয়ে
নিজের আঙুল ধরে নিজে অপেক্ষায় থেকেছি
শূন্যের কবিতা হয়ে আজ নিরুচ্চার শব্দের কাছে
এই অনন্তে শুধুই শূন্য হয়ে গেছি, আর কিছু নয়”
🐦
চলবে…
তৈমুর খান