
“মড়া”
ভাবানুবাদ:
ধ্রুবজ্যোতি ঘোষ
ফরাসী ভাষায় মূল
কবিতা
,”Une Charogne”
কবি
শার্ল ব্যোদলেয়ার
ইংরেজি ভাবানুবাদ:
“A Carcass”
(The Flower of Evil)
অনুবাদক:
উইলিয়াম অ্যাগেলার
প্রিয়ে, তোমার মনে কি পড়ে
গরমের সেই মনকাড়া সকালে
দেখেছিলাম সেই জিনিষটাকে পথের প্রথম বাঁকে:
নুড়িবেছান বিছানায় ছড়িয়ে বোঁটকা গন্ধ
একটা মড়া আছে শুয়ে বুক চিতিয়ে।
পা দুটো বেশ্যাদের মত নিলাজ ফাঁক করা ওপরে
বাতাসে তার ঘামের বিষগন্ধ ওড়ে
আদেখলার মত বেরিয়ে আছে তার নগ্ন উদর
বিষাক্ত গ্যাসে ভরা, ফুলে ফেঁপে ঢোল।
রোদ ঝলসে দেয় সেই পচা দুর্গন্ধময়,
যেন রোস্ট হয়ে যায় তপ্ত কড়ায়,
এবার ওলটাবার হয়েছে সময়।
আর ফিরিয়ে দেবে প্রকৃতির কাছে শতগুণ,
জীবনভর যা তার দেহে করেছিল সঞ্চয়।
নীল মাছিরা অনুক্ষণ করে ভনভন,
তার পচাগলা উদোম পেটের কাছাকাছি।
সেখানে কৃমিকীট বেরিয়ে আসে পিলপিল,
নিয়ে তার বিশাল সৈন্যবাহিনী।
থকথকে জেলির মত বয়ে যায়
ছেঁড়া, নোংরা আর জ্যান্ত কাপড়জামায়।
এ সবই ঢেউয়ের মত ওঠে আর পড়ে ক্রমান্বয়ে;
দমকে দমকে ওঠে চড়বড়ে আওয়াজ;
দেখলে হয়তো কেউ উঠতো বলে:
মড়াটা অদ্ভুত এক নিঃশ্বাস নিয়ে বেঢপ ফোলা অবয়বে
নিজেকেই জন্ম দেয় বারবার।
আর এই বিপুল চরাচর
ভাসিয়ে দিয়েছে এক অনন্য সুর,
যেন ঝর্ণা আর বাতাসের কলস্বন
কিংবা কুলোয় শষ্য ঝাড়ার ছন্দময় অনুরণন।
তার অবয়ব মিলিয়ে যায় যেন কুয়াশায়
মনে হয় স্বপ্নের চেয়ে বেশি কিছু নয়।
মনের বিস্মৃত ক্যানভাসে
ভাসা ভাসা স্কেচ মন্থর পায়ে আসে,
শিল্পী বুলিয়ে তার স্মৃতির তুলি
নিটোল রূপ দেয়।
প্রকাণ্ড পাথরের আড়ালে
কুত্তাটা দেখছিল রাগী চোখে,
নিয়ে প্রবল অবিশ্বাস;
আবার যাবে কঙ্কালের অকুস্থলে,
দখল নেবে তার আধখাওয়া হাড়মাস।
—– অথচ তুমিও হবে একদিন এইরকম দুর্গন্ধময়!
প্রিয়ে, আমার চোখের মণি!
আমার জীবনের টাটকা রোদ্দুর!
তুমি, আমার নীলপরী, আমার আবেগের সমুদ্দুর!
হ্যাঁ, এই তোমার আগামী, রূপসী ঊর্বশী!
যখন থেমে যাবে সব মন্ত্রোচ্চারণ
তুমি থাকবে শুয়ে ঘাস আর ঝাড়ালো ফুলগাছের নীচে,
মিশে যাবে অনায়াসে
মাটি হয়ে যাওয়া শবদেহের আশেপাশে।
তখন, ওগো সুন্দরী! চুমু আর চুমুতে ভরিয়ে
তোমাকে খেয়ে নেবে যে সব ঘিনঘিনে কীট,
তুমি বলে দিয়ো তাদের:
আমার পচে যাওয়া সুতনুকা প্রেমিকার দেহসৌষ্ঠব রেখেছি অবিকৃত,অনুপমা;
ঘিরে আছে তাকে অতুলনীয় স্বর্গীয় সুষমা।
A Carcass
A poem by Charles Baudelair in French
Translated into English by William Aggeler, (“The Flowers of Evil”)1954
My love, do you recall the
Object which we saw,
that fair, sweet, summer morn!
At a turn in the path a foul carcass
On a gravel strewn bed
Its legs raised in the air, like a lustful woman,
Burning and dripping with poisons
Displayed in a shameless nonchalant way
Its belly, swollen with gases
The sun shone down upon that putrescence
As if to roast to a turn,
And to give back a hundredfold to great nature
The elements she had combined;
And the sky was watching that superb cadaver
Blossom like a flower.
So frightful was the stench that you believed
You’d faint away upon the grass.
The blow-flies were buzzing round that putrid
From which came forth black battalions
Of maggots, which oozed like a heavy liquid
All along these living tatters.
All this was descending and rising like a wave
Or poured out with a crackling sound;
One would have said the body,
Swollen with a vague breath,
Lived by multiplication
And this world gave forth singular music,
Like running water or the wind,
Or the grain that winnowers with a rhythmic motion
Shake in their winnowing baskets
The forms disappeared and were no more than a dream,
A sketch that slowly falls
Upon the forgotten canvas, that the artist
Completes from memory alone
Crouched behind the boulders an anxious dog
Watched us with angry eye,
Waiting for the moment to take back from the carcass
The morsel he had left.
——And you will be,
Iike this corruption,
Like this horrible infection,
Star of my eyes
Sunlight of my being
You, my angel and my passion!
Yes! Thus will you be, queen of the graces
After the last sacraments,
When you go beneath the grass and luxuriant flowers
To molder among the bones of the dead.
Then, O my beauty! say to the worms who will
Devour you with kisses
That I have kept the form and the divine essence of my decomposed love!
জঞ্জালের মৃত্যু বিষয়ক
ধ্রুবজ্যোতি ঘোষ
অনামিকা, তোমার রাগী কবিতার জঞ্জাল
এই মাত্র কিলো দরে বেচে দিলাম।
জানি নেই তবু তুমি বাঁচবে আছে যতদিন
টিনের শূন্য থালা হাতে লাইনে দাঁড়ান দিন,
অথবা কোন ভুখা মায়ের তৈরী ঠোঙায়,
বা সমাজের নোংরাকুড়ুনির কালিপড়া চোখের পাতায়…
স্বাধীন পাখিরা পৌঁছে দেবে পরম মমতায়
তোমার ফিনিক্স প্রতিবাদ
যেখানে মানুষ আজও পিঁপড়ের থেকেও অসহায়।
শেষবারের মত দিলাম খুলে
অদৃশ্য শেকলের দায়।
অনামিকা, তুমি খুঁজো না আমাকে
কলেজ স্ট্রিটের সেই
কানাগলিতে
ডাঁই করা চায়ের ভাঁড়ের ভীড়ের পাশে
জোলো চায়ের দোকানে,
বইমেলার নিভন্ত আগুনে সেঁকা
লিটল ম্যাগাজিনের ভীতু স্টলে
কিংবা ক্ষয়রোগে শুকিয়ে যাওয়া
আকাদেমীর স্মৃতিটুকু থাক উঠোনে…
আমাদের অনেক জায়গায় যাওয়ার ছিল
যেতে পারিনি
আমরা অনেক জায়গায় গিয়েছি
কোনদিন যাব ভাবিইনি:
তর্কে বিতর্কে গানে গল্পে ধোঁয়ার জটিলতায়
কত যে রাত হয়েছে ভোর।
ঘুমচোখে কলকাতা নিয়ে গেছে আমাদের
দক্ষিণ থেকে উত্তর;
তবুও ভাঙেনি নতুন সূর্যের ঘোর।
আজ আমি নিজের হাতে
ছিঁড়ে ফেলি এই বাঁধন বিনিসুতোর।
তুমি চিনতে যে কবিতা আমার
সে ছিল পূর্বজন্মের…
আজ সে গ্র্যান্ডে লাঞ্চ সেরে
ডেকে নেয় মুদ্রারাক্ষস উবের
ভীড় থেকে আলাদা হবে বলে;
আরো অনেক গদ্য পদ্য প্রবন্ধের সাথে
খাকি অস্ত্রের বলয়ের মাঝে
বাধ্য পা মেলায় ক্রীতদাস ভীড়ের।
বিষের মত নীল হার দোলে অবলীলায়
তার নিলাজ গলায়;
জেনো নাজিম হিকমত আজও বন্দী,
লুকিয়ে কবিতা লেখে জেলখানায়।
তুমি যে শিশুকে শিখিয়েছিলে হাঁটতে
সেও আজ তোমায় পারে না চিনতে,
আমাদের সেই কল্পনার চওড়া পৃথিবী
ছোট হতে হতে আজ বন্দী তার মুঠোয় ।
সেখানে গায় না গান পিট সিগার
কিংবা জোন বায়েজ, পল রোবসন
সেখানে ওড়ে না ঝড়ের পাখি পেট্রেল বা শঙ্খচিল অনুক্ষণ!
অপু দুর্গাদের ডেকে নিয়ে যায়
অতল খাদের কিনারায়
হ্যামেলিনের বাঁশিওয়ালা সেজে মোমো ডোরেমন।
আজ আর নেই সেই দীর্ঘ মিছিল
আকাশ জুড়ে ওড়ে হায় চিল,
কালো ডানার চিল।
অনামিকা, পুজোর ফুলে কীটের উৎসব
ইবাদতখানায় কে লাগায় মারকুটে রঙ!
আলোর তরীতে সওয়ার অন্ধকার—
এখানে বৃষ্টির রঙ লাল।
অনামিকা তোমার প্রতিবাদের জঞ্জাল
এইমাত্র কিলো দরে বেচে দিলাম।
অভ্যেসের মত তুমি যে পেয়ে বসেছিলে
নিয়েছিলে মুঠোয় আমার ইহকাল পরকাল;
আজ আমার পিঠ তেলচিটে দেওয়ালে…
আমার ওপর ছিল শতাব্দীর পাষাণভার:
তাই তোমার জন্যে
শুধু তোমারই জন্যে
আরো একবার
আগুন বিনাই চিতা সাজালাম।
২৯.৯.২০২২