
ঐতিহ্যবাহী রায়চৌধুরী পরিবারের দশমা আরাধনা
বারিদ বরন গুপ্ত
পূর্ব বর্ধমান জেলার পূর্বস্থলী ব্লকের এক অন্যতম প্রাচীন জনপদ দোগাছিয়া! এখানকার রায়চৌধুরী পরিবারের ইতিহাস ৫০০ বছরের অধিক প্রাচীন! এক সময় কলকাতা অনতিদূরে বরানগর থেকে ভাগ্যের অন্বেষণে ঘাঁটি গেঁড়েছিল এই ব্লকেই মেরতলায়, অচিরেই নেক নজরে পরে বাদশাহী এবং মুঘল দরবারে, তারপর শুধু ইতিহাস! আজকে সেই সূত্রেই এসেছি পূর্বস্থলীর দোগাছিয়ায়। এর আগেও দোগাছির বিস্তীর্ণ অঞ্চলের সমীক্ষা করেছি বেশ কয়েকবার, শুনেছি কর বাবুদের নানান ইতিহাস, বিখ্যাত দোল উৎসব, আছেন গোপীনাথ, মদনমোহন, কৃষ্ণচন্দ্র, রাধানাথ, আছে অসংখ্য অনাদি লিঙ্গ, ষোড়শ শতক থেকে বিংশ শতকে প্রথমার্ধ পর্যন্ত নানান কাহিনীর ঘন ঘটায় জড়িয়ে আছে স্বর্ণযুগের দ্যুতি, থাক সে কথা পরে একদিন হবে জমিদারির অন্দরমহলে! আজ শুধুই দশমা, খুব সম্ভবত সপ্তদশ শতকের প্রথমার্ধে এই মন্দির তৈরি করেন শ্রীধর করেরা, আগেগোড়া বৈষ্ণব ভাবাদর্শে বিশ্বাসী এই ঐতিহ্যবাহী পরিবারটি, পরে কোন ঘটনা প্রবাহে শক্তি আরাধনার অঙ্গ হিসেবে দশভূজা দশমার আরাধনায় লিপ্ত হয়। আজ শারদ প্রাতে শুভ অষ্টমীতে মুঘল থেকে ব্রিটিশ নানা ঘটনার স্মৃতিকথায় হারিয়ে গেলাম প্রদীপ রায় চৌধুরী এবং কৃষ্ণা সরকারের সাথে, একে একে হাজির হলো সমাজবিদ্যার ছাত্রী অঙ্কিতা রায়চৌধুরী অদিতি রায়চৌধুরী , অমিতাভ রায় চৌধুরী, অর্ক রায় চৌধুরী , এরা আমাকে গোটা মন্দির চত্বর ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখালো, কয়েক ঘণ্টার মধ্যে রায় চৌধুরী পরিবারকে আপন করে নিলাম!
মনে হয় আগে দশমার মন্দিরেই দেবীর শারদ আরাধনা হতো, মহিষ,মেষ, ছাগ বলি হতো, বর্তমানে দশমার মন্দিরে শুধুমাত্র ছাগ বলী হয়, অন্য পাঁচটি মন্দিরে আঁখ, চাল কুমড়ো কলাবলী হয়,এখনো শুরু এবং শেষ এখানেই, যদিও বর্তমানে দশমার আরাধনা পাঁচটি ভাবে ভাগ হয়ে গেছে, যেমন বড় সিকি, ছোট সিকি, ছয় আনা, বড় মশাই এবং মল্লিক। আজকে শুধুমাত্র তিনটি মন্দির বড়সিকি ছোট সিকি এবং বড় মশাই মন্দিরে দেবীর আরাধনা পর্যবেক্ষণ করলাম। অঙ্কিতা আমাকে দেবীর প্রাচীনত্ম নিয়ে দৃষ্টিপাত করলেন। আমার মনে হয় বড়সিকি মন্দিরটি প্রথম তৈরি হয়েছিল। এই মন্দিরে সিংহের মুখে ঘোড়ার আদল ধরা পড়েছে, এটি হিমালয়ের কাকুড়ে সিংহ, দেবী মহিষাসুর বধে কল্পনায় এই সিংহের রূপ নিয়ে আসেন। ছোট সিকি মন্দিরটি বেশ সাজানো গোছানো, দুটি মন্দিরই দশমার মন্দিরের একেবারে পশ্চিম প্রান্তে!আজ দেবীর পূজায় রায়চৌধুরী পরিবারের সাবিকীয়ানার কথা বারে বারে স্মরণ করাচ্ছে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক অমিতাভ বাবু আমাকে খিরকি জমিদারি চত্তর দেখিয়ে নিয়ে গেলেন বড় মশাই মন্দিরে, তখন অষ্টমী পূজার আরতি শুরু হয়েছে, এই বড় মশাই পরিবারের বর্তমান প্রজন্মের এক সদস্যা আমায় নিয়ে গেলেন জমিদার বাড়ির অন্দরমহলে, বর্তমানে অনেকটাই ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে, উঁকি মারে অতীতের রায়চৌধুরী পরিবারের আভিজাত্য এবং সুদিনের ইতিহাস! চা জলপানির পর আবার ফিরে এলাম মন্দিরে, সামনেই দেখা যায় হোমকুন্ড, তিনটি ঘর ভগ্ন প্রায়, ছিল কুলঙ্গী, ছিল পীলসুজ, তার ইতিহাস স্মরণ করাচ্ছে খোপ গুলি!, হোমকুন্ড টি বুঝে গেছে, অতীতে সপ্তমী থেকে দশমী দিনরাত হোমের আগুন জ্বলতো, পুড়তো মন-মন ঘি, ধুমার কুণ্ডলী বিরাজ করত গোটা দোগাছিয়া চত্বর! অজ সব অতীত, আলো-আঁধারি ছায়ায় ঘুরছে, দশ পৃষ্ঠা ব্যাপি প্রবন্ধের কিছু রাখলাম, এর বাকি অংশ থাকছে আমার গবেষণামূলক গ্রন্থ “খড়ি নদীর তীরে!”
আবার, বারে বারে আসার অনুমতি নিয়ে ফিরে চললাম খড়ি নদীর তীরে, এদের আন্তরিকতায় আমি মুগ্ধ, যেন গোটা রায়চৌধুরী পরিবার আমায় আপন করে নিল, তাই আজ বলতে ইচ্ছা করে-“রায় চৌধুরী পরিবার আছে রায় চৌধুরী পরিবারেরই!”
**লেখক পরিচিতি:: বারিদ বরন গুপ্ত, মন্তেশ্বর পূর্ব বর্ধমান, কবি সাহিত্যিক প্রাবন্ধিক গবেষক সমাজ সংস্কৃতি বিষয়ক লেখালেখিতে যুক্ত আছেন।
MODE Field study 29, on 3rd October 2022.
Source:: Pradip Ray Chaudhary Krishna sarkar, Ankita Ray Chaudhary, Aditi Ray Chaudhary, Arkajit Roychowdhury, Kajal Ray Chowdhary, Amitabha Ray chaudhari, Saroj Basu, Rishita Basu Dogachiya.,East Burdwan.