
প্রাচীন গ্রাম সমাজের দুর্গোৎসব
বারিদ বরন গুপ্ত
আজকের গ্রাম বাংলার সাথে প্রাচীন গ্রাম বাংলার সাথে কিছুতেই মেলানো যাবে না, এক কথায় গ্রাম বাংলার গঠন কাঠামো এবং কার্যধারার ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে! এই পরিবর্তন আসতে শুরু করে মোটামুটি বিগত আটের দশক থেকে, পঞ্চায়েত ব্যবস্থা চালু হওয়ার ফলে গ্রাম বাংলার রাস্তাঘাট নির্মাণ বা পুননির্মাণ চলতে থাকে! গ্রামের অলিতে গলিতে মোরাম, এমনকি রাস্তাঘাট পাকা হতে থাকে, যোগাযোগ ব্যবস্থা ও বৃদ্ধি পায়, ফলে গ্রামীণ সমাজ জীবনের সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাঠামো একটু একটু করে বদল হতে থাকে!
নব্বইয়ের দশক থেকে বিশ্বায়নের ছোঁয়ায় গ্রামবাংলা ও দুলতে শুরু করে! বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে এই দোলন আরো বৃদ্ধি পায় ! বিদেশি বণিক এবং শিল্প সংস্থার নজর পড়ে গ্রাম বাংলার দিকে! যোগাযোগ ব্যবস্থা আরো উন্নত হতে থাকে! শহরের সাথে গ্রামের ফারাক কমতে থাকে! শহুরী তথা পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রভাব গ্রামবাংলায় পড়তে শুরু করে, ফলে গ্রামীণ জীবনের কার্য ধরার ও ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়! শহরের মতো গ্রাম-গঞ্জেও বড় বড় বাজার গড়ে উঠতে থাকে! এই সময় পর্বে গ্ৰামিন মানুষজনের রুচির পরিবর্তন ও ঘটতে থাকে! নেট ইন্টারনেটের সংযোগ স্থাপিত হয়, অনলাইন ব্যবসা জাঁকিয়ে বাসে,মানুষের মনোজগতের ও পরিবর্তন ঘটে। এর ফলে গ্রামীণ সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য আঘাতপ্রাপ্ত হয়, অনেক সময় পিছু হটতে থাকে! আজকে দুর্গোৎসবে তারই প্রতিফলন লক্ষ্য করা যাচ্ছে! দিন দিন গ্রামীণ পূজার ঐতিহ্য এবং আবেগ হারিয়ে গেছে, সেই জায়গা দখল করে নিয়েছে আভিজাত্য এবং রঙিন সংস্কৃতি! আজকে দুর্গোৎসবে গ্রামগঞ্জে শহরের মতো বড় বড় প্যান্ডেল, আলোর ঝলকানি, এবং তথাকথিত রঙিন সংস্কৃতির দাপাদাপ চোখে পড়ছে।
আমরা সাতের এর দশকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত গ্রামবাংলায় দুর্গাপুজোয় সাবেকিয়ানা দেখেছি! প্রাচীন সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য সবসময় বিরাজ করত! প্রাচীন ভাব ধরা মেনে নিষ্ঠা সহকারে পূজা অর্চনা হতো, পূজায় নিষ্ঠা এবং আচার অনুষ্ঠান সব সময় প্রাধান্য পেত, কিন্তু বর্তমানে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, পাশ্চাত্য সংস্কৃতি সেই ঐতিহ্যকে আঘাতপ্রাপ্ত করছে, আচার অনুষ্ঠানে পাশ্চাত্য সংস্কৃতি ঢুকে পড়ছে, কথায় বলে খাজনার চেয়ে বাজনা বেশি, সর্বোপরি পূজোর মূল সুরকে হারিয়ে দিচ্ছে আলো, প্যান্ডেল, বাজনা আরো অনেক কিছু ! যতদিন যাবে প্রাচীন ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতি হটবে ,তার জায়গায় এসে যাবে রঙিন দুনিয়া, পাশ্চাত্য সংস্কৃতি!
দুর্গাপুজো যে বাঙালির ঐতিহ্য আবেগ তা আমরা সাতের দশক পর্যন্ত দেখেছি! গ্রাম বাংলার আটচালায়, বা বাশ দিয়ে তৈরি অস্থায়ী সাধারণ মেরাপ বেঁধে পূজা করা হতো ! পাঁচের দশক পর্যন্ত সাধারণত জমিদারি বা অভিজাত পরিবার গুলিতেই দুর্গা পূজা হতো! গ্রাম বাংলার চাষি বাসি সাধারণ মানুষ জন পুজোর চারদিন সেখানেই ভিড় করতো ! পাঁচের দশকের মাঝামাঝি সময় পর্বে জমিদারি উচ্ছেদ হয়! কিন্তু জমিদারি উচ্ছেদ হলেও সাতের দশক পর্যন্ত গ্রামবাংলায় জমিদারির অস্তিত্ব বজায় ছিল! তখনোও জমিদারদের কিছু কিছু জমি ছিল, জমিদাররা মাঝে মাঝে কাছারিতে ও আসতেন, সেই সময় পরবে জমিদারদের দেয়া স্থানে এবং আনুকূল্যে অনেক গ্রামে দুর্গোৎসব শুরু হয়! আস্তে আস্তে সেগুলো বারোয়ারীর রুপ নিয়েছে!
তখন পুজোর দু মাস আগে থেকেই গ্রামের দুর্গা মন্ডপে মৃৎশিল্পীরা এসে হাজির হত, আমরা এর ওর খামার থেকে খড়, বাশ, মাঠ থেকে মাটি, দোকান থেকে দড়ি এনে দিতাম! গ্রামের বাড়িতে বাড়িতে মিস্ত্রিদের খাওয়ার বন্দোবস্ত হত! সেগুলো গ্ৰামের ছেলেরাই করতো, শুধু তাই নয় প্রায় সারাটাদিন ওই পূজা মণ্ডপেই পড়ে থাকতাম ! তখন মিস্ত্রিরা সাধারণত তিনবার আসতেন, প্রথমবার বাঁশের কাঠামো তৈরি করে ঘরের মূর্তি আদল বানিয়ে তারপর কাদা লেপে দিতো, তখন অবশ্য মূর্তিতে মাথা লাগানো হতো না আঙ্গুল টাঙ্গুল করা হতো না বা বস্ত্র পড়ানো হতো না, দ্বিতীয়বার যখন আসতেন অর্থাৎ দু মেটের সময় মস্তক, আঙ্গুল গহনা বস্ত্র সবকিছুই করা হতো, তখন কাপড়ের কোন বন্দোবস্ত ছিল না, সবটাই কাদার, এতে মৃৎশিল্পীদের কারুকার্য শোভাপেতো, তৃতীয় বার এসে খড়ি এবং রং লাগাতো, সবশেষে চক্ষুদান, শেষে ঢাকের সাজ, দুর্গা যেন সত্যিই মোহময়ী হয়ে উঠতেন, তাকে অসুর দলনী এবং অভয় দাত্রী উভয় ভূমিকায় দেখা যেত! আমাদের গ্রামের দাশু মিস্ত্রিকে দেখেছি একচালা কাঠামোয় পিছনের চালে বিভিন্ন পৌরাণিক দৃশ্যের অবতারণা করতেন, যা আজ আমরা বিভিন্ন টেরাকোটা মন্দিরে দেখতে পাই! সেইসব সাবেকিয়ানা সব হারিয়ে গেল ! আমাদের মন্ডপে পরান ভট্টাচার্যের চণ্ডীপাঠ বাধা ছিল। আজকাল গ্ৰামগঞ্জে সেসব সাত্বিক ব্রাহ্মণদের বড় অভাব! এখনকার ছেলেমেয়েরা পুজোর সময় চারটে পাঁচটা ছয়টা করে জামা পায়! আমাদের সময় একটাও ছুটতো না ! কিন্তু আবেগ ঐতিহ্য সুখ-শান্তি ষোলাআনা বজায় ছিল!সেসব দিনগুলো যেন হারিয়ে গেল! আর হয়তো কোনদিনই ফিরে আসবেনা!
লেখক পরিচিতি:: বারিদ বরন গুপ্ত, মন্তেশ্বর পূর্ব বর্ধমান কবি সাহিত্যিক প্রাবন্ধিক গবেষক সমাজ সংস্কৃতি বিষয়ক লেখালেখিতে যুক্ত আছেন।
