গাড়ী চলেছে আপন ছন্দে। আমি জানলারদিকে তাকিয়ে আছি মনের আনন্দে। ছোট বেলায় লোহার বেড়ি বা রিং তারের শিক দিয়ে যখন চালাতাম তখন আমাদের গন্তব্য পথে কাগজে লিখে সুবিধা সুযোগ মত রাস্তার পাশে নির্জনগাছে সেঁটে দিতাম–বর্ধমান, কলকাতা, পাঞ্জাব, দিল্লী, আগ্রা এইসব নাম। সেই অর্থে পাঁচ মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে যেতাম যে সব জায়গায় আজ সেই জায়গাগুলির মধ্যে বাস্তবিক এত দূরত্ব মনের মধ্যে সেই হারান শৈশবকে ঠেলে জাগাচ্ছে, বারবার ভারতবর্ষের ম্যাপটাকে চোখের সামনে দেখতে চাইছে।
বারবার। খাবলা খাবলা করে নয়। সামগ্রিক সুন্দর এবং কেন্দ্র ও রাজ্যগুলির সামগ্রিক সহাবস্থানের বর্তমান ভারতবর্ষকে দেখার লোভ। দেওয়ালে ঝুলে থাকা বই আর ডায়রির মধ্যে মুখলুকানো ভারতবর্ষের ম্যাপটাকে গুগল সার্চ করে দেখার লোভটা হচ্ছে এই কারণে জন্মভূমি গরীয়সী ভারতবর্ষের বিশালতা, পাহাড়, অরণ্য, নদী যাকে
নিয়ে একদিন লিখে ছিলাম—
রূপে যার মুগ্ধ আমি মাতৃপ্রতিমা
স্বচ্ছ আকাশ মুক্ত বাতাস বাড়ায় গরিমা–
উচ্চশির পাহাড় আছে স্নেহশীতল নদী
কোমল অঙ্গে শ্যামল বাস পরে নিরবধি
ও তার রূপের তোড়ে যায় যে উড়ে আঁধারকালিমা।
আমরা বেনারসকে পাশে রেখে প্রথমে এলাম আগ্রা। আগ্রা দূর্গ। যমুনা নদীর তীরে কত শাসক তাদের বহুদা বিস্তৃত শাসনের ডালিকে মাটির ধূলি আর নবাবী আমলের শিল্পশৈলীতে আমার মত আনকোড়া পর্যটকদের মনকেও উদাস করে চলেছে। ‘রক্ত মাখা অস্ত্র হাতে যত রক্ত আঁখি/শিশুপাঠ্য কাহিনীতে থাকে মুখ ঢাকি। ‘ যা দেখছি তাতেই আশ্চর্য হয়েদৃষ্টি চলে যাচ্ছে সুদূর ইতিহাসে। দেওয়ানী খাস, দেওয়ানী আম বলে পরিচিত এগুলোর কাছে পিঠে আম বা বট গাছ নেই। এখান থেকে মোগল সাম্রাজ্য সমগ্র ভারত বর্ষ শাসন করত।
ইন্টারনেট গুগল বেতার টেলিফোন দূরদর্শন মাইক না থাকার সেই যুগে সমগ্র ভারতবর্ষকে এক শাসনের ছাতায় আনার স্বপ্ন খোঁড়ামানুষটির উত্তরসুরীরা ভারতবর্ষের বাইরে থেকে এসে ইতিহাসের জীবন্ত ফমূর্লার বাবার হল আবার জ্বর সারল ঔষধে সফল করেছিল কি ভাবে। অতীত যেন আমার কানে কানে স্বষ্ট ভাষায় কথা বলছে। যে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছি সেই সিঁড়ি বেয়ে আমার উধ্বর্তন কোন পুরুষ কি এখানে পা রাখতে পারতেন।
আবার রবীন্দ্রনাথের বাণীতে আশ্রয় নিতে হয়। ‘কোথায় ভাসায়ে দেবে সাম্রাজ্যের দেশবেড়া জাল।’ বড় বড় খিলান। কারুকার্য বিজলীহীন সে যুগে শীতগ্রীষ্মে জীবনকে বিলাসিতায় মুড়ে রাখার আয়োজন সেই সময়ে সর্বাধুনিক ছিল। ছাদে জল রেখে প্রাসাদ শীতল রাখা হত। অপ্রয়োজনে ঐ জল সুন্দর নিকাশীযুক্ত নালার মধ্যদিয়ে যমুনায় পড়ত। বিচার সভার জায়গাটি মনোরম। ঘন্টাখানেক মতো এই দূর্গে থেকে কি আর হাজার বছরের ইতিহাসের খোরাক চেখে দেখা সম্ভব? চোরের মত একাএকা চলে এসে পঞ্চাশটাকা দর্শনী দিয়ে ইতিহাসের সঙ্গে এই হৃদ্যতা জমাতে গেলে দলছুট হবার ভয়।
সোমনাথ মন্দিরের ষোল বাই তেরো ফুটের কারুকাজ করা বিশাল দরজা লুন্খঠনকারী নাদির শাহের কবল থেকে এদেশে ফেরত আনা কী দুঃসাধ্য ব্যাপার! বাবাসোমনাথের ঐতিহাসিক দরজা যা লাখো লাখো ভক্তের সভক্তি প্রণামের সাক্ষী আজ মোগল হারামে বন্দী থেকে ছটফট করতে করতে ঝিমিয়ে পড়েছে। মন্দির হারা ঐ দরজার মত দলহারা হতে চাইনা বলেই আমি ছুটে এসে দলে ভিড়লাম, দেখলাম এখনও টিফিন রেডি হয়নি। পান্ডবেশ্বরের সৌখিন যুবক ভগীরথ বললে মাস্টার আগ্রা এলে অথচ তাজমহল লিলে না?
গাড়ী এখানে ধর্ম শালায় ঢোকার মুহূর্তে সদ্যঘুম ভাঙা চোখে হকারদের হাতে যার আশি /একশো টাকা দাম ছিল রোদ বাড়তে না বাড়তে কুড়ি টাকায় নেমে গেল। আমিও কিনলাম। ভিতরে জলটলমল করছে। তবে এই জল সাজাহানের প্রেমাশ্রুর প্রতীক কি? ভাবতে ভাবতে প্যাকেটে পুরে তাজমহলকে ব্যাগবন্দী করলাম।
( ক্রমশ:)