Dr. Taimur Khan

এই কবিতাজীবন (ধারাবাহিক)
🐦
পর্ব-৯
এক দ্বান্দ্বিক জীবন
🍁
রামপুরহাট কলেজে কলা বিভাগে ভর্তি হলাম একাদশ শ্রেণিতে। একটা বিরাট পরিসর। বহু ছাত্র-ছাত্রীর ভিড়ে নিজেকে খুঁজে পেতে চেষ্টা করলাম। একাকী কলেজ বারান্দায় সাদা পাজামা, হাফহাতা হাওয়াই শার্ট আর চপ্পল পরে একটা সাইড ব্যাগ ঘাড়ে ঝুলিয়ে আমার কলেজ গমন সেই গ্রাম্যতারই পরিচয় বহন করে। কথাবার্তায় চালচলনে সাজগোজেও অবিচ্ছিন্ন গ্রাম্যতারই বিজ্ঞাপন। কিন্তু খুব অল্পদিনেই বন্ধু-বান্ধবের অভাব হয়নি। পকেটে আটআনা একটাকা দু-টাকার বেশি পয়সা থাকে না। অবশ্য দরকারও হয় না। বহু কষ্টে আড়াইশো টাকায় একটা পুরনো সাইকেল কিনে সেটি মেরামত করেই আমার যাওয়া-আসা। কেবলমাত্র বর্ষাকালেই অসুবিধা হয়। ছাতা নিয়ে সাইকেল চালাতে পারি না। তখন কোথাও রাস্তাঘাটে দাঁড়িয়ে যেতে হয়। মাঝে মাঝে কামাইও হয়। তবুও কলেজ চলতে থাকে। সুনীলবরণ বন্দ্যোপাধ্যায় আমাদের বাংলার স্যার যখন ক্লাসে ঢুকে উচ্চারণ করেন:

“রাধার কি হইল অন্তরে ব্যথা।

বসিয়া বিরলে থাকয়ে একলে

না শুনে কাহারো কথা।।

সদাই ধেয়ানে চাহে মেঘপানে

না চলে নয়ানতারা।

বিরতি আহারে রাঙ্গা বাস পরে

যেমত যোগিনী পারা।।

এলাইয়া বেণী ফুলের গাঁথুনি

দেখয়ে খসায়ে চুলি।

হসিত বয়ানে চাহে মেঘ পানে

কি কহে দু হাত তুলি।।

একদিঠ করি ময়ূর ময়ূরী

কণ্ঠ করে নিরীক্ষণে।

চণ্ডীদাস কয় নব পরিচয়

কালিয়া বঁধুর সনে।।”

তখন যেন এক অন্যরকম অনুভূতিতে রোমাঞ্চিত হতে থাকি। বাংলা সাহিত্যের রসভাণ্ডার যে জীবনরসে এতটা সিক্ত আগে কখনো টের পাইনি। রাধা যেন আমাদের হৃদয়ে এসে বসতি স্থাপন করেছে। আর আমরা নিজেদের কৃষ্ণের জন্য উদাসীন হয়ে চেয়ে আছি এই জগৎ-সংসারে। প্রত্যেকেরই নিজস্ব কৃষ্ণ আছে, কৃষ্ণের অন্বেষণ আছে, কৃষ্ণের সাধনা আছে। আমাদের সতেরো বছরের জীবনে তারই যেন সূচনা হল। তাই চেয়ে দেখতে লাগলাম চারিদিকেই এক মুগ্ধ বিস্ময়ে। বয়ঃসন্ধির সেই দ্বান্দ্বিক মুহূর্ত আমাদের জীবনকে নানা প্রশ্নের সম্মুখীন করে তুলল। চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগল সারাদিনের শ্রেণিকক্ষে দেখা উজ্জ্বল ফর্সা মুখগুলি। অর্ধস্ফুট গোলাপীর পাপড়ির মতো ঠোঁট, নেশাগ্রস্ত ঘোরলাগা চোখের ভাষা, সদ্য মৃণালের রোম ওঠা বাহু এবং মুকুলিত স্তনবৃন্ত স্বপ্নের মধ্যে প্রবেশ করতে লাগল। এক ভিন্নতর ভাষা এসে গেল কবিতায়। কবিতা যেন হৃদয়কে উদ্বেল করে দিল। মনকে অস্থির করে তুলল। প্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষাকে ঘনীভূত করতে লাগল দিন দিন। পড়ার থেকে লেখার দিকেই বেশি মনোযোগী হতে লাগলাম:

“নেমেছে পরির দল শ্রেণিকক্ষ জুড়ে

রঙিন ডানায় ফুলে ফুলে প্রজাপতি ওড়ে

মন ছুঁতে চাই পরিদের

মনে মনে যাই কাছাকাছি

আজ শুধু ভালোবাসা দিতেই এসেছি”

একদিকে রোমান্টিক হাতছানি, অপরদিকে চরম দারিদ্র্যের কঠোর কঠিন পথ। কোনোদিন কচুশাক সেদ্ধ খেয়ে কলেজে আসা, তো কোনোদিন পরের বাড়ি থেকে চেয়েচিন্তে আনা ভাতের মাড়। খুদ বা গমের জাউও মাঝে মাঝে খেতে পাই। আমার পরের বোনটি প্রাথমিক বিদ্যালয় ডিঙিয়ে আর উচ্চ বিদ্যালয় যেতে পারে না। তাকেই পরের বাড়িতে কাজ করতে যেতে হয়। ভাদ্র-আশ্বিন মাসগুলিতে কষ্টের সীমা থাকে না। কলেজ কামাই করে আমাকেও ঘাস কাটতে হয়। এক বস্তা ঘাস কেটে বিক্রি করলে তবেই খুদ কিংবা গম জোটে। তাতেই একবেলা চলে যায়। ঘাস কাটতে কাটতেই ঘাসে কখনো বেরিয়ে আসে সাপ, কখনো কাঁকড়া বিছে। সেসব দেখে ভয় পেলে চলে না। মাঝে মাঝে আঙুলও কেটে যায়। তখন এক হাতে চেপে কচি পানপাতার মতো এক রকমের ঘাস চিবিয়ে সেখানে লাগিয়ে দিই। কিছুক্ষণ পর রক্ত থেমে যায়। আলের ওপর কেঁচো মাটি তুলে রাখে। কাঁকড়ায় গর্ত করে। সেসব ভেজা মাটিতে এক রকমের সোঁদা গন্ধ পাই। সবুজ ধান গাছগুলি খালি গায়ের ওপর স্পর্শ করে। মনে হয় কেউ যেন আদর করছে। সারাদুপুর চলে যায় ঘাস কাটতে গিয়ে। রৌদ্রে এবং এবং গরমে হাঁপিয়ে উঠলে ক্যানেল পাড়ে বিশাল কদম গাছের ছায়ায় গিয়ে বসি। গাঁয়েরই লেট-বাগদিদের মেয়েরাও ঘামে ভেজা কাপড় এলিয়ে দিয়ে গাছের ছায়ায় গা শুকিয়ে নিতে থাকে। তখন মনে হয় কলেজের ক্লাসের পড়ানো রাধাকৃষ্ণ লীলার দৃশ্য। কৃষ্ণ যেন গোপিনীদের নিয়ে বসে আছে কদম গাছের তলায় আর বাঁশি বাজাচ্ছে। নিজেকেই তখন মনে মনে কৃষ্ণ ভাবতে থাকি। আর আমার বাঁশির সুর হয়ে ফিরে আসে কবিতার শব্দেরা। মনের ব্যথা জুড়িয়ে যায়। শহরের অভিজাত উঠতি যুবতীদের মুখ সেখানে নেই ঠিকই, কিন্তু যারা আছে তারাই বা কম কীসে? খড়ি পড়া কালো শরীরে ঘামের গন্ধেরও এক ধরনের মাদকতা জেগে ওঠে, সেই মাদকতা নেশার মতো পেয়ে বসে। দামি পারফিউম কিংবা ফেসিয়াল করা মুখের কৃত্রিমতা ভেদ করে আমি মর্ম আর মাটির কাছাকাছি হতে থাকি। কাছ থেকে দেখতে পাই সেইসব ক্ষুন্নিবৃত্তির জীবনকে। সামান্য একটি পাতলা কাপড়ে যে শরীর ঢাকা আছে তা মাটির মানবী আদম-হবার মতোই স্বর্গ থেকে বিচ্যুত হওয়া নারী-পুরুষ। ভাবতে ভাবতেই ফিরে আসি ঘাসের বোঝার কাছে। চম্পা, ললিতা, জয়া, সুরু কিংবা হাসিকে ডেকে বলি, ‘মাথায় তুলে দে তো!’

সে এসে তখন মাথায় তুলে দেয়, আর বলে, ‘কত ঘাস কেটেছ গো দাদা, কী ভারী!’

তার নিঃশ্বাস এসে আমার নিঃশ্বাসে মিশে যায়। তার বুকের জমির উর্বরতা আমাকে ডাক দেয়। কিন্তু আমি তো শব্দ কৃষক হয়ে ফিরি। আমি তো উপলব্ধি নিয়ে ফিরি। আমি তো জীবনকে চিনতে চাই। তাই উর্বর মানব শরীরের ডাক পেলেও সেখানে প্রবেশ করতে পারি না। যেদিন বৃষ্টি হয় সেদিন একই গাছের তলায় ভেজা শরীরে লেপ্টে থাকি। শরীর রোমাঞ্চিত হয় বুঝতে পারি। তবুও আগুন জ্বলতে দিই না। বাড়ি এসে ভেজা শরীর মুছে একটা শুকনো কাপড় পরে খাতা আর কলম নিয়ে বসি। আর লিখতে থাকি:

“সারাদুপুর গেল কদম গাছের ছায়ায়

অনেক রোদের গান হৃদয়ে জন্মালো

হৃদয় কি হৃদয় চেয়েছিল?

কার ছোঁয়া লেগে ছিল হাতে?

মনে মনে ডেকেছিলাম কাকে?”

নিজেকেই যেন ঠিকমতো চিনি না। এক স্ববিরোধী চেতনা সর্বদা অভিঘাত তুলে চলেছে। বিকেলবেলায় কয়েকটি ছিপ নিয়ে ডোবার ধারে গিয়ে বসেছি। চ্যাং মাগুর কই হয়তো টোপ খাবে। খাঁচ দিতে দিতে উঠে আসবে বেশ কিছু মাছ। এসব নিয়েই বাড়ি ফিরব। লম্ফু জ্বেলে বসব বই নিয়ে। বইয়ের পাতা খোলাই থাকবে। উদাসীন হয়ে ভাবতে থাকব ‘রাধার অন্তরের ব্যথা’। এমনি করে লেখাপড়া হয়? রাস্তার ওপারের বাড়িতে অন্য পাড়ার যুবক ঢুকবে। স্বামী নেই, শাশুড়ি নেই, সুন্দরী বউটি একা। যুবক ঢুকেই দরজা বন্ধ করবে। তারপর একসময় বেরিয়ে যাবে। সব টের পাচ্ছি। না দেখেও বলে দিতে পারি, যুবকটি ভিতরে গিয়ে কী করেছে। এভাবে কি লেখাপড়া হয়?

সমস্ত আকাশ আজ বিষণ্ন। বাঁশঝাড়ে জোনাক পোকারা জ্বলবে। পেঁচা ঢেকে যাবে পাশের বাড়ির কার্নিশে। আমি শুতে যাব অন্য আমার এক পিসতুতো দাদার বাড়ি। তার বউ এই সন্ধ্যেবেলাতেও ব্লাউজ খুলে উদোম নাভি দেখিয়ে চিৎ হয়ে পড়ে থাকবে বিছানায়। আমি গিয়ে বলব, ‘সরে যাও, এখানে আমরা ঘুমাই!’

সে তখন তাড়াহুড়ো করে উঠতে গিয়ে হাঁটুর উপর পর্যন্ত তার কাপড় তুলে দেবে। আমি হা করে গিলতে থাকব সেই দৃশ্য। রাত্রে ভালো ঘুম হবে না। ছটফট করতে করতে ভোরবেলায় স্বপ্ন দেখব: চম্পা আলের উপর শুয়ে আছে। তার সমস্ত শরীর জুড়ে সবুজ ঘাস জন্মেছে। আমি কাস্তে নিয়ে কাটতে যাব, অমনি একটা সাপ বেরিয়ে আসছে ঘাসের ভেতর থেকে। আমি আঁতকে উঠব। চম্পা হি-হি করে হেসে উঠবে। পরে দেখব, সাপের মুখটি অবিকল চম্পার মুখ। আমাকে ক্রমশ জড়িয়ে নিতে চাইছে, কিছুতেই বেরিয়ে আসতে পারছি না।…

চলবে….

FA-1.png

আত্মগত গদ্য

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *