
মাতৃ স্মৃতিঃ ‘পেয়েও মানিক হারালাম’
“মাতা জননী ধরিত্রী, দয়াদ্র হৃদয়া সতী।
দেবীভৌ রমণী শ্রেষ্ঠা নির্দোষা সর্ব দুঃখহারা।।”
বরুণ মণ্ডল
এক মায়ের কোলে পাঁচ সন্তান মানুষ হতে পারে; কিন্তু পাঁচ সন্তানের ঘরে এক মায়ের জায়গা হয় না। এর থেকে বড় অনাচারের আর কি আছে! যে সমাজে এ ঘটনা ঘটে সে সমাজের ভালো হয় কি করে? চারিদিকে হাহাকার কেন তাও বোঝা যাচ্ছে না! আসলে আমরা শিক্ষিত হয়েছি, মানুষ তো হইনি!
সম্পর্কের জালে আমরা জড়িয়ে আছি। কিন্তু সেই সম্পর্কের প্রধান উৎস ‘মা’। বাস্তবে পিতামাতার মাঙ্গলিক আনন্দঘন মিলন মুহূর্তে জন্ম হলেও মায়ের পরিচয় প্রকট, আর পিতার পরিচয় প্রচ্ছন্ন থাকে। সব্বাই জানে মা কে! আর কেবল মা’ই জানে বাবা কে!
৮৪ লক্ষ যোনির ৮৪ লক্ষ পিতা-মাতার মধ্যে মায়ের অকৃত্রিম ভালবাসা ছাড়া জীবন যাপন সম্ভব নয়। পরমেশ্বর থেকে প্রাপ্ত আত্মার দেহজ লালন পালন যুগে যুগে মা’ই সম্পাদন করে। তাইতো কু সন্তান হলেও কু-মাতা কখনো নয়।
পরলোকে মা আমার গীতা রানী মন্ডল। তাঁকে বর্ণনা করা আমার এই ক্ষুদ্র অনুভূতি অনুভবে সম্ভব নয়। আকাশ গঙ্গার খসে পড়া নক্ষত্রের মতো হবে আমার এই মাতৃ স্মৃতি। পঞ্চ ইন্দ্রিয় যখন আবছা, মায়ের স্নেহের পরশে কিভাবে পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের দাস হয়ে উঠেছি, সেই ইতিহাস পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা করতে না পারা বড় লজ্জার, বড় ব্যর্থতা। সহস্র অত্যাচার হাসিমুখে মেনে যখন নিয়েছেন, তখন আজকের এই লজ্জাজনক পরিস্থিতিতে সবার আগে তিনি ক্ষমা করবেন। আশ্চর্যের কিছু নয়।
পিতার অনটনের সংসারে সন্তানের জন্য মায়ের প্রাচুর্যতা কমে না কখনো। তাইতো মা আমার গরিব বাবার ঘরেও ছিলেন ‘মহারানী’। তিনি হিসাব বোঝেন না, তাই খাবার ভাগ করার সময় নিজের ভাগে প্রতিদিন কম পড়ে যেত। প্রথাগত শিক্ষার অভাবে ঘড়ি দেখতে না জানলেও ঘুম ঠিক সবার আগেই ভাঙতো। সন্তান মানুষ করার সঠিক দাওয়াই তাঁর জানা ছিল; যদিও তার সন্তান মানুষ করার আধুনিক প্রশিক্ষণ তাঁর ছিল না। প্রতি পদে পড়শীদের ঈর্ষা কাতর উপদেশ বা তাচ্ছিল্য, কান ভাঙচির কারণে অভাবী রাজ্যের রাজা পিতার চক্ষুশূল হয়েও সন্তানের প্রতি কর্তব্যে অবিচল মা আমার। কত মান অভিমান- নাটক-মিথ্যের জাল বুনে সন্তানের জন্য নিজের জীবন বিপন্ন করে তুলেছেন প্রতিটি মুহূর্তে; তখন না বুঝলেও পরবর্তীতে বুঝেছি, ‘মা হওয়া নয় মুখের কথা’।
বহু যাতনা মুখ বুজে সহ্য করে চার সন্তান নামক আশার ঘুড়ি ওড়াতে ওড়াতে চোখের সামনে একে একে সকলে ভোঁ কাট্টা হয়ে পড়লেও আকাশ ছোঁয়ার প্রতিজ্ঞা থেকে এক বিন্দু সরে আসেনি। কোন একজন তো আকাশ ছোঁবেই। আহারে আমার মূর্খ মায়ের কি দৃঢ় প্রতিজ্ঞা!
মা আমার ধর্মের সারাৎসার না বুঝেই হয়তো অপত্য মায়ায় আবদ্ধ হয়ে মায়ার বিরুদ্ধ-পথ ‘বৈষ্ণবের মাধুকরী’কে আঁকড়ে ধরেছিলেন । কর্তব্যে অবিচল থেকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন,’লজ্জা-ঘৃণা-ভয়, মাতৃত্ব থাকতে নয়!’
তিনি তাঁর কর্তব্যে অবিচল। কখনো মিথ্যাকে অবলম্বন করে,কখনো ধর্মকে ঢাল করে নিজের ‘মাতৃ ধর্ম’ বিন্দুমাত্র ত্যাগ করেননি। সনাতন শাস্ত্র অনুসারে ইহজগতের কর্ম বিভাজন— কর্ম ,অকর্ম বিকর্ম। মায়াবদ্ধ জীব হিসেবে তাঁর কর্ম অকর্ম, বিকর্মের হিসাব নিকাশ চিত্রগুপ্তের খাতায় লিপিবদ্ধ। আশা রাখি, বিচারের তাঁরই জয় হয়েছে।
শুনেছি, মা হারালে মা পাওয়া যায় না। ৮৪ লক্ষ জীবনচক্রে ৮৪ লক্ষ বার মা প্রাপ্তি ঘটেছে; কিন্তু শ্রেষ্ঠ জন্ম এই মনুষ্যজন্মে যে মায়ের সান্নিধ্য লাভ করেছি, তিনি তো ভগবানেরই দূত ছিলেন। ঈশ্বরের কোন অবতারকালীন অবোধ জীব বুঝতে পারেনা অবতারের মহত্ত্বকে। অবতারকেই সমগোত্রীয় মনুষ্যতুল্য হিসেবে গণ্য করে। তাই সময় অতিক্রান্ত হলে আক্ষেপ থেকে যায়, ‘পেয়ে মানিক হারালাম!’
সংসার নামক কুরুক্ষেত্রে অন্ধ যোদ্ধার মত যুদ্ধোন্মত্ত অবস্থায় শ্রীকৃষ্ণের মত পরম সহায় মাতৃ দেবীকে যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শন করা হয়নি হয়তো বা। কিন্তু তাঁরই আশীর্বাদে কুরুক্ষেত্রের মাঠে এখনো লড়ে চলেছি… প্রতি মুহূর্তে সমস্যা সঙ্কুলের ঢেউ আছড়ে পড়লেও হারার পাত্র আমি নই! আপন মনে এই ভাবনা শক্তি যোগায়, যার প্রতি শ্রীকৃষ্ণের মত মাতৃছায়া বিরাজমান তার আবার ভয় কিসের?
তাঁর দুর্বিষহ কলির জীবন সায়াহ্নে সামান্য সেবা যত্নের সুযোগ মিলে ছিল; সে সুযোগ তাঁরই আশীর্বাদ।
সেই আশীর্বাদে বঞ্চিত হলে এ মানব জীবনে আক্ষেপের শেষ থাকত না। মাকে কন্যা রূপে সেবা করার সুযোগ দিয়ে নরক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিয়েছেন। আজ ‘দাঁত থাকতে দাঁতের মর্ম’ না বুঝতে পারার প্রবাদ বাক্য প্রতিনিয়ত অনুভূত হচ্ছে। সংসার কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ উন্মাদ সৈনিক আমার ‘সদা রণং দেহি মূর্তি’ দেখে কত মানসিক দৈহিক যন্ত্রনা অব্যক্ত রাখতে হয়েছিল, আজন্ম লালিত কত বাসনা, ‘কষ্ট করলে কেষ্ট মিলবে’ আশায় দিন অতিবাহিত করেও জীবনের অংক নিশ্চিত মেলাতে পারোনি।
বুঝেও না বুঝার ভান করা বা বুঝেও আশা পূরণে ব্যর্থ হওয়ার জন্য কিংবা ওই দু চোখের নীরব ভাষা বুঝতে না পারার জন্য আর একবার ক্ষমা কি করতে পারবে না? কে জানত বনিবনা না হলেও স্বামীর সঙ্গে তোমার আত্মিক বন্ধন ছিল সুদৃঢ়। সংসারের সদা ঠোকাঢুকি যার সঙ্গে সেই স্বামীর সঙ্গে চিরবিচ্ছেদের একটি বছর অসহায়ের মত অতিক্রান্ত করা প্রতিটা সময় কত দুর্বিষহ ছিল এখন বুঝি আর লাভ কি! একাকিত্বের নিরব আঘাতে মৃত্যুকে আপন করে প্রমাণ করলে স্বামীর প্রতি তোমার ভালোবাসা বা টান বিন্দুমাত্র কম ছিল না। আর নিজেদের বাঁচার প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত থাকতে গিয়ে কত প্রিয় জন, কত শুভাকাঙ্ক্ষীর মানসিক-দৈহিক মৃত্যু হয়ে চলেছে তার খবর রাখে না এই আধুনিক সমাজ।
শাস্ত্র শ্রবণ, অধ্যায়ন করে যতটুকু বুঝেছি, ওগো মাতৃদেবী,তুমি ৮৪ লক্ষ জনমের জন্ম-মৃত্যু-চক্রের পরীক্ষায় পাস করে গেছো। তোমার শেষ ইচ্ছা ‘আমার সন্তানরূপে’ কলি ভোগ করার ঊর্ধ্বে তুমি। তোমার স্থান নিশ্চিতভাবে অমরাবতীতেই হয়েছে। আমিও সে চেষ্টা করছি… জন্ম মৃত্যু রহিত গোলকধামে ঈশ্বরীয় সুখে ভগবানের সঙ্গ লাভ করতে থাকবো দুজনে।
প্রেরকঃ
বরুণ মণ্ডল রানাঘাট নদীয়া
মোঃ ৯৯৩২২৫৩৩৮৮