ভূত বিহার /দীপঙ্কর বেরা
নিউক্লিয়ার ফ্যামিলিতে নিজেকে মুক্ত করে ‘আসছি’ বলে দু একদিন বেরিয়ে পড়া সত্যিই মুশকিল । মিসেস জানে গোপলার যা কাজ তাতে অফিসের কাজে যাচ্ছি বলে বেরিয়ে পড়া যাবে না । তবুও একা বেরিয়ে পড়ে গোপলা ।
নিজের গ্রামে রাতের শেষ বাস থেকে স্টপেজে নেমেও কিছুটা পেছনে হেঁটে ছোট খাল পেরিয়ে পতিত জমির পুকুরপাড়ে বসে রইল । খেয়েছে সেই দুপুরে । দূরে দূরে টিমটিমে লো ভোল্টেজ কারেন্ট বা কুপি জ্বলছে । এখনও অনেকেই জেগে আছে। একটু পরে যেতে হবে ।
আকাশের দিকে তাকাল – আমার বেঁচে থাকার কারণ কি ? কি সুখ? কিসে সুখ ? ভাবতে ভাবতে ঝিমুনি এসে গেল । পাশে খড়খড় শব্দে দাঁড়িয়ে পড়ল । ধূসর রঙের চাদর মাথায় জড়িয়ে নিল । এবার যাওয়া যেতেই পারে ।
অন্ধকার হলেও রাস্তা মুখস্থ । এখানেই তো চব্বিশ বছর জীবনের ভিত গড়া সময় কেটেছে । আর সেটুকুই ভাঙিয়ে গোপলা এখন অফিস বস । বলিহারি যাই ।
মাটির রাস্তা পাকা হয়েছে । এ সময়ে গ্রামের রাত কখনও দেখে নি । তখন ছিল কেবল ভূতের ভয় । পেছন ফিরে দেখল কেউ কোন ভূত পেছনে আসছে না তো ।
রাস্তার ধারের গাছগুলো এলোমেলো । গ্রামের সেই সোঁদা গন্ধটা পাচ্ছে না । বদলে কেমন যেন ভ্যাপসা হেমন্তের রাত । শুনশান মাঝ প্রহর । নিজের পায়ের শব্দ ছাড়া আর কিছু নেই । গ্রামের কুকুর ঝিমিয়ে পড়েছে ।
মহীমবাবুদের কুকুর আছে কি ? তা প্রায় মাঝে তিরিশ বছর পার । শেয়াল বা গাছে পাখির ঝাপটা কিছুই নেই । গোপলাকে চিনতে পারল কি ?
গোপলা নিজেকে জিজ্ঞেস করল – কোথায় চলেছিস ? উত্তর – নিজেকে খুঁজতে ।
বিভাসকাকু যে বলত – তুই ক্লাসের ফার্স্ট বয় । গ্রামের মুখ উজ্জ্বল করবি । তোর জন্য গর্ব হয় । তিনি কি ঘুমচ্ছেন ? অনেক বয়সও হবে । একদম রাস্তার গা ঘেঁষে সনাতনীর বাড়ি । বলেছিল – আমাদের মনে রাখিস ।
মনে তো আছেই। অন্ধকারে ।
ধান জমির ছোট্ট আল পেরিয়ে দাঁড়াল বাড়িটার সামনে । বাঁশের দরজাটা সেই দড়ি পেঁচিয়েই বাঁধা । খুলেই ঢুকল । মা বলত – খোকা এলি ? আবছা আঁধার আজ আর ডাকল না ।
মারা যাওয়ার শেষ কয়দিন খুব যন্ত্রণায় ছটপট করেছিল । কাজের দোহাইয়ে শেষ দেখা দেখতে আসে নি । তার আগে মা কিভাবে মানসিক যন্ত্রণায় ডাইনি অপবাদে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল । শুধু সম্পত্তির লোভে । গোপলা কিছু না পেয়েও সেই আধিভৌতিকে জড়িয়ে পড়ে । গ্রাম ছাড়ার সাথে সাথে দোষী করে না ঢোকার হুমকিও ছিল ।
তবুও সে অপমান তোয়াক্কা না করে রাতের ভূত পরাভৌতিক প্রচারের সাথে যুজতে এল । লুকিয়ে ।
আজ মা ঝাঁপিয়ে পড়ে গলা টিপে ধরুক । বলুক – ভূতুড়ে বাড়িতে ভুত খুঁজতে এলি ? আমি বেঁচে থাকতে কোথায় ছিলি ?
আবছা অন্ধকারে নিজেকে আঁচ করতে লাগল । পাল্টে গেছে কিছু খুঁটি। দেওয়ালগুলো ছিটে বেড়া থেকে আধা খাপছাড়া ইট লাগানো হয়েছে । মুখে ঝুল কালি লেগে গেল । কোথাও ভূতুড়ে রহস্য কেন নেই , কেন গা ছমছম করছে না ? ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক খড়ের গাদায় মচমচ শব্দ বাঁশবনের ক্যাঁচকোঁচ সবই আছে কিন্তু ভূত বা ভূতের ভয় কিছুই নেই ।
পায়ে ঠোক্কর লাগল । ইঁদুরে মাটি তুলেছে । দেওয়ালে ধাক্কা খেল ।
দেখল দূরে দেখা টিম টিম আলো জ্বলছে । শুনেছে গ্রামের সবচেয়ে ঝাঁ চকচকে বাড়ি । হ্যাঁ , ওই তো মোড়লের বাড়ি।
যেই গোপলা পড়াশুনা করে কাজে বাইরে বেরিয়ে পড়ল তাকেই নানান কায়দা করে গ্রাম ছাড়া করার তালে থাকল । পরে মা বাবাকে গোপলা নিজের কাছে এনে রেখেছিল । কিন্তু সম্পত্তি !
আর সুখ দুঃখের এই বাড়ি । আশেপাশে খুব কম লোক থাকে । গ্রামের ক্ষমতা জাহির করতে এই বাড়িকে ভূতুড়ে করেছিল । বেশ ভালই আম কাঁঠাল আরো গাছও বসিয়েছে । তখন সন্ধ্যে হলেই তাল গাছের ঝড়ঝড় আওয়াজ পুকুরে মাছের ঝুপঝাপ শুনে ভূতের ভয়ে বুক কাঁপত গোপলারও ।
নিজের স্মৃতির সাথে কেমন করে মা বাবা আর এই ঘর সারাটা গ্রামকে তটস্থ করে রেখেছে কে জানে ?
কি ভীষণ এই গ্রামের একচ্ছত্র হওয়ার লোভে ! এবং তাতে সফলও ।
এতক্ষণ এই বাড়িতে ও আশেপাশে ঘুরে কোন ভূত দেখতে পেল না । তাহলে সব ভূত কাহিনীর পেছনে গল্প থাকেই ।
কিছু না নিয়েও মা বাবা মারা যাওয়ার পর গোপলাও এই গ্রামে ভূত হয়ে থেকে গেছে । দু তিন বার এসেও গ্রামে যে অনাদর অনামুখো হয়েছে তা ভোলার নয় ।
মা বাবা অনেককে ভয় দেখিয়ে রোগ ছড়িয়ে অকাল এনে নাকি গ্রাম নষ্ট করেছে বলে প্রচার । আজ মা বাবা নেই । আর কি প্রমাণ করবে গোপলা ?
এই গ্রামে ভূত হয়ে থেকে যেতে গোপলা ফিরে এল ভোর হওয়ার আগেই ।