ছকের বাইরের লেখা
তৈমুর খান
লেখাকে চিরাচরিত ফর্মুলার মধ্যে রেখে যাঁরা তাঁদের শিল্পকর্মের অভ্যাস করেন তাঁদের ধারে কাছেও দীপঙ্কর বেরা নেই। হ্যাঁ দীপঙ্কর বেরার কথাই বলছি, সম্প্রতি তাঁর প্রকাশিত ‘কৃষ্ণচূড়া রাধাচূড়া’(প্রথম প্রকাশ বৈশাখ ২০২১) গল্প না-গল্পের মধ্যেই তিনি তাঁর লেখকর্মকে দাঁড় করাতে চেয়েছেন। শিল্প সুষমা বর্ধন করল কিনা, ভাষা ব্যঞ্জনায় উচ্চকিত হল কিনা, কলানৈপুণ্যে অনন্য পথের সন্ধান পেল কিনা সেসব নিয়ে তিনি ভাবেন না।
তিনি ছেঁড়াখোঁড়া, অসম্পূর্ণ, সাদামাটা, মেঠো ও হাটুরে জীবনের টুকরো টুকরো কিছু সংলাপ, কিছু ঘটনা, কিছু অঘটনা, কিছু নীরবতা, কিছু শূন্যতা নিয়ে উপস্থিত হন। আপাত সেগুলোর মধ্যে কোনো শিল্পবৈভব আমরা খুঁজে পাই না। লেখকের দক্ষতাকেও মান্যতা দিতে চাই না। তবুও টুকরো টুকরো জীবনআকাশের মেঘের আড়ালে চন্দ্রকণার ঝকঝকে পাত খুঁজে পাই।
যা থেকে আমাদের ভাবনারানিকে অলংকার বানিয়ে দিতে পারি। আমাদের পড়শী মায়ামোহিনীকে নূপুর করে পরাতে পারি। দেখার চোখ থাকলে তখন সেই সৌন্দর্যও আমাদের ভালোলাগার বস্তু হয়ে উঠবে। শোনার কান থাকলে তখন সেই নূপুরের শব্দও সুরেলা ঝংকার তুলবে।
হ্যাঁ দীপঙ্কর বেরা। ৪৩ টি অণুগল্পের ধারায় নকশা জাতীয় রচনা লিখেছেন। কোনোটাই দীর্ঘ নয়। কিন্তু প্রতিটিতেই লেখকের বাস্তব চেতনা অভিজ্ঞতার আলোকে আলোকিত হয়ে উঠেছে। মানব জীবনের রোমান্সগুলি যৌবনোদ্গমে যেমন উঁকি দেয়, তেমনি উঁকি দিয়েছে। রাধাচূড়া কৃষ্ণচূড়া হয়ে ফুটেছে। কাছে আসতে চেয়েছে। আবার দূরে চলে গেছে। পার্কের বেঞ্চিতে গিয়ে বসেছে।
হৃদয়ের শব্দ শুনেছে। চোখে চোখে তাকিয়ে বিমুগ্ধ হয়েছে। প্রথম ভালো লাগার মুখটি, হাসিটি, বাসরশয্যায় অন্যমেয়ের মুখে খুঁজেছে। প্রাত্যহিক জীবনের কর্মব্যস্ততার ফাঁকে মুচকি হেসেছে। দারিদ্র্যের কশাঘাত সহ্য করেও আবার স্বপ্ন দেখেছে।অপত্যস্নেহের বন্ধন উপলব্ধি করেছে। সততা শুভবুদ্ধি নিয়ে অগ্রসর হলেও অজানা আশঙ্কায় কুঁকড়ে গেছে। কখনো আবার শ্মশান-কারখানার পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে এক সর্বহারার শূন্যতায় আক্রান্ত হয়েছে।
জীবনের শেষপ্রান্তে পৌঁছে ইন্স্যুরেন্সের টাকা পেতে ছাত্রের সাহায্য পেয়েছে। ছাত্রই তখন অফিসার। তাই শিক্ষাদানটাও একজন শিক্ষকের কাছে ইন্সুরেন্স। ঝুপড়িতে থাকা, কখনো উদ্বাস্তু জীবন, কখনো নতুন দালান করার পরিকল্পনা, কখনো মাটির বাড়ি সব এসে ভিড় করেছে। গৃহস্থ বাড়ির লোকেরা ভাগচাষির ছেলের মেধাকেও সন্দেহ করেছে। একের পর এক সন্তান জন্মগ্রহণ করলেও সন্তান নেওয়ার প্রক্রিয়া যখন বন্ধ হয়নি। তখন বারবার জ্ঞান দিতে এসেছে পাড়াপড়শি। কিন্তু এক টাকা সাহায্য করতে আসেনি।
ক্ষুন্নিবৃত্তি জীবনের নানা অন্তরায়, আবেগ, অভিমান, কলহ, দাম্পত্য সম্পর্ক, সমাজের অভিজাত শ্রেণির ভ্রূকুটি লেখাগুলিতে সবকিছুই ফুটে উঠেছে। মদের আসর থেকে লিটল ম্যাগাজিনে লেখার আসর, সাদাসিধে জীবনযাত্রা— বহুমুখী বহু বিষয় ধরা পড়েছে। লেখক এসব লিখতে লিখতে সাম্প্রতিক সময়ের নিজের অবস্থানটিও অকপটে জানাতে ভোলেননি। ‘আমি লিখি’ নামক লেখাটিতে লিখেছেন:
“বাড়ি ফিরে বাজার ফেলে দিয়ে বউয়ের ফাইফরমায়েস খাটতে শুরু করলাম। যেচে বাসন মেজে দিলাম।
এসব মাঝেমধ্যে করি। তাই বউ খুশি হল। ছেলে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে। ভাবলাম আমার সুখী সংসার। নিশ্চয়ই এটাই কঠিন কাজ।
অফিসে গিয়ে বেশ মন দিয়ে কাজ করলাম। পঁচিশ বছর নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করছি। এটাও বেশ কঠিন কাজ।
বিকেলে চা দোকানে সুভাষ বাবুর সঙ্গে দেখা। বললেন— আজ সারাদিন কত রকম করে কি কি ভাবলে?
আমি হেসে বললাম— ওই রোজ যেমন ভাবি। নতুন কিছু নয়।
—তবু তোমার সঙ্গে কথা বললে বড় ভালো লাগে। আমরা তো কবেই ছেড়ে দিয়েছি। পেপার তাই ঠিকমত পড়ি না। সেই মোবাইলে সময় কাটাচ্ছি কিন্তু যেই কাল অক্ষর সামনে এসে গেল অমনি চোখে আর সইল না।
পাশে ছিল জয়। আমার সঙ্গে বাস থেকে নেমেছে। বলল— ঠিক বলেছেন সুভাষদা, চোখের সামনে যা দৃশ্য দেখছি, সত্যিই এ বড় কঠিন সময়।
আমি তো একসঙ্গে এলাম। কই সেরকম খারাপ কিছু তো চোখে পড়ল না।
সুভাষ বাবু বললেন— আরে বাবা আমি কোনো কঠিন সময়ের কথা বলিনি। আপনাকে বোঝানো যাবে না। যতসব ফালতু কথা।
এই নিয়ে সুভাষবাবু ও জয়ের মধ্যে একটু উষ্ণ বাক্য বিনিময় শুরু হল। যোগ দিলো আরও দু চারজন। আমিও ভাবছি এইসব দিনকাল সমাজ রাজনীতি শিক্ষা সরকারি স্বাস্থ্য নিয়ে দু-চার কথা কবিতা ও গল্পের মাধ্যমে লিখি। সেজন্য ছেলে বলে— এসব ফালতু টাইমপাস লেখা কেন লেখ? বউ বলে— কি হাবিজাবি লেখ। আমি একদিন বলেছিলাম— শোনো না, ফেসবুকে দু’চারজন আমার লেখা পড়ে। দু-একটি লিটিল মাগাজিনে লেখা বের হয়।
তো একটা বই বের করব? বউ বলেছিল— লোকে এত সাহিত্যিক থাকতে তোমারেই হেঁদিপেঁচি লেখা পড়বে? পাশে ছেলেও অট্টহাসি হেসেছিল। অফিসে দু’চারজন জানে আমি লিখি। তার জন্য বই পড়তে হয়। অন্যরকম ভাবতে হয়। তবু তারাও বলে— বাদ দাও তো। যতসব। এসব কোনো লেখা হল! কাজ নেই কাম নেই দুবেলা ফেসবুকে পোস্ট করছে। যতসব ফালতু।”
এই লেখার শেষ লাইনটি ছিল—
“তাই আমি লিখি। যা মনে হয় তাই লিখি।”
এইসব লেখার মধ্যে অকপট সময়ের হালচাল এবং নিজস্ব জীবনবৃত্তান্ত ফুটে ওঠে। শিল্প গরিমা নেই। বড় কোনো পুরস্কার পাওয়ার আকাঙ্ক্ষাও নেই। তবু ভালো, তাস খেলে, মদ খেয়ে, পরের কুৎসা করে জীবন না কাটিয়ে নিজের লেখার কাছে বসে অনেকটাই স্বস্তি পাওয়া যায়। সুতরাং দীপঙ্কর বেরা যা মনে হয় তাই লেখেন। তিনি কোনো পাপ করেন না।
কৃষ্ণচূড়া রাধাচূড়া: দীপঙ্কর বেরা, সুতরাং প্রকাশনী, বাণীপুর (সি ব্লক), উত্তর ২৪ পরগনা, পিন কোড-৭৪৩২৩৩, চলভাষ ৯৫৬৪৩২১৩১১ , মূল্য-১০০ টাকা।
