এই কবিতাজীবন (ধারাবাহিক)
🐦
পর্ব-১৫
আয়নার ভেতর তু যন্ত্রণা থেকে খা শূন্যের আত্মসংগ্রহ পর্যায়
🍁
দীর্ঘদিন বেকার জীবন, রুজি-রোজগারের সম্ভাবনাহীন ভবিষ্যৎ। এক অন্ধকারের ভেতর চালিত করে চলেছে। প্রেম এসেও স্থায়ী বসতি গড়তে পারেনি। ন্যাশনাল এক্সচেঞ্জ থেকে চাকরির ইন্টারভিউ লেটার বারবার এসেছে। কিন্তু যেখানেই গেছি—পার্টির লোক নই বলে, মোটা টাকা ঘুষ দেবার সামর্থ্য নেই বলে, হোমরাচোমরা আত্মীয়-স্বজন নেই বলে সহজেই সেখান থেকে বিদায় জানিয়েছে। সব স্বপ্ন প্রায় অধরা। ১৯৯৮ সালে আংশিক সময়ের অধ্যাপনায় নলহাটি হীরালাল ভকত কলেজে নিযুক্তি পেলেও সামান্য বেতন তাতে কিছুই হয়নি। সুতরাং টিউশনি করাই একমাত্র পথ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেই জীবন যন্ত্রণার মুহূর্তগুলিই কবিতায় লিপিবদ্ধ হয়ে চলেছে। ২০০২ এর নভেম্বরে ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে ‘ঘাসকাটা’ কবিতা। জীবনের সত্য উচ্চারণে এক অবিচল কবিতা:
“দু’বেলাই ঘাস কাটি মজুরের ছেলে
কাঠখড়ের উষ্ণতায় রাত্রি করি পার
তবুও পার্টির লোক আমার দরজায়
না বাপু ,কামাই হলে আমিই উপোস
কী খাই, কী খাই সারাদিন….
মিছিলের লাল ধুলো, ঘুরবে আকাশ
আর একটু দাঁড়াও কার্ল মার্কস,
কয়েক শতাব্দী আরও কেটে নিই ঘাস।”
আমার প্রাণের আকুতি, কষ্ট, স্বপ্নভঙ্গ, অভাব সবই এই কবিতাটিতে ধরা আছে। আমি পার্টির লোককে সত্যিই একদিন বলেছিলাম, মিছিলে গেলে আর খেতে পাব না। সারাদিন বীরভূমের লাল ধুলো মেখে আমাকে ঘুরতে হবে। মিছিল করেও আমাদের অবস্থার কোনো পরিবর্তন আসবে না। কবিতাটি সেই অন্তর্জ্বালার সত্যতা থেকেই লেখা। এই সময় থেকেই বামপন্থী শাসনের অন্তঃসারশূন্য গর্জন সকলের কাছেই প্রতিভাত হতে থাকে। এবং পরবর্তী সময়ে তা প্রায় ভেঙে পড়ে। কবিতাটি যে একটা রাষ্ট্রীয় ইতিহাসের পটপরিবর্তনের ইংগিত হয়ে উঠেছিল তা অনেকেই স্বীকার করবেন।
সত্যি কথা বলতে গেলে কী, প্রকৃত কবিতার জন্ম তো কোনো সত্যতাকেই অবলম্বন করে। এই সত্যতা জীবনের চরমতম অভিজ্ঞতা, যেখানে দুঃখ কষ্টের ছোবলগুলি প্রতিনিয়ত ক্ষত সৃষ্টি করে। কয়েক বস্তা ঘাস কাটতে হত আমাকে রোদে জলে ভিজে না-খেয়ে। তা মাথায় করে বয়ে এনে গেরস্থ বাড়িতে দিতে হত। তারপর আঁচল পেতে নিতে হত গম অথবা খুদ।
শীতকালে অথবা বৃষ্টিদিনে বাড়িতেও থাকার তেমন জায়গা হত না। তালপাতার ও খড়ের ছাউনি দেওয়া ঘরে শীত ঢুকত অথবা বৃষ্টি। জ্বালানির জন্য কাঠ-পাতা জমা করে রাখতাম। অথবা খড় বিছিয়ে তার উপর শোয়ার ব্যবস্থা হত। দিন আনি দিন খাই লোকের বাড়ি। সেখানে কুকুর বেড়ালের আনাগোনা। কিন্তু পার্টির লোক মিছিলের জন্য আসত। সরাসরি এ কথাই কবিতায় উপস্থিত হল। আর শেষ দু লাইনে সমাজতাত্ত্বিক কার্ল মার্ক্সের উল্লেখ করে আরও গভীর ভাবে উচ্চারণ করা হল জীবনের ক্ষুন্নিবৃত্তির কথা। তিন দশক ধরে বামপন্থী শাসনের আস্ফালন দেখে দেখে আমাদের হৃদয়বৃত্তির আকাশ ক্রমশ ঊষর মরু হয়ে উঠেছিল। কবিতাটি সেই নিহিতার্থেই পুষ্ট হয়ে উঠেছে।
আমার প্রিয় কবিতার মধ্যে এটি যে অন্যতম, তার কারণ আমার দীর্ঘশ্বাস । আমার অসহায় জীবনের আত্মধ্বনি বা আর্তধ্বনি এবং অপশাসনের রাষ্ট্রীয় প্রতিভাস কবিতাটির দর্শনে উঠে আসে। খুব কম কথা বলেও একটা যুগের অমোঘ নির্ঘোষ হয়ে থাকবে কবিতাটি। ব্যক্তির ইতিহাসে, সময়ের ইতিহাসে , রাষ্ট্রের ইতিহাসে এবং সমাজতাত্ত্বিক দর্শনে কবিতাটির উচ্চারণ শোনা যাবে। অক্ষরবৃত্তের চালে ব্যঞ্জনাবহ সহজ সাবলীল শব্দ প্রয়োগে এবং নাটকীয়তায় কবিতাটির আত্মাকে খুঁজে পাওয়া যাবে। সময়লিপির ভেতর অস্তিত্বের পরিমাপটিই বুঝিয়ে দিয়েছে কবিতাটি।
তখন ২০০৪ সাল। বইমেলা প্রায় আসন্ন। শ্যামচাঁদ বলল: ‘আবার একটা সংকলন হবে। আর এবার হবে শুধু প্রেমের কবিতা।’ আবার কবিতা বাছাইয়ের পালা চলল। শ্যাম বেছে নিলে ৫৬ পৃষ্ঠা কাব্যের প্রেমের কবিতা। কবিতাগুলি লিখেছিলাম ১৯৯৫ থেকে ২০০০এর মধ্যে। প্রচ্ছদ আঁকলেন বন্ধু ফাল্গুনী ভট্টাচার্য। যথারীতি রামপুরহাট বই মেলায় প্রকাশিত হল। স্টলে বেশ কয়েকদিন আছি। মাত্র কুড়ি টাকা দাম। ছাত্র-ছাত্রী, অধ্যাপক-অধ্যাপিকা সবাই কিনলেন।৩০০ কপি একদম কয়েক দিনেই শেষ। কাঞ্চিদেশ প্রকাশনী মাথা তুলে দাঁড়ালো প্রকাশনার জগতে। বইয়ের ভূমিকায় লিখলাম:
“তোমাকে প্রেম লিখে দিচ্ছি যত ইচ্ছে সাধ। স্বপ্নে কাঁদা ও প্রেম তোমার মাথার দিব্যি থাক। শরৎ ফেটে রঙ্ বেরোচ্ছে। বুক ফেটে কথা। শব্দ ফেটে ওম বেরোচ্ছে। দারুণ কবিতা। হারিয়ে যাচ্ছ। আবার আসছ। গান বন্ধ।
দরজা খুলে বেরিয়ে যাচ্ছে। যেদিক ইচ্ছে। দু চোখ অন্ধ।
অন্ধ যাচ্ছে। মুখ দ্যাখে না। পথ দ্যাখে না। চারপাশে বসানো আয়না।আয়নার ভেতর তু যন্ত্রণা!
কী বলছে সে? বলার কী ঢঙ্! কেউ বোঝে না!
আসলে প্রেম বেজে ওঠে। তার বাজনার ব্যাখ্যা হয় না।
মেঘ বাজছে। বৃষ্টি বাজছে। তারপর নদী। কলার ভেলা ভেসে যাচ্ছে। যদি। ভেলায় কার লাশ?”
সেদিন ভেলায় প্রেমের লাশই ভেসে যাচ্ছিল। হাজারো দংশন খাওয়া প্রেম। বিষে বিষে তার নীল দেহ। প্রেমের মৃত্যু যে বড় যন্ত্রণার মৃত্যু তাই কাব্যের কবিতায় বারবার উচ্চারিত হয়েছে।
অবশ্য তার আগেই ২০০৩ সালে প্রকাশিত হয়েছিল ‘খা শূন্য আমাকে খা’ কাব্যটি কাঞ্চিদেশ প্রকাশনী থেকেই। কিন্তু দুটি কাব্যের কবিতাগুলি প্রায় একসঙ্গেই একই সময়ে লেখা হয়েছিল। শ্যামচাঁদ বাগদিই কবিতা বেছে নিয়েছিল বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত কবিতাগুলি থেকে। যখন নিজের অস্তিত্বই খুঁজে পাচ্ছিলাম না, প্রেমের মধ্যেও কোনো স্বপ্ন দেখতে পাইনি, নিজের কোনো পরিচয়ও নেই , আত্মঅন্বেষণে তখনই এক শূন্যবাদের বাজনা শুনতে পেয়েছিলাম। এক মোহছিন্ন বিপন্ন জীবনের ভারে ঢলে পড়া ইতিহাসই কবিতার বোধে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। শুধু বস্তুগত না পাওয়া ব্যাপারটিই ছিল না, আত্মগত ঈশ্বরেরও অনিশ্চয়তা যা আত্মবিশ্বাসকে ভেঙে চুরমার করে দিয়েছিল। তখনই মনে হয়েছিল এক বিরাট বিস্ময়কর শূন্যতা গ্রাস করছে। এখান থেকে পালাবার কোনো পথ নেই। সেই সংকটাপন্ন মুহূর্তটিই উপলব্ধি হয় এই কাব্যের কবিতায়। ‘মস্তিষ্কের জীব’ কবিতায় লিখেছিলাম:
“জীবনের বিপরীত দিকে হাঁটতে হাঁটতে এক ভিন্ন গ্রহে চলে যাই আমি
মানুষের মস্তিষ্কের জীব অরণ্যের অন্ধকারে সেখানে ঘোরে ফেরে— প্রেম-ট্রেম সব ফালতু,মান-অভিমান বলে কিছু নেই
আকাশ পোড়ানো গন্ধ, সারি সারি আলো এরকম নরম সূর্যের দেশ— মানুষীর সাদা মুখ সেখানে থাকে না
তবুও বিরামহীন সেখানেও আয়ু কাঁদে— কেঁদে কেঁদে নিটোল বর্ষায় মস্তিষ্কের জীবকে ভাসায়—”
জীবনের বিপরীত দিকেই চলা শুরু হয়েছিল, যেখানে পৃথিবী নয়, ভিন্ন এক গ্রহ। শুধুমাত্র মস্তিষ্কের জীব সেই গ্রহের অরণ্যের অন্ধকারে ঘোরে ফেরে। পার্থিব শরীরের প্রেম বা কামনা সেখানে তার কোনো মূল্য নেই। মাথার ওপর যে আকাশ পুড়ে গেছে, সে আকাশ তো বৃষ্টিহীন। তাই নরম সূর্যের দেশ এবং মানুষীর সাদা মুখ সেখানে থাকে না। তবুও বিরামহীন আয়ু কেঁদে কেঁদে বাঁচার প্রয়াস চালায়। অশ্রুর বর্ষায় ভেসে যায় মস্তিষ্কের জীব। জীবনের এই ভিন্নতা, এই শূন্যতার বোধ নিয়েই ‘খা শূন্য আমাকে খা’।
২০০৭ সাল। তখন উত্তর ২৪ পরগনার বনগাঁ খুব ঘনঘন যাতায়াত করছি। ‘তবু অভিমান’ পত্রিকার সম্পাদক শঙ্খশুভ্র দে বিশ্বাস উঠতি কবি। খুব আগ্রহ নিয়ে পত্রিকা প্রকাশ করেন এবং আমার লেখাও প্রায় প্রতি সংখ্যায় প্রকাশ করেন। তিনি ইচ্ছা প্রকাশ করলেন একটি আত্মজীবনীমূলক গদ্যের বই হোক। শুনে অবাক হলাম—আমার এই ছেঁড়াখোঁড়া জীবনের কী হবে আত্মজীবনী! শঙ্খশুভ্র জোর দিয়ে বললেন: ‘তা হোক না! দেখা যাক কী হয়!’ সেই সূত্রেই বনগাঁ যাওয়া-আসা বেড়ে গেল। নিজের জীবনের টুকরো টুকরো ঘটনা নিয়ে বেশ কয়েকটি নিবন্ধও বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। সেগুলি সংগ্রহ করে তাঁকে দিলাম। নাম হল ‘আত্মসংগ্রহ’। মোট সতেরোটি নিবন্ধ।
শঙ্খশুভ্র দে বিশ্বাসের বাবা একজন শিক্ষক। মা গৃহকর্ত্রী। ছোটখাটো সংসার। গাছপালা ঘেরা নির্ঝঞ্ঝাট একটা বাড়ি। বহরমপুর হয়ে বাস ধরে তাঁর বাড়ি পৌঁছাই। কাব্য-কবিতা লেখাজোখা নিয়ে তাঁর বাবা-মার সঙ্গেও অনেক কথাবার্তা হয়। উঠে আসে নানা প্রসঙ্গ। বনগাঁর ঐতিহাসিক ঐতিহ্য এবং বিভূতিভূষণের অনেক কথা জানতে পারি। কত পত্রপত্রিকার জন্ম হয়েছে এখানে সেই ইতিহাসও আলোচনায় উঠে আসে। ইতিপূর্বে ‘কবিতা আশ্রম’ এবং ‘এবং রাহী’র সম্পাদকও আমার পূর্ব পরিচিত। তাঁদের পত্রিকায়ও বহুবার লিখেছি। এখানেই পরিচয় ঘটে তরুণ কবি সব্যসাচী মজুমদার এবং সঞ্জয় ঋষির সঙ্গে। স্বাভাবিকভাবেই একটা অন্তরের টান অনুভব করি। রাত্রে শঙ্খশুভ্রের বাড়িতেই খাওয়া-দাওয়া করে থেকে যাই। কখনো লোকাল ধরে কলকাতাও ঘুরে আসি। পরেরদিন বাড়ি ফিরি।
শঙ্খশুভ্র বয়সের দিক দিয়ে খুবই নবীন, কিন্তু সাহিত্যের মূল্য তিনি অনুধাবন করতে পারেন। আমার গদ্যের প্রতি তাঁর একটা আকর্ষণ ছিল। তাই সেগুলিকে পুস্তকাকারে প্রকাশ করারও ইচ্ছা জেগে ওঠে। আমিও বরাবরই চাইতাম, আমার বই কোনো লিটিল ম্যাগাজিন প্রকাশনা থেকেই প্রকাশ হোক। যে আন্তরিকতা নিয়ে শঙ্খশুভ্র কাজটিতে অগ্রসর হয়েছিল তা কোনোদিন ভুলতে পারব না। তাঁর আগ্রহ না থাকলে হয়তো এগুলি পুস্তকাকারে বের করার কথাও ভাবতেই পারতাম না। কিন্তু দুঃখের বিষয়, শঙ্খশুভ্রের বাবাকে মাত্র দু বার দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। তৃতীয়বারে তাঁর বাড়ি গিয়েই জানতে পারি, তিনি হার্টঅ্যাটাকে ইহলোক ত্যাগ করেছেন। বাবাকে হারিয়ে শঙ্খ বেশ কিছুদিন দিশেহারা হয়ে পড়েন। অভিভাবকহীন একজন উঠতি সাহিত্যিকের মাথায় যেন বজ্রাঘাত হয়। তবুও অদম্য প্রাণশক্তিতে তিনি পিছিয়ে আসেননি। আমার এই গ্রন্থটি প্রকাশ করেছিলেন। প্রদীপের আলোর সামনে আমাকে বসিয়ে নিজেই ক্যামেরা ধরে বইয়ের প্রচ্ছদের ফটো করেছিলেন। সেই বইটি বার্ণিক প্রকাশনা থেকে তৃতীয় সংস্করণ হয়েছে। পাঠকদের উত্তরোত্তর চাহিদায় আমিও অভিভূত। পরবর্তী সংস্করণগুলিতে নিবন্ধের সংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়েছে। পাল্টে গেছে প্রচ্ছদগুলিও।
বইটি উৎসর্গ করেছিলাম প্রিয় কবি জয় গোস্বামীকে। বইটির প্রথম সংস্করণের সমালোচনা লিখেছিলেন আর এক তরুণ কবি ও সম্পাদক ফারুক আহমেদ। কী লিখেছিলেন তিনি?
মোটকথা ১৭ টি নিবন্ধই ফারুকের হৃদয়ে দাগ কাটে তা বলাই বাহুল্য। এক মানবিক পৃথিবীর অনুসন্ধান তিনি দেখতে পান। নিজের জীবনের বেড়ে ওঠা, দারিদ্র্য পীড়িত হয়েও জীবনের অনুরাগ ও স্বপ্নকে লালন করা, এবং সমাজের কাছে তথা রাষ্ট্রের কাছে হেরে না যাওয়া এক সংগ্রামী উত্থানই গদ্যগুলির মূল বৈশিষ্ট্য। ধর্মের ভেক সরিয়ে মানবিক চৈতন্যের পথে আহ্বান জানানোই গদ্যগুলির মূল দর্শন।
‘আত্মসংগ্রহ’ গদ্যের বইয়ের সঙ্গে ৩২ পৃষ্ঠার একটি কাব্য সংকলন ‘একটা সাপ আর কুয়াশার সংলাপ'(২০০৭)ও প্রকাশ করেছিলেন শঙ্খশুভ্র। কাব্যটির প্রচ্ছদে এঁকে ছিলেন বাসুদেব মণ্ডল। ১৯৯৮ থেকে ২০০৬ সময়কালে কবিতাগুলি লিখেছিলাম। কাব্যটি উৎসর্গ করেছিলাম শ্রীশঙ্করলাল রায়কে। টিউশনি করা মুহূর্তগুলিতে শ্রীশঙ্করলাল রায়ের শাঁখা-চুড়ির দোকানেই গিয়ে বসতাম। নতুন কবিতা লেখা হলে তাঁকে গিয়ে পড়ে শোনাতাম। কোথাও ছন্দপতন হলে তিনি তা ধরে দিতেন। কালিদাসের ‘কুমারসম্ভব’ থেকে মধুসূদন দত্তের ‘মেঘনাদবধ’ তাঁর অনেকটাই মুখস্থ ছিল। বিদ্যালয়ের কোনো ডিগ্রি তিনি অর্জন করেননি। কিন্তু সর্ব বিষয়েই পারদর্শী ছিলেন। তাই আমাদের অভিভাবকে পরিণত হয়েছিলেন। উৎসর্গ পত্রে লিখেছিলাম: ‘যিনি দুঃখ আর বিষাদের মাঝখানে কবিতায় জীবন খুঁজতে শিখিয়েছিলেন, সেই চিরপ্রণম্য সাহিত্যিক শ্রীশঙ্করলাল রায়কে।’ সময় প্রবাহে নিজেকে একটা বিষণ্ন নদীর মতো মনে হয়েছিল। আর সেই বিষণ্ন নদীতে নিজেই নিজের ছায়ায় ঝুঁকেছিলাম। বকের মতন নিজেকেই ঠুকরে ঠুকরে খাচ্ছিলাম নিজেরই কোনো উপলব্ধির মৎস্য। সমস্ত কবিতাগুলিই আত্মকেন্দ্রিক আত্মবিষণ্ন আত্মবিপর্যয়ের উপলব্ধিময় সাংকেতিক প্রকাশ। সাপ আসলে প্রবৃত্তি যা আদিম প্রহেলিকাময় আত্মস্ফুরণ। কুয়াশা যা অস্পষ্ট অপ্রকাশ্য জটিল সমাধানহীন এক আশ্রয়। প্রবৃত্তি সেই গার্হস্থ্য জীবন থেকেই তার বিস্তার ঘটায়। এর থেকে আমরা মুক্তি পাই না।
চলবে…..
তৈমুর খান