একটি আত্মগত গদ্য
এই কবিতাজীবন (ধারাবাহিক)

পর্ব-৩
দাও সবে গৃহছাড়া লক্ষ্মীছাড়া ক’রে

মাধ্যমিক পরীক্ষা হয়ে গেলে রেজাল্ট বের হতে কমপক্ষে দুই মাস সময় লেগে যায়। কিন্তু আমার পরীক্ষা দিয়ে এসেও বসে থেকে অপেক্ষা করার কোনো সময় নেই। বাড়িতে প্রচণ্ড অভাব। সবাই ছোট ছোট ভাই-বোন। তাই খিদের তাড়নায় সকাল সকাল ঝুড়ি আর কোদাল নিয়ে নতুন রাস্তা তৈরির জন্য মাটি কাটার কাজে যেতে হয়। সারাদিন মাটি কেটে আট-দশ টাকার বেশি হয় না। তারপর একদিন শুনলাম পঞ্চায়েত থেকে রিলিফে পুকুর কাটা হচ্ছে। সারাদিন কাজ করলে ৫ কেজি গম পাওয়া যাবে। সেখানেও বেশ কিছুদিন কাজ করে শরীর প্রায় অবসন্ন হয়ে পড়ল। মাটির ঝুড়ি মাথায় বয়ে বয়ে রাত্রিবেলায় মনে হত মাথার ঘিলু ব্যথায় চিনচিন করছে। কিছুতেই ঘুম আসে না। দুই হাতের তলায়ও কোদাল ধরে ধরে প্রায় কড়া পড়ে গেছিল। হাতের মুঠোও করতে পারছিলাম না। তখনও মাটি কাটার জন্য আধুনিক প্রযুক্তিবিদ্যার এমন উন্নতি হয়নি অর্থাৎ জেসিপি আসেনি। তাই মানুষের দ্বারা-ই দীর্ঘদিন ধরে সেসব কাজ হত। সেদিনকার এই কড়া পড়া হাতের চিহ্ন আজও আমার হাতে বিদ্যমান। এতদিন পরও মুছে যায়নি। যাইহোক এ কাজ আমি বেশিদিন করতে পারব না বলেই মনে মনে একটা সিদ্ধান্ত হল। বাবা বললেন, তাহলে গেরস্থ বাড়িতে মাহিন্দারের কাজ করাই ভালো। গরু-বাছুরের সেবাযত্ন, জল তোলা, খড় কাটা, ধান সেদ্ধ করা ইত্যাদি অনেক সহজ হবে।
কিন্তু আমার মন সাই দিলো না। পরের বাড়িতে পরাধীন হয়ে ফাইফরমাস খাটা আমার স্বাধীন সত্তা কিছুতেই মেনে নিতে পারল না। কেননা আগেও এ কাজ বহুবার করেছি। সে বিষয়ে আমার বহু অভিজ্ঞতাও আছে।
বাবার প্রতি রাগ করেই সময় কাটাতে লাগলাম। আগে সারা মাঠ ঘুরে ঘুরে ধানের সময় ঝরা ধানের শিষ কুড়িয়ে আনতাম। সেই ধান শুকিয়ে কখনো চাল বের করা হত। কখনো তা দোকানেই বিক্রি করে দিতাম। ধান কুড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে একটা ছোট কোদালও সঙ্গে থাকত। মাঠের আলে ইঁদুরের গর্ত দেখলেই মাটি খুঁড়ে খুঁড়ে সেই গর্তের ধান তুলতাম। মাটির তলায় দীর্ঘদিন থাকার ফলে ধানগুলোর রং একটু গেরুয়া অথবা কালচে হয়ে যেত। কখনো দেখতাম অঙ্কুরোদগম হয়ে গেছে। সেই ইঁদুর গর্তের ধান তুলতে তুলতেই মাটির সোঁদা গন্ধে দারুণ উজ্জীবিত হতাম। একদিকে ধান পাওয়ার আনন্দ, অন্যদিকে মাটির এই গন্ধ আমার ক্লান্তি দূর করে দিত। মা বলত, ইঁদুর গর্তের ধানে ভালো মুড়ি হয়। তাই কখনো কখনো তা সেদ্ধ করে চাল বের করে মুড়ি ভাজা হত। এভাবেই রসদ জোটাতাম। কিন্তু এই সময় গ্রীষ্মকাল। চারিদিকে গনগনে রোদ। রাস্তাঘাট শুনশান। বাবা তালের গাছে তখন তাড়ি পাততেন। কুড়ি পয়সা গ্লাস সেই তাড়ি বিক্রি করে কোনো রকম খাবার জুটত। আমার অভ্যাস হয়ে গেছিল খালি পেটেই তাড়ি গেলা। কেননা তাড়ি খেলেই ঘোরধরা চোখে কিছুটা অসাড় হয়ে পড়তাম। অনেকটা আরাম বোধ হত। কোনো গাছের ছায়ায় অথবা পুকুরমরা পাঁকে গিয়ে শুয়ে থাকতাম। সারাদিন ওই ভাবেই কেটে যেত। একদিন তাড়ি খেতে খেতেই পরিচয় হল সিদ্দিক ভাইয়ের সঙ্গে। সিদ্দিক ভাই দুই চোখে অন্ধ। দিনের বেলা ঝাপসা দেখে, তবে রাত্রিবেলা স্পষ্ট দেখতে পায়। ব্রহ্মাণি নদীর তীরবর্তী কার্তিকডাঙা গ্রামে তার বাড়ি। সে-ই পরামর্শ দিলে,মুম্বাই গেলে অনেক কাজ পাওয়া যাবে। আরও জানালে, আমি মুম্বাই গিয়ে রাস্তার ধারে বসে ভিক্ষে করি। আমার সঙ্গে থাকে খালেক ভাই। দুজনেই ভিক্ষে করি আর রাত্রিবেলায় মসজিদ বন্দরে রাস্তার ধারে একটা দালান বাড়ির বাইরে সিঁড়ির কাছে রাত কাটাই। কখনো অডালার ঝোপড়া পট্টির কারও ঝোপড়ায়। তারপর দু-তিন মাস কিছু রোজগারপাতি হলেই বাড়ি ফিরে আসি।
আমি বললাম, আমি গেলে কাজ পাব?
সে বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ, একটা কিছু পাওয়া যাবেই।
আমি ইতস্তত করে বললাম, আমার যে টাকাকড়ি কিছুই নেই। ট্রেনের টিকিট কাটব কী করে?
সিদ্দিক ভাই বলল, আমি তো অন্ধ মানুষ, তাই আমি প্রতিবন্ধী। প্রতিবন্ধীদের কোনো টিকিট লাগে না। সঙ্গে বিনা টিকিটে একটা লোকও নিয়ে যেতে পারে। কতবার কতজনকে সঙ্গে নিয়ে গেলাম! তাছাড়া খালেক ভাই কুষ্ঠরোগী। সেও তো যাচ্ছে সঙ্গে। চিন্তার কোনো কারণই নেই।
সিদ্দিক ভাইয়ের কথা শুনে খুব আনন্দিত হলাম। আমার মুখ রাঙা হয়ে উঠল যেন মুখের ওপর আগামি দিনের প্রভাত সূর্যের আলো এসে পড়ল। খালেক ভাই আমার দূর সম্পর্কের এক দিদির জামাই। আমাকে তো সে-ও খুব ভালোবাসে। এতদিন কেন এই কথাটা ভাবিনি? যাক শেষপর্যন্ত সবকিছুরই একটা সুরাহা হয়ে গেল। সেদিন সিদ্দিক ভাইয়ের আনা চানাচুর আর চাল-কলাইভাজার চাট পেয়ে একটু বেশি বেশিই তাড়ি গিলে ফেললাম। বাড়ি ফিরতে সন্ধে হয়ে গেল।
কিন্তু বাড়ি ফিরেও খালি পেটের তাড়ি হজম করতে পারলাম না। মুখ দিয়ে হড়হড় করে বমি হয়ে গেল।
একটুতেই ক্লান্ত বিধ্বস্ত হয়ে পড়লাম। বাড়িতেও সেদিন রান্না চড়েনি। যে তাড়ি বিক্রি করলে কিছু পয়সা আসত, সে তাড়ি তো আমরাই গিলে ফেলেছি। এতটা তো খাওয়ার কথা ছিল না! আর যে ক’গ্লাস বিক্রির কিছু খুচরো টাকাকড়ি পেয়েছিলাম, তা আমার কাছেই থেকে গেছে। বাবা বাড়ি নেই। একজনের গরু কেনার জন্য ঝাড়খণ্ডের দুমকা গেছেন। তাই গাছে তাড়ি পাড়া এবং বিক্রি করার দায়িত্ব আমাকেই দিয়েছেন। আমি তাড়ি পেড়ে খুব সামান্যই বিক্রি করতে পেরেছিলাম। বাকিটা সবই সিদ্দিক ভাই ও আমি মিলে সাবাড় করে দিয়েছি।
বাড়িতে সেদিন কীভাবে সবাই না খেয়ে রাত কাটিয়েছিল সে-কথা না বলাই ভালো। শুধু মা খুব আফসোস করে আমার মাথায় জল ঢেলে যাচ্ছিল অর্ধেক রাত পর্যন্ত।
পরের রাতেই আমরা মুম্বাই রওনা দেবো। রাত বারোটায় মোঘলসরাই এক্সপ্রেস। সন্ধেবেলা গিয়ে রামপুরহাট স্টেশনে বসে থাকতে হবে।মোট আমরা তিনজন। সিদ্দিক ও খালেক ভাই দু’জনেই ঘাড়ে একটা করে ফকিরি ঝোলা ঝুলিয়ে নিয়েছে। হাতে একটা করে বাঁশের লাঠি। আমাকে বলে দিয়েছে, লাঠির একটা দিক ধরে আমি আগে আগে যাব। পিছনে আর একটা দিক ধরে সিদ্দিক ভাই। খালেক ভাই আমাকে রাস্তা দেখাবে। সঙ্গে খাবারদাবার কিছুই নেই। রাস্তাঘাটে কিছু চেয়েচিনতে ধান্দা হলে ভালো, না হলে আল্লাহর ওয়াস্তে বেরিয়ে পড়া।
এভাবেই যাবার দিন বেরিয়ে পড়েছিলাম। কারও পকেটে কিছুই কানাকড়িও ছিল না। আমার তো পাজামা আর পুরনো একটা হাওয়াই শার্ট যার পকেট পর্যন্ত ছেঁড়া। শুধু খালেক ভাই পলিথিন প্যাকেটে ছাট্টি মুড়ি আর জল খাওয়ার জন্য একটা ঘটি রেখেছিল।
রাত বারোটায় ট্রেন আসতে দেরি হয়নি। ভিড়ে ঠাসা ট্রেনে বহুকষ্টে তিনজনে উঠেছিলাম। সবাই হিন্দিতে আমাদের গালিগালাজ করছিল। আমরা কারও কথার কোনো উত্তর দিচ্ছিলাম না। কারও কথা যেন আমরা শুনতেই পাচ্ছি না এরকমই ভাব। শুধু খালেক ভাই একবার বলল, বহুত শরিফ আদমি হ্যায় বাবুজি, থোড়াসা খড়া রহেনেকে লিয়ে মোকা দিজিয়ে।বহুদূর তক্ যানা হোগা!
আমার কেবলই মনে হচ্ছিল সেই কবিতাটির কথা, যেটি আমি কবি নজরুলের জীবনী পড়তে গিয়ে পড়েছিলাম, নজরুল যখন গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে গেছিল শহরে কাজের উদ্দেশ্যে।লেখক লক্ষ্মণচন্দ্র বিশ্বাস তখন সেটা উল্লেখ করেছিলেন। পুরো কবিতাটি আমি পরে আবিষ্কার করি রবীন্দ্রনাথের বই থেকে। সেই কবিতাটিই আমার মন্ত্র হয়ে উঠল:
“পূণ্যে পাপে দুঃখে সুখে পতনে উত্থানে
মানুষ হইতে দাও তোমার সন্তানে
হে স্নেহার্ত বঙ্গভূমি, তব গৃহক্রোড়ে
চিরশিশু করে আর রাখিয়ো না ধরে।
দেশদেশান্তর-মাঝে যার যেথা স্থান
খুঁজিয়া লইতে দাও করিয়া সন্ধান।
পদে পদে ছোটো ছোটো নিষেধের ডোরে
বেঁধে বেঁধে রাখিয়ো না ভালোছেলে করে।
প্রাণ দিয়ে, দুঃখ স’য়ে, আপনার হাতে
সংগ্রাম করিতে দাও ভালোমন্দ-সাথে।
শীর্ণ শান্ত সাধু তব পুত্রদের ধরে
দাও সবে গৃহছাড়া লক্ষ্মীছাড়া ক’রে।
সাত কোটি সন্তানেরে, হে মুগ্ধ জননী,
রেখেছ বাঙালী করে, মানুষ কর নি।”
চলবে….
Dr. Taimur Khan