বিমল মণ্ডলের কাছেও কবিতা একটি আশ্রয়
তৈমুর খান
কবিতা যেমনই লেখা হোক তা যে কবির আশ্রয় অন্বেষণ তা বলাই বাহুল্য। এই জগৎ-সংসার,পার্থিব প্রেম, নারীশরীর কবির কাছে যতই কাম্য হোক—এর বাইরেও কবির কিছু প্রয়োজন আছে, যে প্রয়োজনের কথা তিনি উপলব্ধি করেন, কিন্তু প্রকাশ করতে পারেন না। যে প্রয়োজন তাঁকে এক বিশাল শূন্যতার কাছে এনে দাঁড় করায়। হাজার প্রাপ্তির মাঝেও তাঁর কাঙ্ক্ষিত প্রাপ্তি অধরাই থেকে যায়। যেমন হাজার মানুষের ভিড়েও কবি একা, তেমনি হাজার বৈভবের মধ্যেও তিনি নিঃস্ব। তাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত কবি এডনা সেন্ট ভিনসেন্ট মিলায় (১৮৯২-১৯৫০) এই প্রসঙ্গে বলেছেন:
“Time does not bring relief; you all have lied
Who told me time would ease me of my pain!
I miss him in the weeping of the rain;
I want him at the shrinking of the tide;
The old snows melt from every mountain-side,
And last year’s leaves are smoke in every lane;
But last year’s bitter loving must remain.”
~Edna St. Vincent Millay
অর্থাৎ সময় স্বস্তি আনে না; তোমরা সবাই মিথ্যা বলেছ
কে বলেছে সময় আমার কষ্ট লাঘব করবে!
বৃষ্টির কান্নায় তাকে মিস করি;
জোয়ারের সঙ্কুচিত সময়ে আমি তাকে চাই;
পুরানো তুষার গলে যায় পাহাড়ের প্রতিটি দিক থেকে,
আর গত বছরের পাতার ধোঁয়া প্রতিটি গলিতে;
তবে গত বছরের তিক্ত প্রেম অবশ্যই থাকবে।
কবিতাংশটিতে ‘প্রেম’ এবং ‘সময়’ কবিকে স্বস্তি দিতে পারেনি। তাই তিক্ত অভিজ্ঞতার জীবন বহন করে নিয়ে চলেছেন। আর কবিতার কাছেই এই জীবনের ভার নামিয়েছেন।
এই কথাগুলি মনে পড়ল সম্প্রতি প্রকাশিত বিমল মণ্ডলের দুটি কাব্যগ্রন্থ ‘বিশ্বাসের চুপকথা’(প্রথম প্রকাশ কলকাতা বইমেলা ২০২০) এবং ‘ভোরের দরজা ঠেলে’(প্রথম প্রকাশ বইমেলা ২০২২) কাব্য দু’খানি পাঠ করতে গিয়ে। ‘বিশ্বাসের চুপকথা’-র ভূমিকায় লিখেছেন: “প্রাত্যহিক পৃথিবীর বেঁচে থাকার পাথর সরাতে সরাতে ঋতুবতী সময়ের করিডোরে খুঁজে পেতে চেয়েছি মহানুভব আলোর আত্মীয়তা, ছুঁতে চেয়েছি নদীর গান—শিশির ভেজা দু’বেলা ধান। এভাবেই সন্ধানী হৃদয়ে পেয়েছি শব্দ ও শব্দের চুম্বন।” ‘বেঁচে থাকার পাথর’ প্রতিটি মুহূর্তেই আমাদের সম্মুখে দাঁড়িয়েছে। নিরাশার অন্ধকার দূরে ঠেলে দিয়েছে। অপেক্ষা ও অবিশ্বাস শব্দগুলি বারবার ফিরে এসেছে। কিন্তু হৃদয়ের শূন্যতা কখনো দূর হয়নি। তখন কবিতার কাছেই আশ্রয় নিতে হয়েছে। কষ্টের কথা কবিতাকেই বলতে হয়েছে:
“তুমি আমার অনন্ত হৃদয় গভীরে
তবুও বুকের পাশে শূন্য দুয়ার
অজস্র গানের সুর
আনন্দ-কোলাহলে বাজে
আরশিতে হেঁটে যেতে যেতে
তোমাকে জড়াতে চায়
মন খারাপের ছায়া।”
যাকে হৃদয়ের গভীরে রাখা যায়,তার শূন্যতাও ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। অজস্র গানের সুর এবং আনন্দের কোলাহল থাকলেও হৃদয় নিরানন্দ উপভোগ করে। মনখারাপের ছায়া পতিত হয়। হাতের মুঠো খুলে শুধু শূন্যতাই সামনে আসে। আরেকটি কবিতায় কবি উল্লেখ করেন:
“ভালোবাসাহীন চাঙড় সরিয়ে
পুরনো স্মৃতির তেষ্টা মেটাই
রাত-দিনের ব্যবধান ঘুচিয়ে
বাঁচার উচ্ছ্বাসে শব্দ তরঙ্গের বিপুল ধারায়
খুঁজে পাই নতুন আলোর দিশা
আনন্দের শাঁখ বাজাই।”
‘ভালবাসাহীন চাঙড়’ বেঁচে থাকার পাথরের মতোই ভারী। তবু তাকে সরিয়ে প্রেমের পথে অগ্রসর হতে হয়। প্রেম নেই তবুও প্রেমের অন্বেষণ। আত্মার তৃষ্ণা যে অনন্ত। তা কিছুতেই মেটানো যায় না। তাই তরঙ্গের বিপুল ধারা কবিতার কাছেই নামিয়ে আনেন। জীবনের উচ্ছ্বাসে ভরিয়ে তুলতে চান চেতনাকে। আর তখনই আনন্দের শাঁখ হয়ে বেজে ওঠে কবিতার শব্দ। সমস্ত তিক্ততা শূন্যতা ব্যর্থতা অপূর্ণতা অসহিষ্ণুতা বিমর্ষতা বিবর্ণতাকে কবিতার কাছেই তখন রেখে দেন। সূর্যোদয়ের কাছে আত্মসমর্পণের কার্পণ্য করেন না:
“আমি সব দিয়ে যেতে চাই
আলো, সময়, টান… ভালোবাসা…”
পৃথিবীর যাবতীয় কবিরাই এই শূন্যতার কবিতাই লিখে চলেছেন। নিঃস্ব হয়েও কবিতার কাছে সমর্পণ তাঁদের। বিমল মণ্ডলও তা উপলব্ধি করেছেন:
“কালি-কলম-মন—সারা শরীরে পেরেক গাঁথে
লেখে আজ কত কত জন।”
তখনই বোঝা যায় কবিতার শব্দ যন্ত্রণার শব্দ। কবিতার বোধের আকাশ যন্ত্রণার আকাশ।
‘ভোরের দরজা ঠেলে’ কাব্যটিতে আত্মগত বেদনার স্মৃতি বারবার ঘুরেফিরে এসেছে। দুঃখী মায়ের দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় বাৎসল্য হৃদয়ের উদ্বেগ কিছুতেই কবি ভুলতে পারেননি। সেই সন্তানবাৎসল্যের মানবীয় আবেগ কবিও বহন করে চলেছেন। ক্ষুন্নিবৃত্তি জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত জীবন্ত হয়ে উঠেছে। কবির বাল্য-কৈশোরের সংগ্রামময় সংঘাতময় জীবনের ছবিটি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। কিন্তু সেসবকে ছাড়িয়েও মানবিক স্বপ্ন ও ভালোবাসার কাছে কবির দায়বদ্ধতাই কতখানি সে কথা বোঝা যায়। আমফানের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ যখন নিঃস্ব করে দিয়েছে তখনো কবি মূল্যবোধ হারাননি। জলমগ্ন ভাঙা ঘরে ভোরের দরজা ঠেলে স্বপ্ন আসবে এই আশা হারাননি। “আমারও সময় আসবেই” বলে বুক বেঁধেছেন। “রোদ উঠবেই” বলে বিশ্বাস করেছেন। “ভালোবাসা থাকবেই” বলে আলোর ইশারা অনুভব করেছেন। আর সবশেষে মায়ের আশীর্বাদে ভরসা রেখেই ভোরের দরজা ঠেলার শব্দ পেয়েছেন।
বিমল মণ্ডল সহজ জীবনের, সহজ ভাষার, সহজ ভাবের কবি। কবিতা নিয়ে তিনি অযথা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেননি। আত্মজীবনের প্রেক্ষিত থেকে যা উপলব্ধি করেছেন,নিজেকে যেমনভাবে চিনেছেন, সময়-সমাজ-রাষ্ট্রকে যেভাবে দেখেছেন, যেভাবে মূল্যবোধের অবক্ষয়, মানবিক চেতনার ধ্বংস ঘটতে দেখেছেন—তাকেই লিখেছেন নিজের ভাষায়, নিজের কথায়। শিল্প-নৈপুণ্যের নামে গোলকধাঁধার আলো-আঁধারিতে বোধকে কৃত্রিম করে তোলেননি। এই দুটি কাব্যগ্রন্থ পাঠ করলে কবিকে সহজেই সব শ্রেণির পাঠকই বুঝতে পারবেন।

১) বিশ্বাসের চুপকথা: বিমল মণ্ডল, বাতায়ন,৭জি, যশোর রোড (সাউথ), কলকাতা-৭০০১৩১, মূল্য-১০০ টাকা।

২) ভোরের দরজা ঠেলে : বিমল মণ্ডল, বাতায়ন,৭জি, যশোর রোড (সাউথ), কলকাতা-৭০০১৩১, মূল্য-৩০ টাকা।
