এই কবিতাজীবন (ধারাবাহিক)
🐦
পর্ব-১৪
প্রথম সূর্যোদয় এবং তারপর
🍁
১৯৯৩-৯৪ শিক্ষা বর্ষে মালদহ জেলার সরকারি বিএড ট্রেনিং কলেজে ভর্তি হই। মাসিক ১০০ টাকা ভাতা পাওয়া যাবে বলেই এই কলেজে ভর্তি হওয়ার একমাত্র কারণ ছিল। মালঞ্চ পল্লির হোস্টেলে থেকেই এখানে ট্রেনিং নেওয়া শুরু হয়। বিএড কলেজের বার্ষিক পত্রিকাটি সম্পাদনারও দায়িত্ব পড়ে আমার উপর। অবশ্য তা সুচারুভাবেই সম্পন্ন করি নাগার্জুন ভরদ্বাজ স্যারের সহাতায়। মালদহতে এসেই এক কবি-বন্ধুকে পেয়ে যাই তার নাম রফিকুল হক। থাকে গাজোলে। সেই সময়ে তার কবিতা আমাকে মুগ্ধ করে। ‘মানুষ এবং মানুষ’ নামে তার প্রথম কাব্যে শুধু মানবতাবাদেরই উচ্চকিত ঘোষণা। মাঝে মাঝেই ছুটি পেলে তার বাড়ি চলে যাই। মাটির দেওয়াল টিনের ছাউনি দেওয়া দু’তলা বাড়িতে দু-একদিন কাটাতে বেশ ভালোই লাগে। রফিকুল বেঁটেখাটো মানুষ, কিন্তু অসম্ভব আন্তরিক। গাজোল কলেজে বাংলা ভাষার পার্ট টাইম শিক্ষক। মালদহ কলেজের অধ্যাপক পুষ্পজিৎ রায় সম্পাদনা করতেন ‘জোয়ার’ পত্রিকা। সেই পত্রিকায়ও কয়েকবার লেখার সুযোগ হয়েছে। কিন্তু মালদহতে থাকতেন অনিন্দিতা গুপ্তরায়, দিলীপ তলয়ার তখনো পর্যন্ত এঁদের সঙ্গে পরিচয় হয়নি। কয়েকটি অনুষ্ঠানে তাঁদের দেখেছি মাত্র।আর ছিলেন কবি ও সাহিত্যিক ত্রিদিব গুপ্ত, অসীম গোস্বামী প্রমুখ আরও অনেকেই। পরবর্তীকালে অসীম গোস্বামীর সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘আরণ্যক’ পত্রিকায় অনেক লেখা লিখেছি। এই মালদহতে থাকাকালীনই ১৯৯৪ সালে আমার প্রথম কাব্য ‘কোথায় পা রাখি’ প্রকাশিত হয়। বিএড ট্রেনিং কলেজের হোস্টেলে বসেই দশটা কবিতা লিখে মধুমঙ্গল বিশ্বাসকে ‘দৌড়’ দপ্তরে পাঠাই। এই দশটা কবিতা নিয়েই ‘তরুণ কবিদের প্রথম কাব্য’ হিসেবে ‘দৌড়’ প্রকাশনার উদ্যোগে আমিই প্রথম সুযোগ পাই। সেই কাব্য না বের হলে হয়তো আমার কবিতাজীবনে প্রথম সূর্যোদয়ই হত না। তারপরে থেকে বহু পত্রিকাতেই লেখার আমন্ত্রণ পাই। কিন্তু সব থেকে ঐতিহাসিক ব্যাপার হল একটি পত্রিকা ‘মধ্যবর্তী নির্বাচন’ তিন বছর পর অর্থাৎ ১৯৯৭ সালের ১৫-ই মে কাব্যটি নিয়ে আলোচনা প্রকাশ করল। আলোচনা লিখলেন নিরক্ষর বসু।ছোট্ট পত্রিকাটি হঠাৎ হাতের কাছে পেয়ে তার জীর্ণ পৃষ্ঠা থেকে উদ্ধার করলাম আলোচনাটি। আলোচকের সঙ্গে আমার কোনো পরিচয়ই ছিল না। আজ তাঁকে কৃতজ্ঞ চিত্তে স্মরণ করছি।
“তৈমুর খান: নষ্ট সময়ের পরিভাষা
# নিরক্ষর বসু
চুরানব্বই-এ প্রকাশিত একটি রোগা কবিতা-পুস্তিকা, এই মফস্সলী পাঠকের দরবারে পৌঁছল সাতানব্বই-এর মার্চ মাসে। এই তিন বছরে উক্ত পুস্তিকার কবি ভিন্নমুখী পর্যটনে নিশ্চয়ই অন্য কোনো দিগন্তের দরজায় টোকা দিচ্ছেন—এরূপ আশা, আশা করি অমূলক নয়। তবু তাঁর বিগত পরিক্রমার নির্যাস কীভাবে সংক্রামিত করেছে পাঠকের মেধা ও মননে এই লেখা উক্ত সংক্রমণের তমসুক।
‘কোথায় পা রাখি’ পুস্তিকায় লিপিবদ্ধ কবিতার সংখ্যা দশ।
প্রথম দুটি রচনার নাম—’অপ্রাকৃত স্বপ্ন’ ও ‘ভুল সময়’। এই দুইটি নামকরণের মধ্যে এক বিবাহিত ঐক্য লক্ষ করা যায় প্রথম পাঠেই। এই যাপিত সময় এক নিরুত্তাপ ধারাবাহিকতা, পচা আগুনের সমাবেশ। স্বপ্নহীন নির্বাক মমতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে অনিবার্য এই শব্দ শৃঙ্খলা:
‘আমি ভুল সময়ে ছুটে এসে দরজা খুলতে চেয়েছি’
(ভুল সময়)
সময়টা কেন ভুল? সময়টা কেন এমন অচেনা? উত্তর অনেকটা এরকম:
‘শহরে এসে দেখি, সব মানুষের পিতলের হাত
রুপোর মুখে বড় যান্ত্রিক হাসি
আর পাগুলি লোহার, টায়ারের সঙ্গে
গড়াতে গড়াতে গোল হয়ে গেছে পিচের রাস্তায়’
(তদেব)
দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে সব। চেনা দৃশ্যের এমন রূপান্তর, তার সাথে কোনোভাবেই মেলানো যাচ্ছে না নিজেকে। অথচ অপরিবর্তিত অবস্থায় মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা তো রয়েছে আমাদের। কিন্তু সেই রূপান্তর যদি হয় স্বপ্নের উল্টো স্রোত, যদি হয় অবিশ্বাসী হওয়া, কেননা:
‘এখন শিশির মুছে গেছে
প্লাস্টিকের ঘাসে সাবানের ফেনা
মাথার ওপর যত বিল আর নদী
উদ্ধত মেয়ের মতন স্টিমার
কাকেরাও চুল বাঁধে, আয়নায় মাথা আঁচড়ায়’
(তদেব)
তখনই সঙ্গহীনতার চোরাবালি, বিসর্জনের নৌকা ব্যতীত অন্য কোনো ধ্বনি নেই রক্তের মফস্সলে। শুধু মনের নির্জনে এই দ্বন্দ্বের মুখোমুখি:
‘এই সময় কাউকে ডাকা যায়?
এই সময় কাউকে বলা যায় দুঃখ?
এইসময় বড় ভুল সময়—দেখারাও না-দেখা হয়ে
চোখের সামনে গা ঢাকা দেয়’
(তদেব)
সময় তো বহমান। সাথে সাথে চলে জৈবিক ক্রমবিকাশ:
‘চোখগুলি বেড়ে উঠছে, মুখগুলি বেড়ে উঠছে
হাত-পাগুলি বেড়ে উঠছে’
সংক্ষেপে ‘দীর্ঘ থেকে আরও দীর্ঘ হয়ে উঠছি’। এই জৈবিক বিকাশের পাশাপাশি মেধা ও মননের হাজার দরজা খুলে যাচ্ছে। যাপিত অতীত আর আগামী নিরন্তর প্রশ্নের সম্মুখীন। সময়ের গ্রন্থিগুলিকে শল্য চিকিৎসকের মতো ব্যবচ্ছেদ করে জিজ্ঞাসার মুখোমুখি দাঁড় করাচ্ছে আমাদের:
‘এত শীর্ণ নদী জল কই আমার স্নান হবে?
এত সংকীর্ণ রাস্তা কোথায় পা রাখি?’
(অপ্রাকৃত স্বপ্ন)
জীবনের থেকে অবগাহনের স্বাদ মুছে গেছে। মনীষার গন্তব্য নেই। পথের শেষে নেই উজ্জ্বল দীপাবলি। বিশ্রামের ভূমি এত শক্ত নয় যেখানে স্থাপন করা যাবে নিজেকে। চোখ খুলে ঘুমিয়ে থাকার এই যে মূঢ়তা এনিয়ে কতদূর হাঁটা যেতে পারে? বরং আপাত উজ্জ্বলতার ভ্রান্তি থেকে অন্ধকার ঢের ভালো:
‘এখন সূর্যের সঙ্গে কথা বলতে বলতে জেনে নিচ্ছি
তাকেও একটি ফুঁয়ে নেভানো যায় কিনা’
(তদেব)
সূর্যকে তো নেভানো যায় না, তবু এই হেঁয়ালি প্রয়োজন আমাদের। ভুল সময়ে এক বর্ম—যে আঁধার আলোর অধিক।
‘১৪০০-র টেলিগ্রাফ’ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রচনা। মগ্নতার নিরিখে এই কবিতা পুস্তিকার কেন্দ্রীয় চেতনা। বইটির নামকরণ এবং এই রচনা এক অলিখিত বন্ধনে আবদ্ধ। কবিতা পাঠের শেষে থমকে ভেবে নিতে হয়: ‘কোথায় পা রাখি’—এই নামকরণ এক নিয়তিতাড়িত ঘটনা। লেখাটি শুরু হয় এইভাবে। স্মৃতিতে মেদুর হয়ে আসা দাদু এই টেলিগ্রাফের প্রেরক। তাতে লেখা: ‘তোদের দিন এসেছে’। কীসের দিন? কোন্ সে দিন? দাদু কেন টেলিগ্রাফ পাঠালো এতদিন পর? তাতে শুধু কয়েকটি শব্দ: ‘তোদের দিন এসেছে’। কয়েকটি শব্দ কীভাবে প্রতিক্রিয়া ঘটায় তাঁর পরবর্তী পুরুষের কাছে লক্ষ করুন:
‘খরস্রোতা হয়ে যাচ্ছে সবকিছু। বিশ্বাস করে
বিশ্বাসঘাতক হতে হয়। ভালোবাসায় দৌরাত্ম্য বেড়েছে।
সুন্দরকে এখন সবচেয়ে ভয়। রক্তে আর ভোর নাচে না।’
(১৪০০-র টেলিগ্রাফ)
চোখ খুলে ঘুমিয়ে থাকা যখন একমাত্র ভবিতব্য, সে সময় রক্তে ভোর নাচার স্বপ্ন এক অলীক কল্পনা। কেননা ‘প্রতিটি হাঁটা এখন ব্লাড স্টেপ’। পূর্বপুরুষের অঙ্গুলিনির্দেশ করা পথ কবেই বেঁকে গেছে অন্যদিকে। সহজিয়া ধর্ম (religion) তারও ঘটেছে রূপান্তর। কোন্ সে রূপান্তরে ধর্ম এক শ্বাস নিরুদ্ধ অন্ধ ভয়। তাহলে আশ্রয় কোথায়? জানি না। তাহলে কাকে বলব বেঁচে থাকা? জানি না। না, জানি:
‘স্নান সেরে প্রথম রুকুতে নত হই। দ্রাঘিমায় সংকুচিত
ছায়া। বেঁচে থাকা নির্বেদ নীরক্ত মৃত্যুর পরিভাষা
স্বপ্নের আচমনে জুড়াই বেদনার অতৃপ্তি বিলাস।
অস্তিত্বে বেজে ওঠে সর্বনাশা শতাব্দীর এই টেলিগ্রাফ।’
(১৪০০-র টেলিগ্রাফ)
জীবন যদি হয় নির্বেদ নীরক্ত মৃত্যুর পরিভাষা তবে কি বেঁচে থাকব না? পথ হাঁটব না? ভালোবাসবো না? অবশ্যই বেঁচে থাকব, পথও হাঁটব। আবার নির্জন সন্ধ্যায় নিজেকে তছনছ করে রক্তাক্ত হব। আলো চাইব সমষ্টির। সেই অন্তর্গত তাগিদে দেখতে পাবো বইয়ের প্রচ্ছদে:
কোথায় পা রাখি
তৈমুর খান
যে আয়নায় আমরা মুগ্ধ হতে পারি, সেখানে কিছু আড়াল যখন প্রতিবিম্ব দর্শনে বিঘ্ন ঘটায়; পাঠকের মসৃণ অনুভূতি তখন হোঁচট খেতে বাধ্য। আসলে পাঠক এক নিরপেক্ষ সত্তা। সে যেমন মুগ্ধ হতে জানে, তেমনি জানে নির্মম হতেও। লেখকের যা অসাবধানতা, পাঠকের কাছে তা অসহনীয়। বর্তমান তৈমুর পরিক্রমা শেষ করে কিছু কিছু মুহূর্তে অসহিষ্ণু হয়ে পড়ি এই অসাবধানতায়। ‘সংসারের শেষ পাঠ হতে’ কবিতায় একটি লাইন এরকম:
‘জীর্ণশীর্ণ পোড়া রূপ দীর্ঘদেহী ভিক্ষুকের বেশ’
ঈশ্বরের বর্ণনা করার জন্যে এতগুলি বিশেষণ পাঠাভ্যাসকে কি পীড়িত করে না? বিশেষত ‘জীর্ণ’ শব্দের পরে ‘শীর্ণ’ শব্দের ব্যবহার কবিকে গরিব করে। অথবা ‘১৪০০-র টেলিগ্রাফ’ কবিতায়: ‘অদূরে কুয়াশায় হুইসেল বাজছে’—এখানেও ‘হুইসেলে’র পরে ‘বাজছে’ শব্দের ব্যবহার অপ্রাসঙ্গিক ঠেকে। একটি জরুরি কথা, অসমাপিকা ক্রিয়া ব্যবহারের প্রশ্নে অধিক সতর্কতার প্রয়োজন। পাশাপাশি বইয়ের প্রচ্ছদ এতটা গরিব কেন?
কবিতার মতোই পরবর্তী প্রয়াসের সময় এদিকে দৃষ্টি দেওয়া হবে, এইটুকু আশা রাখি। এইসব ত্রুটির পরেও মুগ্ধতার রেশটুকু পাঠকের অভ্যন্তরে সঞ্চারিত হতে থাকে স্তরে স্তরে। আর সঞ্চারণের ক্ষমতার জন্যে আপনাকে মনে রাখব অনেকদিন। দূর থেকে এই নিরক্ষর পাঠক করমর্দনের জন্যে হাত এগিয়ে দিল, আপনি স্পর্শ করুন।
কোথায় পা রাখি: তৈমুর খান, দৌড় প্রকাশনা, ২, মন্দির লেন, কলকাতা ৭০০০৬৫, মূল্য:তিন টাকা।”
সম্পূর্ণ আলোচনাটি তুলে ধরলাম। একজন তরুণ কবির প্রথম কাব্যের আলোচনা নিশ্চয়ই একটা ইতিহাসের সোপান রচনা করেছিল। কালের আবর্তে কোনো কিছুই ধরে রাখা যায় না। সবই খড়কুটোর মতো ভেসে যায়। এই ভাসমান স্রোতেই হয়তো এটিও একদিন বিলীন হয়ে যাবে।
চলবে…..
তৈমুর খান