Dr. Taimur Khan

কবিতা লেখার প্রথম পাঠ কেমন ছিল? কেমন ছিল প্রেমে পড়ে কবিতা লেখার প্রচেষ্টা? কেমন ছিল দুঃখ দারিদ্রে বেড়ে ওঠার উপলব্ধি? সেসব নিয়ে বিস্তর লেখালেখি করেছি। আজ আর নিজের কথা লিখতে চাই না। যখন একে একে হাইস্কুল, কলেজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিঁড়িগুলো ডিঙিয়ে যাচ্ছি, তখন নানা সময়ে সহপাঠী বন্ধু-বান্ধবেরা আমার চারিপাশে ভিড় করেছে।

অনেকের সঙ্গেই গড়ে উঠেছে আন্তরিকতা। শুধু নিজের কবিতা লেখালেখির জন্যই নয়, অন্যের প্রেমে পড়া এবং সদ্য লেখা কবিতা দেখার ও শোনার সৌভাগ্যও হয়েছে। পরবর্তীকালে হয়তো তারা লেখালেখির জগতে আর থাকেনি। তাদের প্রেমাস্পদকে কেউ কেউ সঙ্গী করে সংসারে প্রবেশ করেছে। কেউ কেউ বিরহ যাতনা ভোগ করে অবদমনে পীড়িত হয়েছে। তাদের উদ্বেগের মুখগুলি কিংবা আনন্দের মুহূর্তগুলি মাঝে মাঝে মনে পড়ে। একাকী নিরালায় তাদের কথা ভাবতে বসি।

প্রেমে পড়লে প্রায় সকল মানুষেরই এমন কিছু কমন উপলব্ধি আছে, এমন কিছু কমন স্বপ্ন আছে এবং এমন কিছু কমন দুঃখ আছে যা সকলের জীবনেই দেখা দেয়। তখন যারা গান গাইতে চায়, কবিতা লিখতে চায়, ঘর বানাতে চায়, স্বপ্ন দেখতে চায় তা একই রকম হতে বাধ্য। হয়তো পরিবেশ বা ধরন কিছুটা আলাদা হয়, কিন্তু মনস্তাত্ত্বিক বিন্যাসে উপলব্ধির ক্ষেত্রটি একই থাকে। ধরুন কেউ প্রেমে পড়লেন।

আপনার আগেও অনেকেই প্রেমে পড়েছে। আপনার পরেও অনেকেই প্রেমে পড়েছে। তাদের কাছে খোঁজ নিয়ে দেখুন তারা তাদের প্রেমিক বা প্রেমিকাকে একটি কমন কথা বলে থাকেন: ‘তোমাকে না পেলে আমি বাঁচবো না’, ‘তুমি আমার স্বপ্ন’, ‘তোমার জন্যই আমার এই জন্ম’, ‘তুমিই আমার সব’, ‘তোমাকে না পেলে আমি আত্মহত্যা করতে বাধ্য হব’, ‘তোমার জন্য আমি সব কিছু ত্যাগ করতে পারি’, ‘আমি নিজের থেকেও তোমাকে বেশি ভালোবাসি’ ইত্যাদি এইজাতীয় কথার কোনো সীমা নেই। মানব জীবন ধারণ করে প্রথম যৌবনে পদার্পণ করা তরুণ-তরুণীর মুখ থেকে এই জাতীয় কথাবার্তাই বেশি নিঃসৃত হয়। কেউ হয়তো ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে অন্যভাবে তা বলে থাকেন। কিন্তু বলেন, অবশ্যই বলেন।

কিন্তু এই প্রেমিক-প্রেমিকাটি যদি কবিতা লিখেন প্রেমে পড়ার পর, তাহলে তিনি কী লিখতে পারেন? যদি তিনি গান গেয়ে থাকেন, তাহলে তিনি কী গান গাইতে পারেন? ইত্যাদি বিষয়গুলি স্মরণ করেই বেশ কিছু কবির কবিতা অন্বেষণ করলে তা প্রায় একই রকম আমার মনে হয়েছে। বিখ্যাত কবিদের কথা ছেড়ে দিলেও, অবিখ্যাত কবিরাও প্রায় একই রকম উপলব্ধির কথা লিখতে চেয়েছেন।

আর এই ধারা আজ পর্যন্ত বজায় আছে। হয়তো আগামীতেও থাকবে। কবিতার এই গতানুগতিকতা তথা প্রেম প্রকাশের এই গতানুগতিকতা অথবা চর্বিত চর্বণ বারবার আমাদের গলাধঃকরণ করার অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রেম প্রকাশের অথবা প্রেম নিবেদনের যেন আর কোনো পথ নেই। আর কোনো ভাষা নেই। আর কোনো উপলব্ধি নেই। আজও কোনো তরুণ গায়ককে অথবা গায়িকাকে গিটার হাতে গাইতে শুনি:

‘তুমি আসবে বলেই বসন্ত এসে পেরিয়েছে চৌকাঠ’

অথবা

‘আসবে বলে তুমি আছি অপেক্ষায়

আমার যত কথা গান হয়ে যায়।’

এই ‘তুমি’ সর্বনামটি পৃথিবীর সমস্ত প্রেমিক-প্রেমিকার সর্বনাম অসীম অনন্তকাল ধরে বিশেষ্যকে আড়াল করে চলেছে এই পদটি। নাম বলতে হবে না ‘তুমি’ বললেই সেই মনের মানুষটির কথা উঠে আসে, যাকে শয়নে স্বপনে, নিশি অবসানে, জীবনে-মরণে মনে পড়ে। যাকে এক মুহূর্ত ভোলা যায় না।

যার জন্যই বেঁচে থাকার সাধ। যার জন্যই আকাশের চাঁদ ফিরিয়ে আনবার প্রয়াস। যার জন্য সারা জীবন অপেক্ষাও। তখন তরুণ কবিরা যৌবনের সংরাগে অনবদ্য আত্মনিবেদন লিখতে থাকেন। সাম্প্রতিককালে একটি গানও যত্রতত্র শোনা যাচ্ছে। সেখানে ওই ‘তুমি’র কথাই আছে। গানটি হলো:

“তুমি যেন কালাপাখি আমি যেন কী

বসন্ত কালে তোমায় বলতে পারিনি।”

বসন্তকাল পেরিয়ে এলেও এই ‘তুমি’কে ভোলা যায়নি। তাই যে কোনো কালেই তার স্মৃতিচারণা করা হয়েছে আর সেই না বলা কথাটি পুনরায় বলার প্রচেষ্টা রয়েছে। প্রেম তো এখানেই। এই প্রেমের জন্যই কবিতা লেখা। এই প্রেমের জন্যই গড্ডলিকায় গা ভাসানো। ‘সব কোকিলের একই রা’ আমরা সেই রা-গুলি খুঁজে পেলাম। এখানে কয়েকটি উল্লেখ করলাম:

১)মেহেদি হাসান রানা

কবিতা:

“তুমি আসবে বলে এখনো আমি ঘরে ফিরে যাইনি।

তুমি আসবে বলে ভোরের সূর্য এখনো অস্ত যায়নি।

তুমি আসবে বলে চৌরাস্তার পুলিশটা ঘুষ খায়নি।

তুমি আসবে বলে বখাটে ছেলেটা শিষ দিতে গিয়েও দেয়নি।”

২) প্রবাল বড়ুয়া)

তুমি আসবে বলে………

“তুমি আসবে বলে……….

পৃথিবীর আজ যতো আয়োজন

সকালে কুড়নো শিশির ভেজা শিউলি ফুল দিয়ে

আমার ছোট্ট ঘরটি সাজিয়েছি……”

৩) মাহাবুব আলম

তুমি আসবে বলে

“কত ফুল ছড়ায়েছি আমি

তোমার কাঁটা ছড়ানো পথে,

তবুও তোমার নূপুর চরণ

দেয়নি পরশ সেই পথের বুকে ।”

৪) মোঃ মেহেদী হাসান

তুমি আসবে বলে

“তুমি আসবে বলে-

আমার আকাশ মেঘ মুক্ত রংধনু খেলে –

বালুচর জমিন ফসলি পূর্ণতা, ময়ূর পেখম মেলে।”

৫) শিমুল মুস্তাফা

তুমি আসবে বলে

“তুমি আজ আসবে বলে-

বহুক্ষণ আমি অবাক হয়েছি!

ঘরের চৌদিকের দেয়ালের ঝুলগুলো পরিষ্কার করেছি

আমার ঘরটাকে আমি নিজেই আপন

করে সাজিয়েছি

সেই সারা রাত ধরে!”

৬)রেদোয়ান মাসুদ

তুমি আসবে বলে

“তুমি আসবে বলে

প্রজাপতিরা ছিল ডানা মেলে

জোনাকিরা ছিল আলো নিয়ে

গোলাপ ফুল আগে থেকেই ফুটেছিল

তোমাকে বরন করবে বলে।”

৭) জেমস

কবিতা

“কবিতা,

তুমি স্বপ্নচারিণী হয়ে খবর নিও না

কবিতা,

এই নিশাচর আমায় ভেবোনা সুখের মোহনা।”

৮) আদিত্য আরেফিন

তুমি আমার

“ওগো তুমি আমার, পাখি ডাকা ভোর। তুমি আমার, সকালের সোনালী রুদ্দুর। তুমি আমার, ক্লান্ত অলস দুপুর। তুমি আমার, মিষ্টি গানের সুর। তুমি আমার, চেতন -অবচেতন।”

৯)স্বপ্নবাজ

তুমি আসবে বলে

“তুমি আসবে বলে আকাশটাকে

করেছি মেঘমুক্ত

তুমি আসবে বলে রংধনুটা

আকাশে করেছি যুক্ত।”

১০) আমেনা ফাহিম

তুমি আসবে বলে

“তুমি আসবে বলে,

অপেক্ষায় বসে ছিলাম সন্ধ্যা নদীর তীরে

না না একটু ভুল হয়ে গেল

আমি তো সেই পরন্ত দুপুর থেকেই প্রহর গুনছি

তুমি আসবে বলে…………”

‘তুমি আসবে বলে’ কথাটি এতই কমন কথা যে অধিকাংশ কবিই তা উচ্চারণ করেছেন। তার আসার আয়োজনে হৃদয় উজাড় করে ঘর সাজিয়েছেন। প্রকৃতিতে নতুন করে নিজেকে উপস্থাপন করেছেন। জীবনের জোশ জেগে উঠেছে। অপেক্ষা দীর্ঘ হয়েছে। মৃত্যু তুচ্ছ হয়েছে। স্বপ্নে রং ধরেছে। অকালে বসন্ত এসেছে। কত কী ঘটেছে। এই ‘তুমি’ কবিতা হলেও তা মানবী। তার রূপ আছে। যৌবন আছে।চপলতা আছে। হাসি আছে। আনন্দ আছে। জীবনের বেগ আছে। সুতরাং স্রষ্টার আবেগকেও নব উদ্যমে জাগ্রত করেছে। তখন একই ভাষা, একই উপলব্ধি, একই বোধের তরবারি উঠে এসেছে। কবিতা তখন শিল্প নৈপুণ্যে নয়, ছন্দ ও অলংকারের সৌকর্যে নয়, কবিতা তখন চিরন্তন যৌবনের মানবীয় আবেগে গতানুগতিক পথ অনুসরণ করেছে। কিন্তু একজন বিচক্ষণ কবি এই পথ, এই ভাষা অনুসরণ করতে পারেন না। প্রেমকে স্বীকার করেই, তার আবেদনকে লালন করেই তিনি তার অনন্ত যাত্রায় তাকে পৌঁছে দিতে চান। তখনই তিনি লিখতে পারেন:

“হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,

সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে

অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার-অশােকের ধূসর জগতে

সেখানে ছিলাম আমি; আরাে দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;

আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,

আমারে দু-দণ্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন।”

তাঁর পথ হাঁটার শেষ নেই। তাঁর আয়োজনেরও ক্লান্তি নেই। যুগ-যুগান্তর ধরে ইতিহাসখ্যাত সাম্রাজ্যের পর সাম্রাজ্য পর্যন্ত তিনি অতিক্রম করে চলেন। সাগর-মহাসাগর, আয়ু-পরমায়ু তার জন্মচক্রে ঘুরপাক খায়। তিনি তো প্রেমিক পুরুষ। তিনি মৃত্যুবরণ করেন না। তিনি সঞ্চারিত হন সমস্ত পুরুষ হৃদয়ে। তখন তাঁকে আর লিখতে হয় না ‘তুমি আসবে বলে’।

ঠিক তেমনি আর একজন কবিও বুঝেছিলেন প্রেম অনন্ত। বিবাহ খণ্ডিত। প্রেম আয়ু। বিবাহ মৃত্যু। প্রেমিক সাধক।ভালোবাসার সামান্য ঋণ পেলেও আজীবন বেদনাকে নিয়ে সচ্ছলতার সংসার করা যাবে।এই সংসার তো শিল্পযাপনের প্রজ্ঞায় জীবনকে উৎসর্গ করা। ‘তুমি’কে ঘরে আনা নয়।বিবাহ করাও নয়। তুমিকে ঈশ্বর বা ঈশ্বরী করে তোলাতেই আনন্দ । তাই তিনি লিখলেন:

“আমার জীবন ভালোবাসাহীন গেলে

কলঙ্ক হবে কলঙ্ক হবে তোর,

খুব সামান্য হৃদয়ের ঋণ পেলে

বেদনাকে নিয়ে সচ্ছলতার ঘর

(হৃদয়ের ঋণ:হেলাল হাফিজ)

ভালোবেসে ভোগ বা সুখ চাওয়া নয়। নজরুল ইসলাম বলেছিলেন :

‘তোমাকে নিয়ে সাজাব না ঘর সৃজিব অমরাবতী’ সেই অমরাবতী রচনা তো বৃহৎ প্রতিভারই গরিমা প্রকাশ। ‘তুমি আসবে’ কথাটি এই প্রতিভাধরদের স্পর্শ করতে পারেনি। তেমনি ‘তুমি আসবে’ লিখেও শামসুর রাহমান প্রেমকে স্বাধীনতার বোধে আলোকিত করে তুলেছেন। ‘তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা’ নামক কবিতাতায় লিখেছেন :

“তুমি আসবে ব’লে, হে স্বাধীনতা,

সাকিনা বিবির কপাল ভাঙলো,

সিঁথির সিঁদুর গেল হরিদাসীর।

তুমি আসবে ব’লে, হে স্বাধীনতা,

শহরের বুকে জলপাইয়ের রঙের ট্যাঙ্ক এলো

দানবের মত চিৎকার করতে করতে

তুমি আসবে ব’লে, হে স্বাধীনতা,

ছাত্রাবাস বস্তি উজাড় হলো। রিকয়েললেস রাইফেল

আর মেশিনগান খই ফোটালো যত্রতত্র।

তুমি আসবে ব’লে, ছাই হলো গ্রামের পর গ্রাম।

তুমি আসবে ব’লে, বিধ্বস্ত পাড়ায় প্রভূর বাস্তুভিটার

ভগ্নস্তূপে দাঁড়িয়ে একটানা আর্তনাদ করলো একটা কুকুর।

তুমি আসবে ব’লে, হে স্বাধীনতা,

অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিলো পিতামাতার লাশের উপর।”

ইতিহাস আমরা ভুলিনি। ‘তুমি’ এখানে ‘স্বাধীনতা’। আর এই স্বাধীনতাকে কেন্দ্র করেই ‘আমার মায়ের জায়নামাজের পাটি’ এবং ‘মক্তবের মেয়ে চুলখোলা আয়েশা আক্তার’ পর্যন্ত একাকার হয়ে আছে।ছোট প্রেম যখন বড় প্রেম হয়ে ওঠে তখন তা চিরন্তন উচ্চারণ হয়ে যায়। ব্যক্তিজীবনের আলো তখন মহাজীবনের দরজায় কড়া নাড়ে। এভাবেই কবিতাগুলি স্মরণীয় হয়ে গেছে আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাসে, আমাদের ভাষার ইতিহাসে।বাংলা সাহিত্যে এই বিপুল প্রেম সম্ভার প্রেমের শুচিতাকেই ঘোষণা করে চলেছে।

[jetpack_subscription_form show_subscribers_total=”false” button_on_newline=”false” custom_font_size=”16px” custom_border_radius=”0″ custom_border_weight=”1″ custom_padding=”15″ custom_spacing=”10″ submit_button_classes=”has-neve-link-color-border-color has-background has-neve-link-color-background-color” email_field_classes=”has-neve-link-color-border-color” show_only_email_and_button=”true” success_message=”Success! An email was just sent to confirm your subscription. Please find the email now and click 'Confirm Follow' to start subscribing.”]
Sahitya Patrika

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *