Dr. Taimur Khan

তৈমুর খান

সাহিত্য অনুষ্ঠানগুলোতে আমি কেন যেতে চাই না
🍁

তৈমুর খান


🗣️প্রায় প্রতিদিনই সাহিত্য অনুষ্ঠানে যোগদানের ডাক আসে, খুব আন্তরিক ডাক। কিন্তু অনুষ্ঠানগুলোতে যোগদান করার উৎসাহ জাগে না। তার বেশ কিছু কারণ আছে। তারমধ্যে উল্ল্যেখযোগ্য হল:


১,আমি বহু দূরে থাকি, বীরভূম জেলার একটি প্রান্তিক গ্রামে। এখান থেকে যাওয়া-আসা বেশ কষ্টকর।


২,যে কোনো অনুষ্ঠানে যোগদান করে আমি দেখেছি, বেশিরভাগই শোনারযোগ্য সাহিত্য পাঠ হয় না। এমন সব সাহিত্যিকদের পাঠের সুযোগ দেওয়া হয়, সাহিত্য সম্পর্কে তাঁদের সম্যক ধারণা নেই। সাম্প্রতিককালের সাহিত্যের গতিবিধি বা মানসম্মত পাঠ করা বিষয়টি সাহিত্য কিনা সে সম্পর্কেও তাঁরা অবগত নয়। আমার এটা অহংকার নয়, এ কথা বলার যুক্তি হল: আমি বহুদূর থেকে অনুষ্ঠানে এসে এসব শুনে যেমন কালক্ষেপ করতে চাই না, তেমনি নিজের মেজাজটাও ভালো রাখতে চাই।


৩,অনুষ্ঠানগুলিতে এসে বাড়ি ফেরার পথে উপস্থিত সাহিত্যিকদের দেওয়া বইপত্রের বোঝা এতই বেশি হয়ে যায় যে আমার বয়ে আনার সামর্থ্য থাকে না। সারা রাস্তা বহু কষ্ট পাই। যদিও কষ্ট করে সেসব বয়ে আনা হয়, বাড়ি এসে অধিকাংশ বই-ই পাঠযোগ্য নয়, এটা দেখে খুব নিরাশ হই। সাহিত্যের নামে যে সব লিখে আইএসবিএন নাম্বার দিয়ে প্রকাশনা সংস্থা থেকে বই ছাপিয়ে বিলি করে এবং সেসব বইকে ‘দুর্দান্ত’ ভাবে। আমি পৃষ্ঠা উল্টাতে উল্টাতে তখন কষ্ট পাই। আরো কষ্ট পাই: কোনো নামকরা সাহিত্যিক যখন বইটির ভূমিকা লিখে দিয়েছেন, কিংবা আশীর্বাদ বাণী পাঠিয়েছেন, কিংবা শুভেচ্ছা বার্তা।


৪,পরবর্তী সময়ে আরও সমস্যা দেখা দেয়, যেসব সাহিত্যিক বইপত্র দেন, তাঁরা কেউ কেউ দুবেলা ফোন করেন: কেমন হয়েছে আমার বইটি? শিগগির পড়ে মতামত জানান। অমুক সাহিত্যিক খুব সুনাম করেছেন। তমুক সম্পাদক আগামী বইমেলায় পুরস্কার দেবেন।… এসব শুনতে শুনতে কান ভারী হয়ে যায়। আমি কেমন আছি,আমি সুস্থ কিনা, আমি ভালো আছি কিনা, আমি আনন্দিত কিনা এসবের কোনো খোঁজখবর নেওয়ার কোনো প্রয়োজন হয় না এঁদের।


🗣️সুতরাং সাহিত্য অনুষ্ঠানগুলোতে যাওয়া আমার কাছে আতঙ্কের হয়ে ওঠে। কুৎসিতকে মুখের সামনে সুন্দর বলতে হয়। ভাবি, সত্যি কথাটা বলব, কিন্তু পারি না।


একজন সাহিত্যিকের প্রকৃত চরিত্র কেমন হবে সে সম্পর্কে প্রত্যেকেরই অবহিত হওয়া দরকার। সাহিত্যিক হতে গেলে প্রথমে তাঁকে দুঁদে পাঠক হতে হবে। সাম্প্রতিককালের সাহিত্য বিষয়ে সম্যক ধারণা রাখতে হবে। যেটা তিনি পাঠ করছেন সেটা আদৌ সাহিত্য কিনা সেই বিচার করতে হবে। নিজের লেখাটি সর্বদা ভালো এই ধারণা পরিত্যাগ করতে হবে। মোটকথা প্রথমত তাঁকে আত্মসমালোচক হতে হবে। গতানুগতিক ধারণায় সাহিত্য রচনা করে মঞ্চে উঠে মঞ্চ কাঁপানো সাহিত্য নয়।

আর অধিকাংশ ক্ষেত্রে এটাই ঘটে চলেছে। সাহিত্যিক হবেন নিভৃতচারী, বুদ্ধিদীপ্ত, এবং অবশ্যই কৌতূহলী। তাঁর জানার আগ্রহ থাকবে অসীম। কিন্তু বাস্তবে এসবের দেখা পাই না। ফলে দারুণভাবে হতাশ হতে হয়। নতুন সাহিত্যিকরা যেমন এসব অনুষ্ঠানে পরিপুষ্টি লাভ করেন না, তেমনি সাহিত্য সম্পর্কে গতানুগতিক ধারণাই থেকে যায়। ফলে সাহিত্য সম্পর্কেও তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গিরও বদল ঘটে না।

বেরিয়ে আসতে পারেন না কোনো ভালো সাহিত্যিকও। এসব অনুষ্ঠানে এসে এখনো কানে আসে মঞ্চে উঠে আমন্ত্রিত সাহিত্যিক বলছেন: “আমি রবীন্দ্র সংগীতের মতো একটা সংগীত রচনা করেছি, সেটা গেয়ে শোনাচ্ছি।” “আমি জীবনানন্দ দাশের মতো একটা কবিতা লিখেছি সেটা পাঠ করে শোনাচ্ছি।” “আমি সাঁওতালি আঞ্চলিক ভাষায় একটা কবিতা লিখেছি সেটা অভিনয় করে দেখাচ্ছি।” “আমি রবীন্দ্রনাথের মতো একটি ছোটগল্প লিখেছি সেটি পাঠ করছি।” “আমি মাইকেল মধুসূদনের মতো একটি সনেট লিখেছি সেটি এখন পড়ছি।” এইসব শুনতে শুনতে বাড়ি ফেরার ক্লান্তিতে মেজাজ তিক্ত হয়ে যায়। নিজের কান নিজেই ম’লে দিই। নিজেকেই শাসন করে বলি: আবার যদি অনুষ্ঠানে যাবার নামটি করো, তো তুমারই একদিক কী আমারই একদিক!

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *