Dilip Kumar Dey

পাগলা মাষ্টার

দিলীপ কুমার দে

 Dilip Kumar Dey

আনিসা আর সমর্পিতার মুখে কথাটা শুনে মাথাটা গরম হয়ে গেল। উনার অনেক অত্যাচার সহ্য করেছি, আর নয়। সেই দিনই প্রতিজ্ঞা করলাম পাগলা স্যারের জী-না হারাম করে দেব।

পাগলাস্যার আমাদের স্কুলে অঙ্ক পড়ান। রোজদিনই পড়ানোর আগে পাঁচ মিনিট নীতিশিক্ষা দিয়ে থাকেন । সেই এক বক্তৃতা । “শিক্ষিত হতে হলে আগে বিনয়ী হতে হবে। বিনয় ছাড়া শিক্ষা হয় না। যিনি প্রকৃত শিক্ষিত তার মধ্যে বিনয় থাকবেই,আর বিনয়ী হলে তার মধ্যে প্রকৃত শিক্ষা থাকবে। প্রকৃত শিক্ষিতরা অহঙ্কার শূণ্য হন ,আর যে শিক্ষিতের মধ্যে প্রকৃত শিক্ষা নেই তার দাপটে পৃথিবী কাঁপে ।” এই সব ভাঙ্গা ক্যাসেট রোজ দিন আমাদের হজম করতে হয়।

এই জ্ঞান দেয়ার জন্যই ওনাকে কেউ পছন্দ করে না। পছন্দ না করার আরো হাজারো কারণ আছে।

অতি সাধারণ পোশাক পরিহিত, মুখে কাঁচাপাকা খোঁচা খোঁচা দাড়ি। মাথার চুল এলোমেলো। যখন ক্লাস থেকে বেরোন মাথায়,জামাতে ,প্যান্টে চকের গুঁড়ো লেগে কিম্ভুতকিমাকার আকৃতি ধারণ করেন ‘পাগলা মাষ্টার’ নামকরণ এর কারণ এটিই। তাছাড়াও চার্লি চ্যাপলিন, তৈমুরলঙ আরও অস্রাব্য কি সব নাম প্রচলিত আছে উনার, এই সব নাম উনার ‘প্রাণাধিক প্রিয়’ ছাত্র-ছাত্রীদের দান ।

গতবছর মাধ্যমিক নির্বাচনী পরীক্ষাতে আনিসা-সমর্পিতাদের নাকি খাতা কেড়ে নিয়েছেন উনি । পরীক্ষা শেষ হওয়ার কথা ছিল তিনটা পনেরোতে । উনি তিনটা পঁয়ত্রিশে জোর করে খাতা নিয়ে নিয়েছিলেন। এ কেমন অবিচার! শিক্ষক বলে যা খুশি তাই করবেন! মামা বাড়ি নাকি ? এ তো মেনে নেয়া যায় না । স্কুলটা কি উনার বা…….না থাক । আমরা তক্ষুনি ঠিক করে ফেললাম, ওই স্যারকে যেখানেই পাব সেখানেই অপমান করব। এ ব্যাপারে সর্বদা আমাদের পাশে থাকার ভরসা দিলেন আনিশার মা।

কয়েক দিন পর আমরা তিন বন্ধু রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে গল্প করছিলাম। দূর থেকে স্যারকে আসতে দেখে তিনজন পুরো রাস্তা দখল করে গল্প করতে থাকি । ফলে উনি রাস্তা থেকে নেমে নীচ দিয়ে যেতে বাধ্য হন । আমাদের মুখটা আত্মতৃপ্তিতে ভরে যায়। ছাত্র হয়ে শিক্ষককে নীচে নামানোর তৃপ্তি !

আমাদের সিদ্ধান্ত মতোই বন্ধুরা মাধ্যমিক পরীক্ষার অ্যাডমিট কার্ড নিতে গিয়ে ওনাকে প্রণাম করে নি । শিক্ষক বিরাম কক্ষের সকলকে প্রণাম করে, শুধু উনাকে বাদ দিয়ে। পাগলা মাষ্টার তখন তন্ময় হয়ে পেপার পড়ছিলেন। কোনোদিকে তাঁর ভ্রুক্ষেপ নেই। আমাদের দিকে একবার তাঁকালেন ও না। কোন কিছুতেই যেন ওনার অপমান হয়না।

উনি যেন পার্থিব জগতের বাইরের একজন । পরে অবশ্য জেনেছিলাম, উনি ও অপমান বোধ করেন, ওনার ও কষ্ট হয়—-বরং আবেগ প্রবন মানুষ বলে একটু বেশিই হয় । নইলে, শিক্ষক দিবসে ক্লাস নাইনের মেয়েরা গিফ্ট দিয়ে প্রণাম করতে যেতেই উনি খেই খেই করে ওদের তাড়িয়ে দিয়েছিলেন কেন ? পরে ষ্টাফরুমে গিয়ে কেঁদেছিলেন, বলেছিলেন —-আমি ওদের দেখে চোখের জল ধরে রাখতে পারছিলাম না, তাই, তাড়িয়ে দিলাম।

ক’দিন পরই আমাদের মাধ্যমিক পরীক্ষার ফল প্রকাশ হল । আমি বোর্ডে প্রথম হলাম। চারদিকে সম্বর্ধনার বন্যা বয়ে গেল। অজস্র ক্লাব, পৌরসভা,ব্যাঙ্ক রীতিমতো অনুষ্ঠান করে আমাকে পুরষ্কৃত করলেন। পুরষ্কৃত করলেন ডিএম ও। মুখ্যমন্ত্রীও করবেন। সবার মুখেই এককথা —–বিল্ব আমাদের গর্ব, আমাদের বিদ্যালয়ের গর্ব, বর্ধমান শহরের গর্ব।

নিজেকে অনেক বড়, অনেক মহান বলে মনে হচ্ছিল। স্কুলের সমস্ত মাষ্টার মশাইও খুব খুশি । তাঁরা প্রতিদিন আমাদের বাড়িতে আসতে লাগলেন , এবং আমার সাফল্যের ব্যাপারে কে কতটা নিশ্চিত ছিলেন তা’ ব্যক্ত করলেন।

খুশি হলেন না একমাত্র পাগলা মাষ্টার। তাঁকে কিছুতেই খুশি করা যায় না। কোন কিছুতেই ওনার মনে ভরে না। আমাকে একদিন ডেকে বললেন,” মাধ্যমিকে ভালো করেছ বলেই ভেবো না বিরাট কিছু করে ফেলেছ । এতো গরুর পায়ে সৃষ্ট একটা গর্ত পার হয়েছ মাত্র। সামনে কিন্তু মহাসমুদ্র। এটাকে ভালোভাবে পার হতে পারলেই তুমি সেরা। তোমাকে এখন অনেক কঠিন পরিশ্রম করতে হবে। অনেক বেশি বেশি খাটতে হবে এখন। “

মনে হচ্ছিল, একটা ঘুষি মেরে ওনার মুখটা বাঁকিয়ে দি। কোথায় সবার মতো প্রশংসা করবেন, তা না আরও ভয় পাইয়ে দিচ্ছেন । আসলে নিজে কোনদিন এত বড় সাফল্য পাননি তো, তাই অন্যের সাফল্যে খুশি হতে পারছেন না । গোমড়ামুখো বুড়ো কোথাকার !

এরপর, পুরোনো স্কুলেই নুতন ক্লাসে ভর্তি হলাম । এবং অবশ্যই বিজ্ঞান বিভাগে । নিজেকে এতটাই উপরে তুলে ফেলেছি যে, জ্ঞানের দিক থেকে কাউকেই আর আমার সমকক্ষও ভাবতে পারছি না। এমনকি স্যার-ম্যামদের ও আমার লেবেলের নীচে মনে হতে লাগলো। মনে হতে লাগলো এঁরা আমাকে পড়াতে পারবেন তো ? কলকাতায় কোন ভালো স্কুলে ভর্তি হলেই বোধহয় ভালো হতো। সাউথ পয়েন্ট কিম্বা হেয়ার স্কুল।

নুতন ক্লাসের প্রথমদিন প্রথম ঘণ্টায় ছিল বাংলা, দ্বিতীয় ঘন্টায় কেমিস্ট্রি । ব্যাগ কাঁধে নিয়ে প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসে যাওয়ার সময় নিজেকে অ্যাভোগাড্রো , নিউটন ,আইনষ্টাইনদের সমকক্ষ মনে হচ্ছিল। তখন পিপেট-ব্যুরেট ধুচ্ছিলাম তখন মনে হচ্ছিল, আমার বন্ধুরা জানেও না তাদের এই বন্ধুকেই একদিন বিশ্ব জানবে ।

তৃতীয় ঘন্টায় ক্লাস নিতে এলেন পাগলা মাষ্টার । স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে পাঁচ মিনিট জ্ঞান দিয়ে পড়ানো শুরু করলেন । উনার সরল ভাষায় পড়ানো শোনার মত ধৈর্য্য বা ইচ্ছা কোনটাই আমার ছিল না । আমি -আনিশা-দিশা-সমর্পিতার শেখানো মত কেউ উনার কোনো কথাই শুনলাম না। ক্লাস শেষ হতেই বিদ্রূপ করে একসাথে সবাই হাততালি দিয়ে উঠলাম ।

ভাবলাম, প্রথম দিনেই যে অপমান করলাম, উনি আর আমাদের ক্লাসে আসবেন না। ওমা! পরদিন যথাসময়ে ক্লাসে এসে হাজির। এদিন ও উনি পড়াতে থাকলেন, আমরা ঝালমুড়ি আনিয়ে সারাটা ক্লাস গল্প করে ঝালমুড়ি খেয়ে কাটালাম। মাঝে বিরক্ত হয়ে আমাকে বকতে কাছে এসেছিলেন, আমিও বলে দিয়েছি —-আপনি জানেন ? আপনি কার সাথে কথা বলছেন! ডিএম ডিএসপি আমাকে সমীহ করে চলে।

এতকিছু করার পরেও যখন দেখলাম স্যার দমছেন না, এর পর থেকে স্যার ক্লাসে ঢুকতেই আমরা পনেরো -বিশজন উনার অনুমতি না নিয়েই ওঁর সামনে দিয়ে ক্লাস থেকে বের হয়ে যেতাম।

এই ভাবেই চলছিলো আমাদের পড়াশোনা। সাথে সাথে স্যারকে অপমান। এ ব্যাপারে আনিশার মা-বাবা-জ্যেঠু ও সমর্পিতার মা আমাদের খুব উৎসাহ দিতেন। উৎসাহ দিতেন শুভঙ্কর বল স্যার ও নয়নস্যার । শুভঙ্কর স্যার আমাদের গণিত প্রাইভেট পড়াতেন। উনি ও পাগলা মাষ্টারের ছাত্র। ছাত্র জীবনে উনিও পাগলামাষ্টার দ্বারা অত্যাচারিত হয়েছিলেন। তাই তো এতো রাগ ওনার।

মাস দুয়েক পরের কথা। সেদিন স্কুলে যেতে একটু দেরি হয়ে গিয়েছিল। দৌড়ে এসে কোনমতে প্রেয়ার লাইনে দাঁড়িয়েছি। এমন সময় ত্বরণ সুখবরটা দিল । বলল, আজ তো ছুটি হয়ে যাবে, ক্লাস হবে না। কাল নাকি পাগলামাষ্টার মারা গেছেন। অ্যাকসিডেন্টে স্পটডেথ্ ।

কনডোলেন্স হয়েই ছুটি। মনটা আনন্দে ভরে উঠলো।এক আজ ক্লাস করতে হবে না ভেবে আর পাগলামাষ্টারের পাগলামি আর কখনো সহ্য করতে হবে না। আর কেউ কোন দিন নীতি জ্ঞান দিতে আসবেন না।

সত্যি বলতে কি কঠিন কঠিন অঙ্ক গুলো কঠিন করে বুঝতে বেশ মজা লাগে।কেমন যেন উঁচু ক্লাস উঁচু ক্লাস মনে হয়। বেশকিছু ইংরাজি শব্দ থাকবে । পাগলা মাষ্টার একেবারে ঘরোয়া ভাষায় সহজ করে বলেন। মনে হয় ক্লাস ফাইভে পড়ি। যত্তোসব ! এক্কেবারে বোরিং ।

কন্ডোলেন্সের পর বন্ধুদের সাথে কিছুক্ষণ খুনসুটি করে বাড়ি ফিরলাম।

পরদিন স্কুলে যেতেই বুকটায় মোচড় দিয়ে উঠলো। পাগলা মাষ্টার নেই —ভাবতেই মনটা ভারী হয়ে উঠছে কেন ? কেন মনে হচ্ছে অনেক কিছুই নেই? লোকটাকে কোন দিনও ভালোবাসা তো দূরের কথা শিক্ষক বলে ও মানিনি! তবে আজ কেন এতো কষ্ট হচ্ছে ওঁর জন্য ?

কেন মনে হচ্ছে আমি আজ অভিভাবক হীন । কেন বাকি শিক্ষকদের ততটা হিতাকাঙ্খী মনে করতে পারছি না ? স্কুলে তো কত প্রিয় স্যার -ম্যাডাম আছেন! তবুও কেন মনে হচ্ছে আমি একা ? আমার ভুল চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়ার আর কেউ রইল না ! তবে কি আমার মনেও বিবেক জাগছে ?

তবে কি আমার মধ্যেও বিনয় আসছে ? উনি সবসময়ই বলতেন বিদ্যা আর বিনয় সমার্থক। বলতেন বিদ্যা হলে বিনয় অবসম্ভাবী। আর বিনয়ী হলে প্রকৃত শিক্ষা হবেই । যাকে কোন দিন সহ্য করতে পারতাম না কেন আজ তার অনুপস্থিতি এত কষ্ট দিচ্ছে ? তবে কি তিনি আমাদের খুব কাছের মানুষ ছিলেন ? আমরাই পর্দা দিয়ে তাকে আঁড়াল করে রেখেছিলাম ?শত্রু ভেবে দূরে সরিয়ে রেখেছিলাম ? এটাই কি তবে অন্তরের টান ? কে জানে !

ধূপগুড়ি, জলপাইগুড়ি

https://bangla-sahitya.com/post/

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *