Debasish Datta

Debasish Datta

অন্ত বিহীন

দেবাশীষ দত্ত

মা

    তোমাকে  লিখতে বসে আমার চোখের কোনটা  ভিজে উঠছে, তবু তোমাকে আমার লিখতে ই হবে, তোমাকে কিছু না বলে আমি থাকতে পারিনা, 

    ঘন অন্ধকারের চাদর পরা বাইরে টা ঝিরঝিরে  বৃষ্টি মাথায নিয়ে চুপচাপ, মাঝে মাঝে ঝি ঝি পোকার ডাক ভেসে আসছে,বর্ষা ভেজা তাবুর  গা বেয়ে  দু এক ফোটা জল গড়িয়ে পড়ছে, গভীর ঘুমে আছন্ন  মাটিতে এলিয়ে পড়া মানুষগুলোর নিশ্বাষ এর শদ্ব ভেসে আসছে, প্রায় নিবু  নিবু হেরিকেনের আবছা আলোয় চারদিক আলোআধারির ছোয়া, ঝাপসা দৃষ্টিতে উপুড় হয়ে সাদা কাগজটার দিকে তাকিয়ে আছি,  

      তুমি কেমন আছো বলে তোমাকে কষ্ট দেবনা, যেদিন রনজিৎপুর থেকে তোমাকে না বলে চলে এসেছি সেদিন থেকে নিরব অভিমান বুকে চেপে  চুপ হয়ে গেছো, প্রথমে পা ছড়িয়ে  বুক ভাসিয়েছে,তারপর  প্রত্যেকে আমার হারিয়ে যাওয়ার ব্যপারটা মাথা   থেকে  সরিয়ে দিয়েছে,তুমি তখন সবার উপেক্ষা সহ্য করে মনের যন্ত্রনা চেপে আমার কথা ভেবেই চলেছো,

     আজকের কথা বলি,বাইরে বৃষ্টির  শব্দ বেজে ই চলেচে,তারি মাঝে পিছল  মাটি, ফোটা ফোটা বৃষ্টি,অন্ধকার সবকিছু উপেক্ষা করে রান্নাঘর থেকে খাবার এনে সবাইকে খাইয়ে  ,ঘুম পাড়িয়ে  নিরবে তোমার বিছানায় বসে বালিশের তলা থেকে গ্রুপ ফটোটা বের করে নির্নিমেশ নয়নে  তাকিয়ে আছো, তোমার দুচোখ বেয়ে  জল গড়িয়ে পড়ছে, 

এখানে আসার গল্পটা একটু বলি, রাজাকারদের হুজ্জোত মিটলে সুনিলদা হাত ধরে হ্যাচকা টান , তারপর বৃষ্টি মাথায়, পিছল মাটি ,অন্ধকার সব কিছু উপেক্ষা করে ছুটে চলা, ভোর হতেই খুলনা লন্চ ঘাট, পল্টুনের গায়ে বাধা সার সার লনচ, তারই একটাতে আমরা দুজনে উঠে পড়লাম , তুমি কষ্ট পাবে বলে কিছু বলিনি, ক্ষিদেয় পেট চোচো করছে,সুনিলদা কোথা থেকে পাউরুটি ম্যানেজ করতেই বাচোয়া,

      সমস্ত আকাশটা র গায়ে  কে যেন একরাশ কালি লেপে দিয়েছে,সেই থেকে মুখ ভার করা অভিমানি মেয়ের চোখ থেকে  ফোট ফোটা জল গড়িয়ে পড়ছে, নদীর বুক থেকে হু হু করে ভেসে আসা হাওযা শরীরে মিহি শীতের কাপন তুলছে, উদ্দাম বাতাসের তোড়ে নদীর ঢেউ ফুসে উঠছে,

    কোথায় যে বসবো, বর্ষার জলে  স্যাৎ স্যাত করছে, এর মধ্যে গিজ গিজ করা এক দংগল মানুষ,মানুষগুলোর দিকে তাকালে মায়া হয়, পরনে বিবর্ন ময়লা পোষাক খোচা খোচা  দাড়ি, চোখের কোনে কালি, মনে দুঃচিন্তার পাহাড় নিয়ে গাটরি বোচকা আগলে বসে আছে, মহিলাদের অবস্তা আরও করুন,বাচ্চাগুলোখাবার এর জণ্য কান্নাকাটি করছে,নিরূত্তাপ ভংগীতে ,শূন্য দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছে,

       মাথায় টুপি মুখে দাড়ি  হেটেযাওয়া মানুষকে একজন ডেকে বললো,---সারেং সাহেব ছাড়বেন না?----

–ছাড়বো—অর্ধেক কথা শেষ হতেসামনের দিকে তাকিয়ে সারেং সাহেব জমে পাথর,

       সিড়ি বেয়ে মুর্তিমান বিভীষিকার দল  উঠে আসছে, রোগা পটকা চেহারার ওপর খাকি  পোষাক পরা রাজাকারগুলোর  হাতে ইয়া বড় বড় লাঠি, ওদের পিছনে  তাকাতে অন্তরাত্না কেপে উঠলো, এতদিন মিলিটারিদের কথা শুনেছি  আজ দেখলাম,বিশাল দেহ , মাথায় হেলমেট  ভয়ংকর দৃষ্টিতে সব কিছু গিলে খাচ্ছে,

  লন্চে পাড়া দিতে লাঠিগুলো  বিদুৎ বেগে চলা শুরু হোলো,যাকে সামনে পাচ্ছে তাকেই পেটাচ্ছে,মিুখে অশ্রাব্য গালি,চোখ থেকে ঝরে পড়ছেলোভ আর হিংসা, সংগে মিলিটারি গুলোর  বেদম লাথি, চারদিক  শুধু  কান্নার  রোল,এর পর শুরু হোলো চেক, চেক না ছাই,যার কাছ থেকে যা পাচ্ছে লুঠ করছে,

  বেশ কিছু লোককে বাছাই করে পিছমোড়া করে বেধে একজায়গায় বসিয়ে রেখে মেয়েদের দিক নজর দিল,অল্প বয়সী মেয়েদের বাছাই করে আর এক জায়গায় রেখে দিল,

হঠাৎ করে এক রাজাকার  আমাদের দিক তাকাতে---এত ক্ষন আমরা গুটি শুটি মেরে চোঙের কাছে বসেছিলাম ,

–এই শালা এ দিক আয়—

রোগাটে ক্ষয়াটে চেহারার সুনিলদা কাপতে কাপতে রাজাকারটার সামনে হাতজোড় করে দাড়ালো,

—স্যার আমার আব্বু বিহারি বাড়ি কাজ করে, খালিশপুর ওখানে গিছিলাম— ওরা কিছু বলার আগেই সুনিলদা গড় গড় করে বলাশুরু করে,

পাশের মিলিটারি টা কি বুঝলো কে জানে,

—বিহারির বাচ্চা,ডরপুক কিউ,ছোড় দিজিয়ে—

লন্চ ছাড়তেই জীবন ফিরে পেলাম কিন্তু ঘাটে রেখে এলাম পিছমোড়া করে বাধা একদল অসহায় মানুষ আর বলতে কষ্ট হচ্ছেেঐ নিরীহ অল্প বয়সী মেয়েগুলোকে

          ভেংগে পড়া  আকাশ থেকে ঝরে পড়ছে অবিরাম বৃষ্টি, নীল আকাশের গায়ে ধূসর মেঘের প্রলেপ, সাদা বৃষ্টির চাদর এর ছোয়ায় সামনেটা অস্পষ্ট, দমকা বাতাসের  তোড়ে ফুসে ওঠা ঢেউ মাথায়  ওপর ভেংগে পড়ছে,কখনো তলিয়ে যাচ্ছি, আবার ভেসে উঠছি, এক হাতে নৌকার দড়ি,অন্য হাত জল কাটছি,

   শরীরে একফোটা  বল নেই, কোন রকমে ঘাটে উঠে এলিয়ে পড়লাম, এ কি মাটি কেপে উঠছে কেন, কান চাপ দিতে গুম গুম  শব্দ, মাথার ভিতর সহস্র বিদুৎ এর শিখা, পিছনে সুনিলদার দিকে তাকাতে  চোখের ভাষায়  সব কিছু পরিস্কার, পাকা রাস্তার ওপর  পাক আর্মির পাহারার  গাড়ি এগিয়ে আসছে, দ্রুত হাতে  নৌকা থেকে অস্ত্র গুলোনিয়ে ঝোপের আড়ালে পজিশন রেডি,

   হেড লাইট গুলো বাঘের চোখ হয়ে জ্বল জ্বল  করছে,গাড়িটা এগোচ্ছে, বুকের মধ্যে লক্ষ বাজনার দামামা, এ কি? আলো নিভে গেল কেন ? গাড়ির শব্দ পাচ্ছি না, তবে কি টের পেয়েছে ?

   মেঘের ফাক দিয়ে উকি দেওয়া তারাদের মিটমিটে আলোয় পাক হানাদারদের ছায়ামূর্তি হয়ে গাড়ি থেকে নেমে পজিশান, ---গুরুম—গুলির তীব্র শব্দ চারদিক প্রকম্পিত করে তোলে, --এ কি? কাদের আর্ত চিৎকার,সব কিছু পরিস্কার,আমরা  যে শরনার্থি দের নিতে এসেছি, ওদের ওপর—আর চিন্তা করতে পারছি না, মস্তিস্কের কোষে কোষে  আগুনের শিখা , আক্রোশে চোখের কোনা থির থির করে কাপছে সুনিলদার,--চা—র—জ—চাপা গলায় কমান্ড ভেসে এলো, হাতের অস্ত্র গুলোকখন গর্জন করে উঠেছে টের পাইনি, অনবরত পজিশান বদল করছি, হামাগুড়ি দিয়ে কখনও সামনে ,পিছনে চরকির  মত ঘুরছি,চারদিক আগুনের শিখা ভেসে আসছে, 

হঠাৎ অপর পক্ষ নিরব , দ্রুত পায়ে হানাদারগুলোগাড়িতে উঠে চম্পট,  চাপা আনন্দে বুক থেকে জয় বাংলা  শব্দ বেরিয়ে আসছে,

সতর্ক পায়ে রাস্তা পার হয়ে মাঠে পা দিতে পৃথীবির সমস্ত বিমূড়তা আমাদের গ্রাস কোরলো, মেঘের দেশ থেকে ভেসে আসা ঘোর লাগা আলোয় তোমার মুখ থেকে গল্প শোনা কুরুক্ষেত্র দেখলাম, চারদিক হাত পা মস্তক বিহীন অজস্র দেহ, নিথর হয়ে থাকা মায়ের দেহ আকড়ে বাচ্চাদের কান্না, অস্ত্র হাতে যুবক দের দেখে শরনার্থি দের মধ্যে ভয়ের গুন্জন ওঠে,–আপনারা ভয় পাবেন না ,আমরা মুক্তি বাহিনীর ছেলে ,আপনাদের নিতে এসেছি,—চার দিক শুধু উল্লাসের স্রোত,

এবার তোমাকে একটা অবাক করা গল্প বলি, আবার আকাশ ভেংগে চারদিক  ঝম ঝম বৃষ্টি, এর মধ্যে মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা শরনার্থিদের তড়িঘড়ি করে নৌকায় উঠি্য়ে  দিচ্ছে, পাছে আবার পাক হানাদার রা এসে পড়ে, হঠাৎ একটা চিল চিৎকার সমস্ত জায়গাটা প্রকম্পিত করে তোলে,---না, না, আমি যাবো না, মিতুকে না নিয়ে যাবো না, আমাকে ছেড়ে দাও---- এক মায়ের করুন চিৎকারে সমস্ত জায়গাটা স্তদ্ব, , স্বামি কিছুতেই  ধরে রাখতে পারছে না,ভীড় এর মধ্যে গুন্জন ওঠে---মহিলা পাগল হয়ে গেছে, ,বাচ্চা  কি আর বেচে আছে, উল্টে আমাদের বিপদ---

 উনার দিকে তাকিয়ে  মনের মধ্যে ঝড় বয়ে গেল, ঐ তো তুমি, তোমার মত  পরনে আটপৌরে শাড়ি ,কপালে সিন্দুর এর ছোয়া, একটু চ্যাপ্টা নাক, মায়াময় একজোড়া চোখ, কি করুন আর্তি ঝরে পড়ছে, ----চলেন আমি যাবো---প্রত্যেকের দৃষ্টি আমার উপর নিবদ্ব, হাতের  ষ্টেন টা সুনিলদার হাতে তুলে দিয়ে মায়ের হাতটা  মুঠোর মধ্যে রাখি, মা্য়ের চোখে  অশ্রু,

 মেঘে ঢাকা আকাশের ঘোলাটে  আলোয় সব কিছু অস্পষ্ট, পিছল মাটিতে ছুটতে গিয়ে মৃতদেহের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ছি,,--মনে পড়েছে, একটা গোয়াল ঘর এর পাশে থেমেছিলাম, চল  ওখানে---কোথায় সেই ঘর, অন্ধকারে  অন্ধ হয়ে  পাশে ছুটছি  ঐ তো অন্ধকারে একটা ঘর , কে ওখানে , একটা বাচ্চার ছোট্ট অবয়ব অষ্পষ্ট ভাবে নজরে এলো, বুকটা ছ্যাৎ করে উঠলো,নাঃ কান্নায় ভেংগে পড়া মায়ের মুখের দিকে বাচ্চাটা চুপচাপ তাকিয়ে আছে,,--তাড়াতাড়ি   চলেন---      কানের পাশ দিয়ে তীব্রগর্জন করে ছুটে চলা আগুনের গোলা আমার কথা শেষ করতে দিল না,

মিতুকে কোল নিয়ে উপুড় হয়ে পড়ি, আমাদের শরীরের  উপর উপুড় হয়ে পড়া মায়ের বুকের প্রতিটি হৃদস্পন্দন থেকে ভালবাসার শব্দ ঝরে পড়ছে, ক্রমশঃ ঘোরের মধ্যে তলিয়ে যাচ্ছি, পূর্নিমার চাদ থেকে ঝরে পড়া দুধ সাদা জোৎস্নায় প্লাবিত উঠোনে তোমার কোলে বসে ভালবাসায় সিক্ত হচ্ছি, অনন্ত ভালবাসার প্রহর বিন্দু বিন্দু হয়ে ঝরে পড়ছে,

হঠাৎ গুলির শব্দ থেমে গেছে, জয় বাংলা ধনি ভেসে আসছে,একহাতে মিতুকে কোলে ,অন্য হাতে মাকে নিয়ে নিরব পায়ে উপস্তিত হতেই কি তুমুল কোলাহল, সুনিল দা হাতের অস্ত্র ফেলে আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্না য় ভেংগে পড়লো———

(না, চিঠি এখনো শেষ হয়নি, অনেক নাম না জানা কিশোর মুক্তিযোদ্বার মত ও হারিয়ে গেছে,না ও হারায় নি ,এখনও চিঠি লিখে চলেছে, মা নিঃশব্দেরাতের অন্ধকারে ছেলের চিঠির জন্য অপেক্ষা করছে–)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *