Dr. Taimur Khan

এই কবিতাজীবন (ধারাবাহিক)

🐦

পর্ব-১৩

পাটনা ইউনিভার্সিটি

🍁

সুনীলবরণ বন্দ্যোপাধ্যায় স্যারের বাড়িতে হঠাৎ করে একদিন দেখা হয়ে গেল শিবেশ চ্যাটার্জির সঙ্গে। শিবেশ চ্যাটার্জি এসেছিলেন তারাপীঠ মা তারার দর্শনে। তাই সহপাঠী বন্ধু অধ্যাপক সুনীলবরণের সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। ১৯৯০ সালের জুন মাস তখন। অনার্স পাশ করেও শিক্ষা লাভের জন্য আর্থিক সামর্থ্য নেই। তাই টিউশনি পড়ানোকেই জীবিকা হিসেবে বেছে নিতে হয়েছে। আমরা বেশ কয়েকজন সহপাঠী স্যারের কাছে কোনো সুপরামর্শ চাইতে এসেছিলাম। স্যার আমাদের পেয়েই বললেন, ‘তোমরা পাটনা ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে যাও। আমি বলে দিচ্ছি শিবেশকে, তোমাদের সব ব্যবস্থা করে দেবে।’

তারপর শিবেশ চ্যাটার্জির দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, ‘কি শিবেশ, তোমার বাংলা ডিপার্টমেন্টের তুমিইতো প্রধান, তাহলে নিশ্চয়ই আমার ছাত্রদের ভর্তি করে নিতে পারবে!’

আমরা সেদিন শিবেশ চ্যাটার্জিকে প্রণাম করে তাঁর ফোন নাম্বার নিয়েছিলাম এমনকী বাড়ির ঠিকানাও। শিবেশ চ্যাটার্জি মুর্শিদাবাদ জেলার আজিমগঞ্জের লোক। বিভিন্ন কলেজে অধ্যাপনা করেছেন। অবশেষে পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের প্রধান। একমাত্র ছেলে আমেরিকায়। স্ত্রী একটা গার্লস কলেজের লেকচারার। তাঁর কাছে আশ্বাস পেয়েই আমরা পাঁচজন ছাত্র পাটনা ইউনিভার্সিটিতে এমএ ক্লাসে ভর্তি হই। ভর্তির সঙ্গে সঙ্গেই স্যারের প্রচেষ্টায় কয়েকদিনের মধ্যেই হোস্টেল পেয়ে যাই। আমাদের আগের ব্যাচের দাদারা ছিলেন অসম্ভব ভালো। তারা ছিলেন পাকুড়, সাহেবগঞ্জ, মালদহ ইত্যাদি বিভিন্ন জায়গার। নুরুল হক, মইনুদ্দিন, শিবেন, আব্দুল্লাহ আরও অনেকেই। তাদের সাহায্যেই আমরা কখনো অসুবিধায় পড়িনি। অবশ্য পাটনায় পড়ার আরও একটা উৎসাহ পেয়েছিলাম রামপুরহাট সংলগ্ন জয়কৃষ্ণপুর গ্রামের সজ্জন ব্যক্তি মোয়াজ্জেম হোসেন এর কাছ থেকেও। ১৯৬২ সাল নাগাদ তিনি পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএ পাস করে ঢাকার সায়েন্স কলেজে অধ্যাপনায় যোগদান করেন। কিন্তু বাংলাদেশে থাকা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয় না, পাকিস্তানি সেনাদের অত্যাচার এবং খুন-খারাপি তিনি চোখের সামনেই দেখতে পান। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগেই তিনি ভারতে চলে আসেন তাঁর মায়ের কাছে। তাঁর দাদারা অবশ্য বাংলাদেশেই থেকে যান। পরে মুর্শিদাবাদ জেলার নগর হাই মাদ্রাসায় প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব নিয়ে আবার কর্মজীবন শুরু করেন। তাঁর কাছে বসে সেই সময়কার নানা ইতিহাস, মানুষজনের কষ্ট ও হাহাকারের কথা শুনেছিলাম। পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অতীত গৌরবের নানা কাহিনিও তিনি বলেছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই আমার মনের মধ্যেও একটা জায়গা তৈরি হয়েছিল।

আমাকে আমার দাদুর দেওয়া শেষ সম্বল পাঁচ কাঠা জমি বিক্রি করে তিন হাজার টাকা নিয়ে ইউনিভার্সিটি যেতে হয়। মাসিক খরচ চালানোর জন্য হাত পাততে হয় অনেকের কাছেই। সহপাঠী বন্ধুদের সহযোগিতাও ছিল খুব আন্তরিক। নিতাই দত্ত, দ্বারিকানাথ পাল, বিশ্বময় মুখার্জি, গৌরগোপাল সরকার প্রায় একই সঙ্গেই আমরা যাতায়াত করতাম। একজনের খাবার অন্যরাও খেতাম। হোস্টেলে থাকার সময়ও পাশাপাশি রুমগুলিতে থাকতাম। হিন্দিবলয়ে বাংলা সাহিত্য পড়তে গিয়ে তবুও কখনো নির্বাসন বোধ করতাম না। বরং নিরন্তর পাঠ ও অনুশীলনের সময় পেতাম। কারণ পাটনা ইউনিভার্সিটির লাইব্রেরি ছিল বিশাল পুস্তকের সমাবেশে ভর্তি। বিভিন্ন রকম পুস্তক, বহুদিনের পুস্তক হাতের নাগালে পেতাম। পড়াশোনা করার ক্ষেত্রটা বহুগুণ বেড়ে গেছিল। নিজেরাই পড়ে পড়ে সমস্ত বইয়ের নোটস তৈরি করে নিজেদের সমৃদ্ধ করেছিলাম।

অধ্যাপিকা ললিতা সান্যাল, দেবনারায়ণ রায়, শিবের চ্যাটার্জি সাহিত্যের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে পাঠদান করলেও আধুনিক কবিতার পাঠদান করতেন পূর্ণেন্দু মুখোপাধ্যায়। বাংলা সাহিত্য পড়াতে গিয়ে তিনি ফরাসি, গ্রীক, জার্মানি প্রভৃতি ভাষার সাহিত্যেও বিচরণ করতেন। তাঁর কাছে জীবনানন্দ পাঠ এতই লোভনীয় হয়ে ওঠে যে তরুণ গরুড়ের মতো ক্ষুধা জাগিয়ে দেয় আমার। কল্লোল যুগের সমস্ত কবিরই আত্মদর্শনের নিবিষ্ট অভিমুখ চোখের সামনে ভেসে ওঠে। তাঁর সাহায্যেই পাটনার বাঙালি টোলায় এবং বিভিন্ন কলেজের সেমিনার-অনুষ্ঠানে যোগদান করার সুযোগও পাই। বাংলা একাডেমিতে নিয়মিত যাতায়াত করতে পারি। এমনি করেই দেখতে দেখতে দুই বৎসর অতিবাহিত হয়ে যায়।

প্রতিদিন বিকেলবেলা গঙ্গার তীরে গিয়ে বসতাম। দূরে নৌকা বয়ে যাওয়া, গান্ধীসেতু, শোনপুরের মেলার আয়োজন দেখতে পেতাম। শীতকালেও মানুষ গঙ্গার জলে স্নান করে নামকীর্তন করতে করতে ঘাট থেকে উঠে আসত। মেয়েরা দলে দলে নামত। দেখতে দেখতে উদাস হয়ে চেয়ে থাকতাম কোনো মহান স্রষ্টার সৃষ্টির প্রতি অভিভূত হয়ে। কোনো কোনো যুবতীর চোখ আমার চোখের সঙ্গে যেন মিশে যেতে চাইত। তখন একটা কম্পন অনুভব করতাম। ইউনিভার্সিটি যাওয়ার পথে কিংবা গঙ্গার তীরস্থ ঘাটে এটাই ঘটত। কথা না বললেও, চেনা না হলেও মনুষ্য আবেগের যে অন্তর্গত প্রবাহ এবং তার সচকিত বিন্যাস কাছে টানার আগ্রহ তাকে কে অস্বীকার করবে? সৃষ্টির স্রষ্টাই তা অবধারিতভাবে প্রতিটি মনুষ্যজন্মে নির্ধারণ করে পাঠিয়েছেন। জাতি-ধর্ম-বর্ণ সেখানে কোনো কিছুই বাধা হতে পারে না। ক্লাসের সহপাঠী মেয়েরা নানা সময়ে তাদের বাড়িতে আমন্ত্রণ জানাত। জন্মদিনে কিংবা কোনো উৎসবে গিয়ে উপস্থিত হতাম। বিভিন্ন সময়ে অধ্যাপক-অধ্যাপিকাদের বাড়িতেও যেতে হত। তাঁরাও কিছু না খাইয়ে আসতে দিতেন না। সর্বত্রই ছিল একটা আত্মীয়তার সম্পর্ক। ধর্ম, সামাজ, রাজনীতি মানবজাতিকে বারবার বিভক্ত করেছে। কিন্তু মানুষের হৃদয়কে বিভক্ত করতে পারেনি। একটি বোধসম্পন্ন জীবন আদি ও অনন্তের সীমানায় কত ব্যাপ্তিময় বিচরণ করতে পারে তা একমাত্র সে-ই বোঝে। যই হোক পাটনার জীবন আমার কবিতাজীবনকে অনেকটাই সুচারু সুসম্পন্ন এক অনুধ্যানের পর্যায়ে উত্তরণ ঘটিয়েছে। কাব্যচেতনাকে আধ্যাত্মিকচেতনার পরম্পর্যে এক গভীর ঐশ্বর্য দান করেছে।

এম এ ক্লাসের রেজাল্ট আউটের দিন জানতে পারি অতীতের সমস্ত রেকর্ড ভেঙে আমি বাহাত্তর পার্সেন্ট নাম্বার পেয়েছি। ললিতা সান্যাল বললেন, ‘গোল্ড মেডেল দেওয়ার রীতি বন্ধ না হলে অবশ্যই তা পেতে।’

আমি বলেছিলাম, ‘তার আর দরকার হবে না, আপনার আশীর্বাদ তার থেকেও বেশি মূল্যবান!’

সেই আশীর্বাদ মাথায় নিয়েই পিএইচডি করার জন্য তিনশো নাম্বারের preliminary test-ও দিতে হয়েছিল। মাত্র দু’জন ছাত্র সুযোগ পেয়েছিলাম। ইউনিভার্সিটির তরফ থেকে সেদিন আমাকে পার্ট টাইম লেকচারারের জন্য বলাও হয়েছিল খোদ ইউনিভার্সিটিতেই। কিন্তু মন আর থাকতে চাইনি। বন্ধুরা ছেড়ে চলে এসেছিল সবাই। হোস্টেল ফাঁকা করে দিতে হয়েছিল। যদিও পিএইচডিতে ভর্তি হয়েছিলাম জীবনানন্দ দাশের কবিতায় পরাবাস্তববাদ নিয়ে। কিন্তু আমার বিষয়টি ইউনিভার্সিটি অনুমোদন দেয়নি। কারণ ছিল এই বিষয়টি নিয়ে আগে গবেষণা করেছেন অন্য আরেকজন। তাই আমাকে ভিন্ন বিষয় চয়েস করতে হবে। আর তখনই ললিতা সান্যাল এর পরামর্শে প্রেমেন্দ্র মিত্রের সমগ্র কবিতা নিয়েই আরেকটা synopsis জমা দিতে হয়। এবং সেই বিষয়টি শেষ পর্যন্ত চূড়ান্ত হয়।

কলেজে পড়ার সময় থেকেই ‘দেশ’ পত্রিকার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে চিঠিপত্র লিখতাম। নোজফুল হক স্যারের বাড়িতে প্রতি সংখ্যা ‘দেশ’ পড়ার সুযোগ হত। তাছাড়া টিফিনের পয়সা জমিয়েও নতুন ‘দেশ’-ও কিনতাম। পুরনো ‘দেশ’গুলিও সংগ্রহ করে পড়তাম। ললিতা সান্যাল এর বাড়িতেও ‘দেশ’ পড়ার সুযোগ পেলাম। প্রেমেন্দ্র মিত্রের সংখ্যা ‘দেশ’পত্রিকাটি পেয়ে যাই মুরারইয়ের ‘বীরভূম প্রান্তিক’ পত্রিকার সম্পাদক সুনীলসাগর দত্তের বাড়িতে। তিনিও বিশেষভাবে আমাকে স্নেহ করতেন। মুরারইয়ে প্রতিবছরই সাহিত্য সংস্কৃতির নানা অনুষ্ঠান হত। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কেও তাঁরা একবার এনেছিলেন অনুষ্ঠানে। তাছাড়া লাইব্রেরিতেও বইপত্রের অভাব ছিল না। পাটনা ছেড়ে এলেও মাঝে মাঝে গিয়ে উঠতাম ললিতা সান্যালের বাড়িতেই। সেখানেই তাঁকে দেখিয়ে নিতাম আমার লেখপত্রগুলি। তাঁর বাড়িতেই খাবারও পেতাম। দরকার হলে গাড়িতে করেই তিনি নিয়ে যেতেন ইউনিভার্সিটিতে। মাতৃস্নেহের মতোই তাঁর স্নেহও অনুভব করতাম। কপর্দকশূন্য জীবনের যখন কোনোই ঠিকানা নেই, যখন শূন্যতায় শুধু পাক খাচ্ছি, তখন ললিতা সান্যালই তাঁর বাড়িতে থেকে যেতে বলেছিলেন। তাঁর আর কোনো উত্তরাধিকারী ছিল না। সারাজীবন কুমারী ছিলেন বলেই ত্যাগ ও কৃচ্ছ্র সাধনায় জীবন অতিবাহিত করেছিলেন। বহুদিন পাটনা ত্যাগ করে এসেও আজও মনে হয় তাঁর পায়ের কাছে বসে আমি পাঠ নিয়ে চলেছি। প্রেমেন্দ্র মিত্রকে নতুন নতুন ভাবনায় আবিষ্কার করার পরিকল্পনা করছি। মিছিলের কবি, জনগণের কবি, গণতন্ত্রের কবি, ফেরারি ফৌজের কবি, হরিণ-চিতা-চিলের কবি তাঁকে চিনতে চিনতে বারবার উচ্চারণ করছি:

“আমি কবি যত কামারের আর কাঁসারির আর

ছুতোরের মুটে মজুরের,

—-আমি কবি যত ইতরের!

আমি কবি ভাই কর্মের আর ঘর্মের;

বিলাস-বিবশ মর্মের যত স্বপ্নের তরে,ভাই,

সময় যে হয় নাই!

মাটি মাগে ভাই হলের আঘাত

সাগর মাগিছে হাল,

পাতালপুরীর বন্দিনী ধাতু,

মানুষের লাগি কাঁদিয়া কাটায় কাল।

দুরন্ত নদী সেতু বন্ধনে বাঁধা যে পড়িতে চায়,

নেহারি আলসে নিখিল মাধুরী—-

সময় নাহি যে হায়!

মাটির বাসনা পুরাতে ঘুরাই

কুম্ভকারের চাকা,

আকাশের ডাকে গড়ি আর মেলি

দুঃসাহসের পাখা,

অভ্রংলিহ মিনার-দম্ভ তুলি,

ধরণীর গূঢ় আশায় দেখাই উদ্ধত আঙ্গুলি!

আমি কবি ভাই কামারের আর কাঁসারির

আর ছুতোরের, মুটে মজুরের,

—-আমি কবি যত ইতরের।”

চলবে…

FA-3.png

তৈমুর খান

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *