Debasish Datta

মুক্তি স্নান


দেবাশীষ দত্ত

বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যার নীলচে মায়াবি আলোর ছোয়ায় চারদিকটায় কেমন স্বপ্নীল ঘোরের আবেশ, নদীর বুক থেকে ভেসে আসা হু হু বাতাসে মাদকতার ছোয়া, ঝিঝি পোকাদের গুন্জন একটু একটু করে চারদিক এর নিস্তদ্বতায় নাড়া দিয়ে যাচ্ছে,
ঘর থেকে বেরিয়ে উঠোনে পা দিতেই গ্রামের সরু পায়ে চলা রাস্তায় দাড়ানো মানুষটার দিকে চোখ পড়ে, কে ও, তেমন চেনা লাগছেনা তো, কাছে এগিয়ে নজর করতেই একটা মেয়ে —-কে ও?

ওদের বাড়িটা এক অদ্ভুত জায়গায়, ওপারে আলো ঝলমল শহর এপারে ওদের নিস্তরংগ শান্ত জীবন , মাঝখানে চুপচাপ বয়ে চলা নদী, পাড় ঘেষে সবুজ গাছের সারি, আর একটু উপরে সরু পায়ে চলা পথ, পথের দুপাশে ছড়ানো ছিটানো টিনের দোচালা ঘরের মেলা, আশেপাশের সবাইতো মুখ চেনা, ওপারের থেকে বেড়াতে আসা হবে হয়তো , হাতের কাজ সেরে ঘরের দিকে পা বাড়াতে পিছন থেকে ডাক ভেসে এলো,

–শোনেন—চমকে উঠে পিছন ফিরে তাকাতে উন্মুখ নয়নে তাকিয়ে থাকা মেয়েটার দিকে চোখ পড়ে,
–কিছু বলবেন—
–না তেমন কিছু নয়, আজ বোনটা চলে গেল—ওর দৃষ্টি অনুসরন করতেই ওপারে বাড়ির সামনে বরাবর শ্মশানের দিকে চোখ পড়লো,দাউ দাউ করে একটা চিতা জ্বলছে, এবার মেয়েটার দিকে ভাল করে তাকালো, রোগাটে অল্প বয়সী মেয়ে, মায়াকাড়া মুখটায় পৃথিবীর অসীম বিষন্নতা,চোখ দুটোয় দুঃখ ঝরে পড়ছে,
–আপনার বোনের কি হয়েছিল—মেয়েটা মনে হয় অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল,কথাটা শুনতেই ভীষন ভাবে চমকে উঠলো

–কি যে হয়েছিল,অনেক কথা, কিন্তু ওকে জোর করে নিয়ে গেল—
মেয়েটার মৃত্যু হয়েছে এটা ঠিক,জোর করে নিয়েছে এটা আবার কি? তাছাড়া অচেনা ঐ মেয়েটা ওকেই বা কেন বাড়ি বয়ে এসে শোনাচ্ছে ,মাথামুন্ড কিছুই মাথায় ঢুকছে না,
–একটু বুঝিয়ে বলেন—সামনের দিকে তাকাতে—কোথায় মেয়েটা, হাওয়ায় উবে গেল নাকি?সন্ধ্যার নিস্তদ্ব অন্ধকারে এক বরফ শীতল হাওয়া সমস্ত শরীরে শিরশিরানি ছড়িয়ে দিতে বুকের মাঝে ভয়ের দামামা শুরু হোলো,
প্রায় ১১টার কাটা ছুই ছুই, বাস রাস্তার দু পাশে সবুজ ক্ষেতের উপর হলুদের ঝলকানি, রিকসা থেকে নেমে শ্যামল বাস ষ্টান্ড এর যাত্রি ছাউনির ভিতর এসে দাড়ালো, রিকসা থেকে নেমে সরাসরি ভারিক্কি চেহারা এক ভদ্রলোক ওর সামনে এসে দাড়ালেন, -ভাল আছেন—
অপরিচিত একটা মানুষের দিকে একটু তাকিয়ে অস্বস্তিতে পড়লো,তবু ভদ্রতার খাতিরে একটু সায়,
–ও বুঝতে পেরেছি , চিনতে পারছেন না, চিনবেন কেমন করে, আলাপ পরিচয় না থাকলে পরিচয় হবে কেমন করে, আমার নাম এ্যডভোকেট অমৃত বসু, আপনি আমাকে না চিনলেও আমি আপনাকে চিনি,
এবার সত্যিই চমকানোর পালা, সে একেবারে নিরীহ গরিব টিউশন মাষ্টার,উকিল আদালত ওর কাছে অচেনা জগৎ,
–ও বুঝতে পেরেছি, আপনি অস্বস্তিতে পড়েছেন, নানা আপনার কোন ব্যাপার নয়, একটু ব্যাখা করলে বুঝতে পারবেন, —অস্বস্তি ভরা মুখের দিকে তাকিয়ে উকিল বাবু একটু হাসলেন,
–ওকালতি পেশার বাইরে আমার একটা নেশা আছে, প্রেত চর্চা—একি লোকটা ওঝা নাকি, ব্যাপারটা মাথায় ঢুকছে না, যাক কথাটা শোনাযাক,
–এ কাজের জন্য একটু এদিক ওদিক ঘুরতে হয়,ঘুরতে ঘুরতে আপনাদের এলাকায় হাজির, যেয়েই শরীর ভার, আনুসাংগিক ক্রিয়াকর্মাদি করতেই সব কিছু পরিস্কার, বিশা্ল প্রেত যোনির আখড়া, সামনে আপনাদের কঠিন বিপদ,–হঠাৎ থেমে অপলক দৃষ্টিতে ওর মুখের দিকে তাকালেন,
এ কি বিপদ ,চিরকাল ও ঝুট ঝামেলা এড়িয়ে চলে , তাতে আবার উটকো ঝামেলা,
–শুনুন চিন্তা করার দরকার নেই আমিদেখবো—একটা চলন্ত রিকসা ডেকে চড়ে বসলেন
হঠাৎ মাথার মাঝে বিদুৎ চমক খেলে গেল, দিন দুপুরে উকিল সেজে ভুতের গল্প ফাদা, লোকটা সত্যিই উকিলতো ,নাকি অন্য মতলবে ঘোরা কোন বিপদ জনক লোক, মনের খুতখুতানি নিয়ে বাইরের কাজটা সেরে বাড়ির কাছে আসতেই একটা মেয়েকে দ্রুত পায়ে এগিয়ে আসতে দেখলো,ভাল করে দেখার আগে কোথায় যে মিলিয়ে গেল, উঠানে পাড়া দিতেই চমকানির স্রোত, নিস্পলক দৃষ্টিতে সন্ধ্যার অন্ধকার গায়ে মেখে বুলু শূন্য দৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকিয়ে,মুখে ভয়ের মেঘ,
উত্তপ্ত দুপুরটা বিদায় নিয়ে বিকেলের কমলা আভাটা চারদিক ছড়িয়ে পড়ছে, মিষ্টি হাওয়া গাছের গায়ে দোলা খেয়ে ঝিরঝির শব্দ তুলছে, বাইরে বেরোনোর প্রস্তুতি শেষ করতেই ঘরের বাইরে কার যেন গলা ভেসে এলো,
–শ্যামল বাবু ঘরে আছেন নাকি—এবার সত্যিই চমকানোর পালা, লোকটা একেবারে বাড়িতে হাজির, একেবারে অন্য লেবাসে,প্রস্তুতি নিয়ে, পরনে সাদাধুতি পান্জাবি,কাধে বিশাল বোঝা,
–কোন ভূমিকা না করে বলছি, আমকে প্রতারক ভাববেন না, আপনাদের উপকারের জন্য আমি এসেছি, টাকার জন্য আসিনি, দয়া করে আমি যা বলবো একটু শোনেন, , প্রথমে আপনার প্রতিবেশি দের কে আপনাদের বাড়িতে আসতে বলবেন,—লোকটার কথায় বেশ ব্যাক্তিত্ব আছে, সংগে বেশ কৌতুহল হচ্ছে,
গ্রামের মানুষ এমনিতে ভুতপ্রেতে প্রচন্ড উৎসাহি ,তারপর ওঝা যখন ডাক পেড়েছে তখন আর কি ঘরে থাকে, শ্যামলদের বারান্দা ইতিমধ্যে কানায় কানায় পূর্ন হয়ে গেছে;
–শ্যামল বাবু কিছুক্ষন থাকেন—কম্পাসটা হাতে নিয়ে একটু বিড় বিড় করে বলে উঠলেন —এই তো বায়ুকোন—
–শ্যামল বাবু এটা দিয়ে চারটি বৃত্ত আকুন—আকা সম্পন্ন হয়ে গেলে মাঝখানে আর একটা বৃত্ত একে তারমধ্যে সুন্দর করে একটি যোনি চিহ্ন আকলেন, উকিল বাবু,এবার তার সামনে বেশ খানিকটা গর্ত করে তার মধ্যে মধু আর ঘি মাখা চন্দন কাঠ রাখলেন
–আপনারা এর বাইরে কেউ আসবেন না, ভয় পেলে ও না—একট গন্ডি আকতে আকতে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
দাউ দাউ করে আগুনের লক লক শিখা জ্বলতেই দৃশ্যপট পাল্টে গেল, নিঃছিদ্র ঘেরাটোপের মধ্যে পড়ে গেছে, সব নিস্তদ্ব, বাতাসও বুঝি থেমে গেছে,
–ওঁ স্বাহা—দূর্বোধ্য উচ্চারনে মন্ত্র পাঠ করে চলেছেন উকিল বাবু
—এই থাম বলছি—অদৃশ্য কোন থেকে তীব্র চিৎকার ভেসে এলো,এ কন্ঠস্বর মানব কন্ঠ নিঃসৃত স্বর নয়, কোন অনেসর্গিক শব্দ, বাতাসে রিন রিন করে ভেসে আসে,মর্মে এর স্পর্শ কাপুনি তোলে,
—তুমি কি চাও—গমগমে গলায় প্রশ্ন করেন উকিল বাবু,
—আমি মুক্তি চাই—
—কোথায় তোমার মুক্তি,তুমি কেন এসেছ—
–মুক্তি তোমার হাতে, তোমার জন্য এসেছি—
এবার সত্যি অবাক হবার পালা উকিলবাবুর,এতদিনের অভিজ্বতায় ৗঝাকে দেখলে প্রেত রা পালিয়ে যায়, এ যে দেখছি উল্টো,
–ভাংগিয়ে বল—
–তুমি আমাকে চেন, আমার নাম মীনা,আমার কেছটা নিয়ে তুমি আদালতে থদ্বির কোরছো,–
মস্তিস্কে সহস্র বিদুৎ খেলে যায়,—তোমার তো অপঘাতে মৃত্যু হয়েছে, এতে আমার দোষ কোথায়—
–নাঃ আমার অপঘাতে মৃত্যু হয়নি, আমাকে খুন করা হয়েছে, আর্থিং এর তার কেটে ফ্রিজ বিদ্যুতায়িত করে রাখে, স্পর্শ এর সংগে মৃত্যু হয় আমার,অপঘাত সাজিয়ে সাজানো খুন করে আমার জীবন বীমার টাকা আদায় করার জন্য এই নাটক করেছে, এর বিচার না হলে আমার মুক্তি হবেনা,—-ক্রদ্ব চিৎকারে সমস্ত আকাশ বাতাস কম্পিত হয়ে ওঠে,
উপস্তিত জনতা নির্বাক হয়ে বিমূড় বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে, উকিল বাবু মন্ত্র উচ্চারন তামিয়ে ভাবনার অকূল সমূদ্রে তলিয়ে যান, প্রত্যেকের মনে একটা প্রশ্ন জেগে ওঠে ওর কি মুক্তি হবে?

[jetpack_subscription_form show_subscribers_total=”false” button_on_newline=”false” custom_background_button_color=”#b312f7″ custom_font_size=”16px” custom_border_radius=”0″ custom_border_weight=”1″ custom_border_color=”#b312f7″ custom_padding=”15″ custom_spacing=”10″ submit_button_classes=”” email_field_classes=”” show_only_email_and_button=”true” success_message=”Success! An email was just sent to confirm your subscription. Please find the email now and click 'Confirm Follow' to start subscribing.”]

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *