আত্মগত গদ্য
এই কবিতাজীবন (ধারাবাহিক)

পর্ব-৪
ছিন্ন বিধুর তবু একটি আলো

মোঘলসরাই এক্সপ্রেস ট্রেনে এত ভিড় যে দাঁড়াবারও জায়গা পাচ্ছি না। ট্রেনের বাথরুমের দরজায় তিনজনে কোনো রকম ভাবে ঘুটিসুটি মেরে নিজেদের টিকিয়ে রেখেছি। এই ট্রেনেই এলাহাবাদ অবধি যেতে হবে তারপর মুম্বাইয়ের ট্রেন পাওয়া যাবে। এভাবে কতক্ষণ যে ছিলাম তা বলতে পারি না। একসময় নিজেকে আবিষ্কার করলাম বাথরুমের দরজায় লুটিয়ে পড়েছি। অনেকেই পা দিয়ে মাড়িয়ে যাওয়া-আসা করছে। একজন বললে, হিঁয়া মত্ শোয়ে, অন্দার যাইয়ে গা!
আমি মাথা নেড়ে একটা সিটের নিচে নিজের শরীরটাকে চালান করে দিলাম। খিদেই পেট চুঁই চুঁই করছে। জলেরও তেষ্টা পেয়েছে। কিন্তু কী করেই বা তার সমাধান করব? নিরুপায় হয়ে চুপচাপ পড়ে রইলাম। অনেকক্ষণ এভাবেই কেটে গেল।
পরের দিন দুপুরে দেখলাম অনেক ভিড় কমে গেছে। খালেক ভাই বাথরুমের কাছেই বসে আছে নিচে। সিদ্দিক ভাইও তার পাশে। আমি আর সহ্য করতে না পেরে বললাম, কিছু মুড়ি আছে তো দাও, খুব খিদে পেয়েছে। আর তোমার ঘটিটা দাও জল নিয়ে আসি।
খালেক ভাই তার ন্যাকড়া জড়ানো পুঁটুলিটা বের করে দিলে তিনজনেই ওই অল্প ক’টা মুড়ি নিমেষেই শেষ করে ফেললাম। তারপর জল খেয়ে কিছুটা শান্তি হল। খালেক ভাই বলল, রাস্তায় আর কিছুই পাওয়া যাবে না। একেবারে মুম্বাইয়ে পৌঁছানোর পর।
মনের মধ্যে অনেক কথা বলার থাকলেও বলতে পারলাম না। একরাত্রির ক্লান্তি ও মানুষের পায়ের ছোঁয়ায় জীর্ণ মলিন হয়ে গেছে আমার সমস্ত চেহারা। খাবার এবং পর্যাপ্ত ঘুম নেই বলে তা আরও বিধ্বস্ত করে দিয়েছে। ট্রেনের সিট ফাঁকা পেয়ে আমি সিটে বসলাম। ওরা দুজনেই নিচে বসল আগের মতোই। রাত্রি দশটা-এগারোটা নাগাদ এলাহাবাদ পৌঁছাব। তারপর ওখান থেকেই পাব মুম্বাই যাবার ট্রেন।
অপেক্ষা আর অপেক্ষা। এত দীর্ঘ সফর জীবনে কখনোই করিনি। ট্রেনে চেপে বড় জোর রামপুরহাট থেকে পিসির বাড়ি মল্লারপুর পর্যন্ত গেছি। সেবার পিসির বাড়ি থেকে ফিরতে ফিরতে রামপুরহাট স্টেশনে ‘বিদ্রোহী নজরুল’ বইটি পাঁচ টাকা দিয়ে কিনেছিলাম। পিসি গোবরের ঘুঁটে বিক্রি করে চার-আনা আট-আনা করে পয়সা জমিয়ে জমিয়ে আমাকে বাজারে মিঠাই কিনে খাওয়ার জন্য দিয়েছিল। আমি নজরুলের জীবনী বইটি কেনার জন্য বহু চেষ্টা করেও পারিনি। তাই মিঠাই খাওয়ার থেকে বইটি কিনে আমার স্বপ্ন পূরণ করতে পেরে খুবই খুশি হয়েছিলাম। বইটি মুম্বাই আসার সময় বাক্সে ভরে এসেছি। ট্রেনে বসে বসেই অনেক কথা মনে পড়ছে। ওই বইয়ের সঙ্গে আমার বাবার ছোটবেলায় পড়া কতকগুলি বই এবং বাবার বিয়েতে পাওয়া ‘মনোয়ারা’ নামে একটি উপন্যাস এবং আমার একটি ইংরেজি গ্রামারের অনুশীলনী খাতা সবই বাক্সের মধ্যে আছে। খাতাটি আমার প্রিয় নন্দদুলাল গাঙ্গুলি স্যারের স্মৃতি হিসেবেই রেখেছি। কারণ ওই খাতায় স্যারের হাতের লেখা আছে প্রতিটি পৃষ্ঠায় আর খাতার শেষদিকে কতকগুলি আমার লেখা কবিতা।
ট্রেন হুহু শব্দে ছুটে চলেছে। ভাবনাগুলি একের পর এক এসে ভিড় করছে বলে খিদেকেও উপেক্ষা করতে পারছি। এভাবেই কখন সময় কেটে গেল বুঝতে পারিনি। বিরাট আলো ঝলমলে এক স্টেশনে ট্রেন প্রবেশ করল। সিদ্দিক ভাই বলল, এবার চলো আমরা পৌঁছে গেছি।
দুদ্দাড় করে আমরা নেমে পড়লাম। কখন পরের ট্রেন পাব কিছুই জানি না। কিন্তু খিদের চোটে আর থাকতেই পারছি না। হঠাৎ দেখি খালেক ভাই নেই। কোথায় গেল ও! সিদ্দিক ভাই আমি তন্ন তন্ন করে খুঁজছি, কিন্তু কোথাও দেখা যাচ্ছে না। এখন উপায়!
অসহায়ের মতো আমরা বসে পড়েছি প্লাটফর্মের একদিকে। মনের মধ্যে নানা রকম ভাবনার উদয় হচ্ছে। সিদ্দিক ভাই বলছে, চিন্তার কোনো কারণ নেই। কোথাও যাবে না, এখনই এসে যাবে!
তার কথা শুনে চারিদিকে সজাগ দৃষ্টি রেখে চলেছি। হ্যাঁ, ঘন্টাখানেক পরেই দেখি হাতে কয়েকটি সিঙ্গাপুরী কলা নিয়ে সে খুড়িয়ে খুড়িয়ে এগিয়ে আসছে। ছুটে গিয়ে তার হাত থেকে কলাগুলি নিয়ে বললাম, কোথায় গিয়েছিলে আমাদের না জানিয়ে? আমরা তো হয়রান হয়ে খুঁজছি!
খালেক ভাই বলল, এই তো কাছেই মসজিদ টোলা বলে একটা জায়গায় গিয়েছিলাম কিছু খাবারের ধান্দায়। তা বিশেষ কিছু পেলাম না। ও কলাগুলিই খাবার জন্য দিলে।
সে-রাত্রে সেই কলাগুলি খেয়েই আমরা ট্রেনে উঠেছিলাম। সারাদিন সারারাত ট্রেনে গিয়ে তবে সকাল সকাল বি.টি স্টেশনে নামব। এই ট্রেনেও প্রচণ্ড ভিড় তিল ধারণের জায়গা নেই। নাগপুর পর্যন্ত গেলে তবেই কিছুটা ভিড় কমতে পারে বলে খালেক ভাই জানালেন। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই আমরা যাচ্ছি। আমাদের তিনজনেরই ভিক্ষুকের বেশ। প্রায় অর্ধমৃত অবস্থা। কিছু লোক গুঁতো মেরে বের করে দিতে চাইল। আমরা প্রতিবাদ করতে পারলাম না। চুপচাপ সব সহ্য করতে লাগলাম।
অবসন্ন শরীরটা এলিয়ে পড়তে চাইছে। কয়েকবার টিকিট চেকার এসে দেখে চলে গেল। আমাকে দেখিয়ে চেকারকে সিদ্দিক ভাই বলল, হমারা আদমি, হম্ তো অন্ধা!
চেকার সে-কথা শুনে তখন দরজার কাছে গিয়ে বসতে বলল। বেলা এগারোটা নাগাদ নাগপুরে পৌঁছলাম। অনেক ফাঁকা সিট বলে আমরা বসে পড়লাম। এই স্টেশনেই এক মারাঠি দম্পতি উঠল সঙ্গে দুই মেয়েকে নিয়ে। বড় মেয়েটির বয়স বড় জোর ১৫-১৬ এর বেশি হবে না। ছোটটি বছর দশেকের হবে। তারা এসেই আমাদের পাশাপাশি বসলেন। খালেক ভাই তাদের সঙ্গে দিব্যি আলাপ জমিয়ে ফেলেছে। কথায় কথায় ওরা জানতে চাইলেন, এ লড়কা কিঁউ যা রাহে হ্যায়?
খালেক ভাই বুঝিয়ে বলতে লাগল, কুছ্ ভি ধন্দা করনে কি লিয়ে।
আরও যা বলল তা অনেকটাই এরকম, ছেলেটি লেখাপড়া করতে চায়, কিন্তু ওরা গরিব বলে বাড়ি থেকে পড়ানোর ইচ্ছা নেই। কিছু রোজগারপাতি করতে হবে। খাবার জোটাতে হবে। তাই আমাদের সঙ্গে পালিয়ে যাচ্ছে।
মারাঠি পরিবারটি সব শুনে আমাকে আরও ভালো করে নিরীক্ষণ করতে লাগলেন। ওদের শ্যামবর্ণা ষোড়শী কন্যাটি আয়ত চোখে আমার দিকে এমনভাবে তাকিয়ে আছে যে তার দৃষ্টির তীক্ষ্ণ শরক্ষেপে আমার বিমর্ষ বিহ্বল হৃদয়খানায় কম্পন শুরু হয়ে গেছে। ভালোবাসার তির কি এমনই নিঃশব্দে ভাষাহীন অনুভূতিদেশকে বিদ্ধ করে? এমন করে তো কেউ কখনো আমার দিকে তাকায়নি! এই প্রথম কোনো ষোড়শীর এমন মুগ্ধতা, এমন তীব্র সম্মোহন চকিতে আমার ক্ষুধা-তৃষ্ণা ভুলিয়ে দেবে তা ভাবতে পারিনি। যার ভাষা অন্য, যে ভিন্ন পরিবেশে মানুষ, যার খাদ্য ও পোশাক-আশাক আলাদা, রুচি ও জীবনবোধ আলাদা, জীবনেও যার সঙ্গে কখনো দেখা হয়নি, তাকে দেখে হঠাৎ আজ এরকম কেন হল নিজেও কিছুই বুঝতে পারলাম না। আজও সেই দৃষ্টিনিক্ষেপ স্মরণে আসে। আজও সে মূর্তিমতী হয়ে সামনে এসে দাঁড়ায়। কিছুক্ষণ চোখাচোখি স্তব্ধতার পর মেয়েটি মাথা নামিয়ে নেয়। আমিও জানালার বাইরে দিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিজেকে সামলে নিই। যৌবনের এই প্রথম সংরাগ সেই দিনই অনুভব করেছিলাম। সেদিনই প্রথম বুঝেছিলাম নারী পুরুষ হৃদয়কে কতখানি উথালপাথাল করে দিতে পারে। সেইদিনই বুঝতে পেরেছিলাম আমার মধ্যেও এক বসন্তকাল জেগে উঠতে চাইছে। ঝড় ওঠার পূর্বমুহূর্ত। মেয়েটির পিতা আমার নাম জিজ্ঞেস করলেন, আমার বাবার নাম জিজ্ঞেস করলেন। আমি কী পছন্দ করি, লেখাপড়া করতে ইচ্ছা আছে কিনা সে কথাও জিজ্ঞেস করলেন। সবকিছুর ঠিক ঠিক উত্তর দিতে পেরেছিলাম এবং আমার ভবিষ্যতে বহুদূর পর্যন্ত লেখাপড়া করার ইচ্ছা আছে এ কথা সবিনয়ে জানিয়েছিলাম। সব শুনে মেয়েটির পিতা বলেছিলেন, হমারা সাথ চলো, হমারা দো লড়কিঁয়া, তুম হমারা লড়কা বনকর রহোগে।
আমি মাথা নিচু করে আমার অসম্মতি জানিয়েছিলাম। অচেনা অজানা পরিবারটির সঙ্গে আমার যাবার ইচ্ছে ছিল না। যদিও অন্তরের টানটি তীব্র হয়ে উঠেছিল তাদের ষোড়শী কন্যাটির জন্য। তারা ছিল ছোট্ট কৃষক পরিবার। জমিজিরেত আছে তাতে সব রকম ফসল ফলে। বাড়িতে কোনো অভাব নেই। জমি দেখাশোনা করলেও দিব্যি সংসার চলে যাবে। আরও দুটি স্টেশন পর তারা নেমে যাবার কথা বলেছিল। কিন্তু আশ্চর্য, আমাদের ক্ষুধা-তৃষ্ণার কথা বুঝতে পেরে ওদের বাড়ি থেকে তৈরি করে আনা ভুট্টার রুটি খেতে দিয়েছিল। সেই শুকনো রুটি খেয়েই এক ঘটি জল পান করে অনেক তৃপ্তি পেয়েছিলাম। বাকি পথটুকু আর কষ্ট হয়নি। প্ল্যাটফর্মে নেমে গিয়েও সেই মেয়েটি জানালা দিয়ে দীর্ঘক্ষণ চেয়েছিল। যার দৃষ্টিতে ছিল গভীর আকুতি। আমিও দৃষ্টি ফেরাতে পারছিলাম না। কখন দুই চোখ ভিজে গেছিল বুঝতে পারিনি। পরবর্তী জীবনে টের পাই, প্রেমের কবিতা লেখার ভিত্ ওই কয়েক মুহূর্তই যেন নির্মাণ করে দিয়েছিল। আজও সেই নির্মাণে ইমারত গড়ে তুলতে পারছি। সেদিনও মনে মনে যে কবিতাটির জন্ম হয়েছিল, তা কোনোদিন না লিখলেও গুন গুন করে আপন মনে গেয়েছিলাম:
“অনেক জ্বালায় পুড়তে পুড়তে দেখেছিলাম একটি মুখ
সেই মুখই সব মুখের পরে এঁকে দিচ্ছে অনন্ত সুখ।
এমন চোখের দৃষ্টি হেনে আমায় সে করছে খুন
সব আঁধারে সেই তো আলো বুকের মাঝে একটি moon.”
চলবে….
Dr. Taimur Khan