Bichitra Sen

Bichitra Sen

সম্পর্ক

বিচিত্রা সেন

‘সাবানটা এত ছোট হয়ে গেলো কী করে?’ ওয়াশরুম থেকে ছুটে এসে রীনার মুখের সামনে সাবানটা ধরে চেঁচিয়ে উঠলো দোলন।রীনা একবার সাবানটার দিকে তাকিয়ে তারপর দোলনের চোখে চোখ রাখলো,কিন্তু কিছু বললো না। ‘কী হলো? মুখে জবাব নেই কেন? এটা এত ছোট হলো কী করে?’ আবার চেঁচিয়ে উঠলো দোলন।

রীনার রুচি হলো না এ প্রশ্নটার জবাব দিতে।সাবান কেন ছোট হয় দোলন কি তা জানে না! নিশ্চয় সাবান খাওয়ার মতো কোনো বস্তু নয়।তিনজন মানুষ ব্যবহার করতে করতেই তা ছোট হয়েছে।তারপরও ওয়াশরুম থেকে এসে এত বিশ্রীভাবে তার কাছে জবাবদিহিতা চাওয়া রীনার কাছে ভীষণ রুচিহীন লাগে।জবাব না পেয়ে আরও খেপে ওঠে দোলন।বিশ্রী একটা গালি দিয়ে বলে,’ঘরে অলক্ষ্মী ঢুকেছে,তাই কোনো জিনিসের বরকত পাওয়া যায় না।’ বলেই খিস্তি করতে করতে আবার ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ে দোলন।

রীনা চুপ করে বসেই থাকে।দোলনের এ ব্যবহার নতুন নয়।বিয়ের কয়েকদিন পরই দোলনের মুখোশ খসে পড়েছিল রীনার কাছে।অথচ বিয়ের আগে যে দোলনকে চিনতো সে ছিল দারুণ পরিশীলিত এক তরুণ।কথায় কথায় কবিতার লাইন আওড়াতো,গুন গুন করে গেয়ে উঠতো গান।রীনাকে পটাবার জন্য কত কাণ্ডই না করেছে সে!একবার তো রাত বারোটায় মরে যাচ্ছে বলে এক বন্ধুকে পাঠিয়েছিল রীনাদের বাসায়।সেসব স্মৃতি মনে পড়লে রীনা কিছুতে মেলাতে পারে না বিয়ের পরের এ দোলনকে।

রীনা উঠে গিয়ে ব্যালকনিতে দাঁড়ায়।এ এলাকাটা ঘনবসতি।বিল্ডিং এর সাথে লাগোয়া বিল্ডিং।ব্যালকনিতে দাঁড়ালে হয়তো কারো বেডরুম চোখে পড়ে,কারো হয়তো বা কিচেন।তাই বেশিক্ষণ দাঁড়ানো হয় না।আবার ফিরে এসে সে ড্রয়িংরুমে বসে।তার মেয়েটা টিভিতে গোপাল ভাঁড়ের কার্টুন দেখছিল।মাকে পেয়ে মেয়েটা আহ্লাদী হয়ে ওঠে।মায়ের কোলে মাথা রেখে সে সোফাতে শুয়ে পড়ে।

মেয়ের চুলে বিলি কাটতে কাটতে রীনার মনে পড়ে যায় তার ফুলশয্যার কথা।অনেক স্বপ্ন ছিল তার এ রাতটিকে নিয়ে।যেহেতু তার জন্য দোলন পাগল এক প্রেমিক ছিল,তাই তার আশা ছিল এ রাতটি তার জন্য খুব স্পেশাল হবে।কিন্তু তার সব স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গিয়েছিল সেদিন।দোলন যে অন্য ধাতুতে গড়া এবং তার সাথে যে রীনার কখনোই বনবে না সেদিনই সে তা টের পেয়ে গিয়েছিল। সেদিনের সে তিক্ত রাতটির কথা মনে পড়লে রীনার মন ভীষণ রকমের বিষণ্নতায় আক্রান্ত হয়।

তারপরও রীনা মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে গেছে এতটা বছর।আসলেই কি সে পেরেছে মানিয়ে নিতে!

  • কী ব্যাপার! বসে আছো কেন? দেখতে পাচ্ছো না আমি বের হয়েছি? ভাত দাও।
    কখন যে দোলন ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এসেছে রীনা তা খেয়াল করেনি।দোলনের শ্লেষমাখানো কথায় তার সম্বিৎ ফিরে এলো।রীনা মেয়ের মাথাটা সরিয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ালো,তারপর বললো,
  • ভাত দিচ্ছি, এসো।

খেতে বসেই দোলন বললো,’টেবিল ভালো করে মোছো না? আঠা আঠা লাগে কেন? রীনা উত্তর দেবার প্রয়োজন বোধ করে না।কারণ সে জানে সবকিছুতে খুঁত ধরতে না পারলে দোলনের নিজেকে পুরুষ মনে হয় না।রীনা ভাত বেড়ে দেয়।পাতে মুরগীর রানটা তুলে দেয়।সাথে সাথে খেঁকিয়ে ওঠে দোলন,
-এটা কী করলে তুমি? আমার ভাত খাওয়াটা নষ্ট করে দিলে? আগে মাংস দিলে কেন? তুমি জানো না আমি আগে ডাল খাই! তা জানবে কেন? মন তো সংসারে নাই।
বলেই প্লেটের থেকে মুরগীর রানটা সরিয়ে একটা ছোট প্লেটে তুলে রাখলো,এরপর ডাল নিয়ে তা দিয়ে ভাত মেখে আওয়াজ করে খেতে লাগলো।

অসহ্য চাপা ক্রোধে রীনার একবার ইচ্ছে করলো চিৎকার দিয়ে বলতে,’তুই চুপ কর।’ কিন্তু মেয়ের কথা ভেবে অনেক কষ্টে নিজেকে সংযত করলো।দোলনের ব্যবহার দিনে দিনে তার কাছে অসহ্য হয়ে উঠেছে,কিন্তু মেয়েটার কথা ভেবে সে সব সয়ে যাচ্ছে বাধ্য হয়ে।

চুকচুক করে ডালভাত খেয়ে এবার মাংসটা প্লেটে নেয় দোলন। তারপর একটু করে মুখে দিয়ে মুখ বিকৃত করে বললো,
-লবণ তো কম হয়েছে।গরম মসলাও কম।
রীনা মনে মনে বলে,’তুই এত বেশি বুঝস ক্যান? একটু কম বুঝতে পারস না?’ কিন্তু মুখে কিছুই বলে না।
দোলন আবারও বলে,
-রান্নার সময় কি হাতে মোবাইল ছিল নাকি? তুমি তো আবার এখন সারা দিনরাত মোবাইল নিয়ে থাকো।

রীনা জবাব দেয় না।এসব প্রশ্নের উত্তর সে আগে দিতো, দিয়ে দেখা গেছে এতে তিক্ততা বাড়ে শুধু।আসলে দোলনের স্বভাবই হলো সবকিছুতে খুঁত ধরা,এবং এ কাজটি সে গর্ব ভরেই করে।সে খুব গৌরব করেই বলে,আমাদের বংশের পুরুষেরা কখনো বউয়ের কথায় চলে না।বউদেরকে আমাদের বংশের পুরুষেরা দা এর তলার মাছ বানিয়ে রাখে। এসব কথা শুনে রীনা মনে মনে করুণা করে দোলনকে।বউকে দা এর তলার মাছ বানানোর মধ্যে যে কোনো কৃতিত্ব নেই,ভালোবাসার সঙ্গী বানানোর মধ্যেই কৃতিত্ব সেটা দোলনের মতো পুরুষরা কখনো বুঝবে না।

ভাত খেয়ে উঠে দোলন বেডরুমে যায়।সবকিছু গুছিয়ে টেবিল পরিষ্কার করে রীনাও যায় বেডরুমে।দোলন পেপার পড়ছিল,রীনা ঢুকলে পেপারটা পাশে রেখে রীনার দিকে তাকায়,তারপর খুব গাঢ় স্বরে বলে,
-তোমাকে তো দারুণ সুন্দর লাগছে! তুমি আসলেই সুন্দর।
কে বলবে এটা দশ মিনিট আগের দোলন! গলার স্বর একদম পরিবর্তিত। যেন সেই বিয়ের আগের উন্মাতাল প্রেমিক দোলন।
দোলনের এই প্রশংসাতে রীনার উচিত ছিল খুশি হওয়া,কিন্তু রীনা খুশি হতে পারে না।বরং তার গা ঘিন ঘিন করে ওঠে।কারণ এত বছরে রীনা এটা বুঝতে পেরে গেছে দোলন কখন তার প্রশংসায় পন্চমুখ হয়।তাই দোলনের মুখে রীনার প্রশংসা শুনলে এখন তার গা ঘিন ঘিনই করে।

রীনার মুখের কাঠিন্যকে দোলন খুব একটা পাত্তা দেয় না।সে আবারও বলে,আসো,আমার পাশে এসে বসো,
তোমাকে একটু দেখি।রীনা পাশে বসে না।নিজের বালিশটা নিয়ে পাশের রুমে মেয়ের কাছে যেতে উদ্যত হয়।দোলন আঁতকে ওঠে,বলে,

  • কী হলো, তুমি কই যাও? তোমাকে পাশে বসতে বলছি না?
    রীনা খুব স্বাভাবিক কণ্ঠেই বলে,
    -আমি খুব ক্লান্ত।আমার ঘুমাতে হবে।তাই মেয়ের রুমে যাচ্ছি।
    -না,তুমি কোথাও যাবে না।এখানে ঘুমাও।আমি ঘুম পাড়িয়ে দেবো।-মেকী আহ্লাদ করে বলে দোলন।
    এসব ভণ্ডামি ভালো লাগে না রীনার।তার চেয়ে দোলন তার আসল রূপেই থাকুক।ওটা সহ্য করা যায়।কিন্তু বিশেষ বিশেষ সময়ে তার এত মোলায়েম রূপ রীনাকে বিদ্রোহী করে তোলে।ইচ্ছে করে তার মুখোশটা টেনে ফেলে দিতে।কিন্তু মনে মনে এতকিছু ভাবলেও বাস্তবে তার কিছুই করতে পারে না সে।মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে নীরবে শুধু সয়েই যায় এই দুমুখো মানুষটার মানসিক অত্যাচার।

বালিশটা নিয়ে মেয়ের রুমে চলেই আসে রীনা।মেয়েকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়ে সে।দুচোখ ছাপিয়ে অশ্রুর বান নামে।ভিজে যায় বালিশ।তার শুধু মনে হয় তার দাম্পত্যজীবনটা এমন হলো কেন? সে তো টাকা পয়সা বেশি চায়নি জীবনে।শুধু স্বামীর প্রাণ উজাড় করা ভালোবাসা চেয়েছিল।কিন্তু দোলন এমন কেন? কেন সে শুধু দেহসর্বস্ব একজন মানুষ? কেন সে শুধু রীনাকে মানসিক এবং শারীরিক পীড়ন করে বিকৃত আনন্দ পায়?

রীনার মনে পড়ে যায় বিয়ের কয়েকদিন পরের কথা।বাসায় অতিথি আসলে চা বানাতে গিয়ে সে দেখে দুধ পাউডার নেই,স্বাভাবিকভাবেই সে দোলনকে এসে বলে,
-এই শোনো,দুধ পাউডার তো নেই।আমাকে এক প্যাকেট দুধ এনে দাও তো।
শুনে দোলন চেঁচিয়ে ওঠে,
-দুধ নেই মানে? আমি সকালে আধা পট দুধ দেখলাম,ওই দুধ গেলো কই?
রীনা বিস্মিত হয়ে বললো,
-কী বলছো তুমি?কাল রাত থেকেই তো দুধ নেই।তুমি সকালে কীভাবে দেখলে?
দোলন জোর দিয়ে বললো,
-আমি নিজের চোখে দেখেছি।তুমি মনে হয় দুধ খেয়ে ফেলেছো,কিংবা নষ্ট করেছো।
নববিবাহিত স্বামীর মুখে এ কথা শুনে রীনা স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল। যার সাথে তার মাত্র ছয় / সাত দিন আগে বিয়ে হয়েছে তার মুখে এমন ধরনের কথা শুনে অপমানে সে বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল।পরে দোলন দুধের প্যাকেট এনে দিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু সেদিনের যে ব্যবহার রীনার মনে দাগ কেটেছিল তা আজও অমলিনই রয়ে গেছে।সেদিনই রীনা বুঝতে পেরেছিল তার সাথে দোলনের মানসিক দূরত্ব অনেক বেশি।

এসব কথা ভাবতে ভাবতে কখন যে একটু ঘুমটা লেগে আসে রীনার চোখে,হঠাৎ সে দেখতে পায় দোলন তার পাশে হাঁটু গেড়ে বসে বলছে,
-তুমি আমার কথায় খুব কষ্ট পাও রীনা?
রীনা মাথা নেড়ে জানায় পায়।
-আমি আর কখনো তোমাকে কষ্ট দেবো না,কথা দিলাম।
খুশিতে রীনার দুচোখ ঝিকমিক করে ওঠে।দোলনের গলা জড়িয়ে বলে,
-সত্যি বলছো তুমি?
-হুম,একদম সত্যি।
আনন্দে রীনা এতটাই কেঁপে ওঠে যে,তার ঘুমটা ভেঙে যায়।চারপাশে চোখ বুলিয়ে দেখে দোলন নেই।তার মানে সে এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিল।মনটা আবার বিষাদে ভরে যায় তার।মেয়েটা ঘুমোচ্ছে।সে খাটের ওপর উঠে বসে।তখনই দরজার কাছে এসে দোলন চেঁচিয়ে ওঠে,
-বসে আছো কেন? সন্ধে হয়ে গেছে কতক্ষণ! চা দেবে না?
রীনা ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায়।এগিয়ে যায় রান্নাঘরের দিকে।পেছন ফিরে আরেকবার তাকায় মেয়েটার দিকে।ওর মায়া,তীব্র মায়া।ওর জন্যই তাকে মেনে নিতে হয় সব। ওকে বাবা কিংবা মা কোনো একজনকে ছাড়া করতে চায় না সে।কিন্তু কতদিন পারবে সে এভাবে নিজের জীবন বয়ে নিতে? কতদিন টিকে থাকবে তাদের এই অদ্ভুত সম্পর্ক?

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *