পুতুল নাচের ইতিকথা:: একসময় পুতুল নাচ গ্রামবাংলা কে মাতিয়ে রেখেছিল
বারিদ বরন গুপ্ত
এক সময়ে পুতুল নাচ গ্রাম বাংলাকে মাতিয়ে রেখেছিল! বাংলার লোকসংস্কৃতির একটি উল্লেখযোগ্য অংশ হলো পুতুল নাচ! একটা পুতুলকে সুতো দিয়ে বেঁধে হাতের বিভিন্ন কারুকার্যের সাহায্যে মুখের ভাষাটা কিভাবে একটা পুতুলের মাধ্যমে ব্যক্ত করার নতুন কৌশল সেদিন তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপলব্ধি করলাম! একটা সময় গ্রামগঞ্জের খেটে খাওয়া মানুষজন তাদের অবসর বিনোদনের অঙ্গ হিসেবে হাজির হতে পুতুল নাচের প্রাঙ্গনে! খুব অল্প পয়সায় বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল পুতুল নাচ! অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত গ্রাম বাংলায় পুতুল নাচ বেশ জনপ্রিয় ছিল! চার কোনে চারটে বাঁশপুঁতে ত্রিপল টাঙিয়ে স্টেজ তৈরি করে একসময় শুরু হয়েছিল যাত্রাগান! মাটিতে চেটাই পেতে খোলা আকাশের নিচে তাড়িয়ে তাড়িয়ে গ্রাম বাংলার যাত্রা প্রেমী মানুষজন তা উপভোগ করত! আজ সব অতীত! যান্ত্রিক সভ্যতার আড়ালে হারিয়ে গেছে বাংলার ঐতিহ্য বাহী লোকসংস্কৃতি পুতুল নাচ যাত্রাপালা প্রভুতি!
.
উল্লেখ্য যে একসময় পুতুল নাচ ছিল এক জনপ্রিয় লোকসংস্কৃতি, সাতের দশক পর্যন্ত বাংলার মাঠ ময়দান তোলপাড় করছিল নদীয়া চব্বিশ পরগনা মুর্শিদাবাদ জেলার পুতুল নাচ দল! এখনও স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করছে শ্রীরাধা পুতুল নাচ, দূর্গা মাতা পুতুল নাচ, হরগৌরী পুতুল নাচ প্রভৃতি! তখন অবশ্য অরকেসটার এত প্রচলন হয় নি, অবশ্য মাঝে মাঝে মাঠে-ময়দানে পর্দা টাঙ্গিয়ে সিনেমার অনুষ্ঠান হতো। সাধারণত পৌষ মাসের ধান কাটার মৌসুম শেষ হলে মাঠে ময়দানে পুতুল নাচের আসর বসতো, মাত্র ১৯ পয়সার টিকিটে গ্রামের মানুষজন বিনোদনের স্বাদ গ্রহণ করত! রাজা হরিশচন্দ্র, বেহুলা-লক্ষিন্দর, সাবিত্রী সত্যবান ,সতী বেহুলা, রাধা কৃষ্ণ, ইত্যাদি কত রকমের যে পালা হত তা বলে শেষ করা যাবেনা। লক্ষনীয় বিষয় য সব পালাই ছিল শিক্ষা মূলক! বাংলার লোকসংস্কৃতি প্রায় সবটাই ছিল সমাজ শিক্ষা মূলক! তাই পালাগান নির্বাচন করা হতো গ্ৰামের মানুষের চাহিদার ভিত্তিতে!
.
স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্ৰাম সমাজে মূল্যবোধ যথেষ্ট জাগ্ৰত ছিল! দয়ামায়া প্রেম প্রীতি সহযোগিতা মানুষের মধ্যে যথেষ্ট দেখা যেতো! তখন দেখেছি রামযাত্রা,কেষ্টযাত্রা পুতুল নাচ প্রভুতি পেশাভিত্তিক দল গ্ৰামে আসর বাজতো, শুধু চাল ডাল সামান্য কিছু টাকার বিনিময়ে তারা বেশ কয়েকদিন ধরে পালা করতো, এক্ষেত্রে বকশিস ছিল উপরি পাওনা!আমি আটের দশকে দেখেছি নৌকাবিলাস পালা দেখে রাধা পিসি তার জমানো সারা বছরের টাকা পালাকার কে দান করেন! আসল কথা তখন গ্রামের মানুষেরা সমাজ সংস্কৃতি বিষয়ক পালাগান যথেষ্ট পছন্দ করতো! কিন্তু আজকে কীর্তন, বাউল ,নামসংকীতন ইত্যাদি শোনার লোক পাওয়া যায় না!
.
আজ সব অতীত! বলতে গেলে বিস্মৃতির অতল ছায়ায়, যেদিন থেকে বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির দাপাদাপি বেড়েছে, অর্থাৎ ঘরে ঘরে টিভি, পাশ্চাত্য সংস্কৃতির দাপাদাপি বেড়েছে, সেদিন থেকেই দেশীয় সংস্কৃতির অর্থাৎ লোকসংস্কৃতি সুর হারিয়ে গেছে। পুতুল নাচ রামযাত্রা কেষ্ট যাত্রা প্রভূতি লোকসংস্কৃতি হয়তো সাত তাড়াতাড়ি সমাজ সংস্কৃতি থেকে পাততাড়ি গোটাতে চলেছে!!
বারিদ বরন গুপ্ত