মনের ভিতরে একটা টান কোথাও না কোথাও ছিল। কিন্তু সুযোগটা হঠাৎ করে হাতের মুঠোয় ধরা দেবে তা জানা ছিল না। বিজয়াদশমীর দুদিনের মধ্যে হঠাৎ ফোন আসে টুরিস্টবাসে বৃন্দাবন যাওয়ার কয়েকটা সিট খালি আছে। আমি দুর্গাপুজোয় শ্বশুরবাড়ীতে ছিলাম।
পুজোর পরে ধানজমি পরিদর্শন সেরে নাকে মুখে দুপুরের ভাত কটি খেয়ে রাধে রাধে বলে বেড়িয়ে পড়লাম। পুত্র রামকৃষ্ণ বাসস্ট্যান্ড অবধি পৌঁছে দিল। পুত্রের উচ্চ মাধ্যমিক আসন্ন তাই মা ও ছেলে আটকে গেল সাতপুরুষের ভিটেতে। আমি মুক্ত বিহঙ্গের মত পারাজ পেরিয়ে পশ্চিম মুখে চললাম। অণ্ডাল মোড়ে বাসে চাপলাম যখন তখন সাড়ে আটটা।
ঘাঘর বুড়িমায়ের মন্দিরের কাছে বাস যাত্রীদের
নৈশকালীন আহার প্রস্তুত হল। কেউ ভাত কেউ রুটি খেল। পশ্চিমবর্ধমানের এখানে তীর্থযাত্রীদের জন্য রান্নাখাওয়ার ব্যবস্থা মন্দ নয়। খাওয়া দাওয়ার পর জিনিস পত্র গোছগাছ ও বাসন কড়াই খোওয়া সারা হলে আমরা বাসে উঠলাম – মা কল্যাণেশ্বরীকে শরণ করে। রাতের গভীরে অন্ধকারের বুকচিরে রকেটের বেগে চলেছে ৬২জনের টিমকে নিয়ে আমাদের এই বাস।
বৃন্দাবনের পথে চলেছি যেন রথে উৎসাহ আর উদ্দীপনায় বিস্ফোরিত চোখে কাজলের মত গভীর ঘুম এঁকেদিয়েছেন নিদ্রাদেবী। যখন ঘুম ভাঙল তখন আমরা পৌঁছে গেছি গয়ায়। এখানকার মা জানকীর শাপে অন্তসলিলা ফল্গুনদীর জল মাথায় নিলাম। নদীর বানানো পাড়ে পাকা ছাউনীর নীচে উত্তর পুরুষ পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে পিন্ডদান করছে লাইন দিয়ে।
পিণ্ডদানের শেষে পাণ্ডার পাওনা দানসামগ্রী ফেরৎ যাচ্ছে দোকানে। আবার সেগুলি ফেরৎ আসছে একই কাজে। মানুষ পূর্ব পুরুষদের আত্মার শান্তির জন্য ভক্তিবিনম্রচিত্তে মস্তকমুণ্ডন করছে। পিতা জগন্নাথগোস্বামীর উদ্দেশ্যে পিণ্ডদান করতে এসে এখানকার যে বিষ্ণুপাদ মন্দির দর্শন করে আমূল বদলে গিয়ে পাপীতাপী মানুষদের সুরাহা উদ্দেশ্যে সর্বত্যাগিসন্ন্যাসী হয়ে নিমাই শ্রীচৈতন্যমহাপ্রভু হয়ে ছিলেন। সেই বিষ্ণুপাদ মন্দির দর্শন করে প্রণাম করে মনেমনে বললাম ভগবান তুমি কত লীলাই না জান।
সেদিনের সেই প্রভু অথচ মূঢ় আমি তোমার গম্বুজ মন্দিরের জাঁকজমকে আমাকে ভোলাচ্ছ? ভবি ভুলিবার নয়। এই কথার মাঝে ঐ ভবিরা তো কোটিতে গুটি থাকেন। ইতি মধ্যে মোবাইল বিগড়োল। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। সুন্দর দৃশ্য দেখার জন্য তাকে ক্যামেরা বন্দীকরে ধরে রাখার হ্যাপা থেকে বাঁচা গেল। স্নান সেরে যেখান থেকে হেঁটে যাত্রা শুরু করেছিলাম। সেখানে ফেরার সময় একা হয়ে পথ হারিয়ে ফেললাম। ঝাঁকের কৈ ঝাঁকে ফিরতে একটু কষ্ট হল। আমার হিন্দী বলার দুর্বলতাকে সাক্ষী করে বাসায় যখন ফিরলাম তখন দুপুরের খাওয়া শুরু হয়েছে সবে। তবে একক হওয়ার আনন্দ বেশ পেয়েছি।
এখানকার যে পাহাড় রয়েছে তার একটাতে আমি একাই চড়েছি। বিজয়কৃষ্ণগোস্বামী যেখানে দীক্ষাদিতেন সেখানে পৌঁছেনীচের দিকে তাকিয়ে মানুষ জন বাড়ী ঘরবাস লরী গুলোকে খুবই ছোট লাগছিল। গয়া যে হিন্দুদের কাছে একটি পবিত্র নাম তা দূরদূরান্তের পুণ্যার্থীদের সমাগমে বেশ স্পষ্ট হল। ভগবান বিষ্ণুর পাদপদ্মে সভক্তি প্রণাম জানিয়ে আমরা বাসে চড়লাম। আমাদের গাড়ি চলতে লাগল। ততক্ষণে জেনেগেছি উত্তর ভারত আমাদের গন্তব্য তালিকায়।
ঘরকুণো মানুষ আমি সখ আহ্লাদ কম বলে বাড়ীতে অভিযোগ শুনতে হয়। মাধ্যমিকপরীক্ষা দেওয়ার বছরে মুর্শিদাবাদে চলন্তিকা পত্রিকার রজত জয়ন্তী উপলক্ষে সারাবাংলা সাহিত্য সম্মেলনে আহুত হয়ে একা একাই বাড়ি থেকে বেড়িয়ে ছিলাম। আজ আবার একা বেড়িয়ে ছি তবে রাজ্যের বাইরে। জানলা দিয়ে চোখ মেলে নতুন জায়গার সৌন্দর্য অনুভবের আগে জায়গাটা নাম জানার আগ্রহ অনেক আগেই ফুরিয়েছে।
এখন চট করে কোনকিছু পড়ার আগেই ঐ পোষ্টার দ্রুত চোখের বাইরে হারিয়ে যাচ্ছে। বাংলার গন্ধ নেই। ইংরাজি ও কম। অধভ্যস্ত হিন্দী পড়ার চোখে পাঞ্জাবী ও অন্যান্য ভাষার কারুকাজ বেদম ঝামেলায় ফেলেছে। ভাষার বাসা থেকে স্বস্তির সস্তা আনন্দ পাওয়ার ঝামেলায় আটকে থাকার বোকামীতে মন গলায় নি। আমার যেন এই গাড়ী চলাতেই আনন্দ। দিল্লী ঢোকার পথে ধানের ক্ষেত দেখে গলসীর কলমচির খুব আনন্দ হল।
স্বর্ণধান কালচে পাতার ছাউনির দিকে শিষের মাথা ফুঁড়ছে। যে সব জমিতে আলুটালু লাগানো হবে সেই সব মাঠে ধান পেকে মাথা নিয়ে চাষীকে ডাকছে।
বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামছে তাই তাড়াতাড়ি করে মন্দির দেখতে দলে দলে ভাগ হয়ে টোটোয় চড়েবসলাম। ও হো জায়গাটা নাম তো বলিনি।
বুদ্ধগয়া। ভগবান বুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত বুদ্ধগয়া। বিশ্বজুড়ে অহিংসাকে হাতিয়ার করে যে লড়াই তিনি করেছিলেন :ক্রোধকে অক্রোধ দিয়ে, হিংসাকে অহিংসাদিয়ে লড়াইয়ের যে রসদ তিনি জুগিয়েছিলেন মানবতার ইতিহাসে আজও তার প্রাসঙ্গিকতা কমে নি তা এখানে না এলে জানা যেত না। বিশ্ববাসীর আইকন এই বুদ্ধ গয়া। ভগবান বুদ্ধূর বিশাল মূর্তির সামনে আমরা কজন ছবি তুললাম। দু একটা মন্দির দর্শন করে এবার আমরা মূলমন্দিরের দিকে চললাম।
পুলিশের খানাতল্লাশির পর এক শান্ত সৌম্য ও সুন্দর সন্ন্যাসীর সঙ্গে কথা বলতে বলতে সবুজ কার্পেট বিছানোপথে হাঁটতে লাগলাম। বৌদ্ধভক্তের দল শালুকফুলের গুচ্ছ নিয়ে চলেছেন। ভগবান বুদ্ধের সোনারবরণ মূর্তিদর্শন করে মন্দির প্রদক্ষিণ করছি।
গম্ভীর কন্ঠে মন্ত্র উচ্চারিত হচ্ছে। ভক্ত ও সন্ন্যাসীর দল মহাবোধি বৃক্ষকে ঘিরে বসেছেন ভগবান বুদ্ধের সান্ধ্য বন্দনায়। প্রাচীর দিয়ে ঘেরা এই মন্দিরের পাশের পুকূরে রয়েছে কত বড় বড় মাগুর মাছ। অগুনতি এই মাঝের ঝাঁক বুদ্ধের আশ্রয় থেকে মৃত্যুর ভয় ভুলেছে।
ক্রমশ: