গল্প – মধুর প্রতিশোধ
*******************
গল্পকার – অসিত কুমার পাল
সেঁজুতি আর সদানন্দ একই কলেজে একই সাবজেক্ট নিয়ে পড়াশোনা করত, এমনকি একই প্রফেসরের কাছে প্রাইভেটে টিউশন নিত । সেই সূত্রে তাদের মধ্যে অন্তরঙ্গতা গড়ে উঠেছিল । কলেজের পাঠ শেষ হলেও তাদের পারস্পরিক যোগাযোগ ছিন্ন হল না বরং তাদের দুজনেরই মনে হতে লাগল তারা একে অপরের প্রেমে পড়ে গেছে । ফলে তারা সময় সুযোগ অনুযায়ী দেখা করত আর নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা করত ।
সদানন্দ গ্রামের নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে । কয়েক বছর আগে তার বাবা মাঠে কাজ করার সময় বজ্রপাতে মারা গিয়েছিল । তার মা মজুরের সাহায্যে বিঘে তিনেক জমিতে সব্জি চাষ করে সংসারটা বাঁচিয়ে রেখেছেন । তার ইচ্ছা ছিল সদানন্দ একটা চাকরি জোগাড় করে সংসারের হাল ধরবে । অন্যদিকে সেঁজুতির বাবা শহরতলীর একটি প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক । সেঁজুতি আরো পড়াশোনা করতে চাইলেও তার বাবামা যথাশীঘ্র মেয়ের দিয়ে দিতে চাইছিল । সেজন্য তারা উপযুক্ত পাত্রের জন্য খোঁজখবরও শুরু করেছিল ।
বছর খানেকের মধ্যেই এক আত্মীয়ের সুপারিশে সদানন্দ একটি বেসরকারি সংস্থায় চাকরি পেয়ে গেল । তারপরে সদানন্দের মা ছেলের জন্য পাত্রী খুঁজতে আরম্ভ করল । প্রায় সেই সময়েই সেঁজুতির বাবামাও তাদের মেয়ের জন্য একজন ইঞ্জিনিয়ার পাত্র জোগাড় করে ফেলল । সদানন্দ ও সেঁজুতি দুজনেই জানত তারা বিয়ে করতে চাইলে তাদের কারোরই অভিভাবক সেটা সহজে মেনে নেবে না । কিন্তু বিয়েটা একবার হয়ে গেলে তারা সেটাকে মেনে নিতে বাধ্য হবে ।
এমনটা ভেবেই সদানন্দ ও সেঁজুতি একদিন নিজের নিজের বাড়িতে কিছু না জানিয়ে ম্যারেজ রেজিষ্টারের অফিসে গিয়ে বিয়ে করে নিল । তারপরে সদানন্দ সেঁজুতির হাত ধরে মায়ের সামনে উপস্থিত হল । ছেলে অপেক্ষাকৃত নিচু জাতের একটি মেয়েকে বিয়ে করেছে শুনে সদানন্দের মা ভীষন রেগে গেলেন এবং জানিয়ে দিলেন ছেলের বউ হিসেবে তিনি সেঁজুতিকে বাড়িতে ঢুকতেই দেবেন না ।
বাধ্য হয়ে সেঁজুতিকে নিয়ে সদানন্দ বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে এসে শহরতলিতে একটি এককামরার ঘর ভাড়া করে সংসার পাতল । দুজনের ভালোবাসার ছোঁয়ায় তাদের ছোট্ট নীড়টি প্রাণ পেল । বছর ঘুরতে না ঘুরতে তাদের সংসারে একটি ফুটফুটে শিশুকন্যার আগমন ঘটল। সদানন্দ তার মায়ের সাথে কোন যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করল না , সদানন্দের মাও ছেলের কোন খোঁজখবর করল না । অন্যদিকে সেঁজুতি বাড়ির অমতে বিয়ে করায় তার বাবামাও মেয়ের সাথে সম্পর্ক রাখেনি , সেঁজুতি মনে কষ্ট পেলেও কোনদিন তার বাবামায়ের সাথে যোগাযোগ করেনি ।
কিন্তু বিধাতা বোধ হয় তাদের জীবনে স্থায়ী সুখের বিধান রাখেননি । বিয়ের বছর পাঁচেক পরে সদানন্দ একদিন গায়ে জ্বর নিয়ে অফিস থেকে ফিরল । সেঁজুতি স্থানীয় ডাক্তারকে ডেকে ওষুধপথ্যের ব্যবস্থা করল । কিন্তু তিনচার দিনের পরেও জ্বর নামল না দেখে সদানন্দকে একটি সরকারী হাদপাতালে ভর্তি করা হল ।
পরীক্ষায় জানা গেল সদানন্দ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে । চিকিৎসা চললেও তিনদিন পরে সদানন্দ মারা গেল । সেঁজুতির মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল । বুকে পাথর রেখে সে প্রতিবেশীদের সাহায্য নিয়ে সদানন্দের পারলৌকিক কাজ সারল । এই বিপদের দিনেও সে সাহায্যের জন্য নিজের বাবা মা বা শাশুড়ির কাছে হাত পাতল না ।
এর পরে চার বছরের মেয়েকে নিয়ে সেঁজুতির জীবন সংগ্রাম শুরু হল । প্রথমেই সে সদানন্দের সহকর্মীদের সহযোগীতায় তার পূর্বতন সংস্থায় যোগাযোগ করল । কিন্তু কর্তৃপক্ষ চল্লিশ হাজার টাকা দিয়েই তাদের দায় সারল , সদানন্দের পরিবর্তে সেঁজুতিকে চাকরি দিতে অস্বীকার করল । সেঁজুতি একটা চাকরির জন্য হন্যে হয়ে এখানে ওখানে ঘোরাঘুরি করতে লাগল , কিন্তু কোন সুরাহা মিলল না । এদিকে হাতেও খুব বেশি টাকা নেই ।
অবশেষে সেঁজুতি স্থানীয় এক নার্সিং হোমে আয়ার কাজ পেযে গেল । এক নিঃসন্তান প্রতিবেশী মেয়ে বীথিকে খুব ভালবাসত , মেয়েকে দেখাশোনার জন্য তাদের কাছে রেখে নার্সিং হোমে রোগীর সেবা করতে লাগল । দুবছর পরে মেয়েকে বাসার কাছেই একটি স্কুলে ভর্তি করে দিল । সকালে মেয়েকে তৈরি করে নিজেই স্কুলে পৌঁছে দিত আর স্কুল ছুটি হলে কিছুক্ষনের জন্য নার্সিং হোম থেকে ছুটি নিয়ে মেয়েকে প্রতিবেশীর বাড়িতে পৌঁছে দিত ।
নার্সিং হোম থেকে ছুটির পরে মেয়েকে নিয়ে বাড়ি ফিরত । ঐকান্তিক নিষ্ঠার জোরে সেঁজুতি নার্সিংহোমের ডাক্তার ও রোগীদের মন জয় করে নিল । ধীরে ধীরে সে নার্সিং এর কাজটাও শিখে নিল । তার কাজে খুশি হয়ে নার্সিং হোমের মালিক ডা. রায় তাকে নার্সিং স্টাফ হিসাবে নিয়োগ করল । ফলে তার বেতন অনেকটাই বেড়ে গেল ।
এইভাবে বছর দশেক কেটে গেল । সেঁজুতি এখন নার্সিং হোমের হেড নার্স । তার মেয়ে এখন একটা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের অষ্টম শ্রেণীতে পড়ে । নিজের বাবার বাড়ি ও শ্বশুর বাড়িতে অপাংক্তেয় হয়ে এবং একমাত্র অবলম্বন স্বামীকে অকালে সেঁজুতি যে জীবনসংগ্রাম শুরু করেছিল , তাতে সে জয়ী হয়েছে ।
এইসময়ে একদিন সেই নার্সিং হোমে সঙ্কটজনক অবস্থায় এক রোগিনী ভর্তি হল । ভদ্রমহিলার বয়স চল্লিশের আশপাশে, স্বামী সন্তান নেই । ঝি চাকরের ভরসায় একাই থাকেন । সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় ওঠার সময়ে বুকে ব্যথা অনুভব করেন , ঝি চাকরাই তাকে নার্সিং হোমে নিয়ে এসেছে ।
ভদ্রমহিলাকে দেখেই সেঁজুতি চিনতে পারল উনি সদানন্দের মা , সেঁজুতির শাশুড়ি , যিনি নিজের অমতে বিয়ে করার অপরাধে ছেলে ও তার নববিবাহিতা স্ত্রীকে বাড়িতে ঢুকতে দেননি । ভদ্রমহিলা পরবর্তী দশ বছরে একবারও ছেলে বা বৌমার কোন খোঁজখবর নেননি । সেই শাশুড়ি এখন সংজ্ঞাহীন অবস্থায় তারই সেবাযত্ন পাওয়ার প্রত্যাশী ।
সেঁজুতি দোটানায় পড়ে গেল । এতদিন তার উপরে যে অবিচার চলেছে , তার প্রতিশোধ নেওয়ার সুযোগ এখন তার সামনে । সে কি প্রতিশোধ নিয়ে মৃতপ্রায় শাশুড়িকে মৃত্যুর দিকেই ঠেলে দেবে ? নাকি একজন নার্স হিসাবে রোগীকে সুস্থ করে তোলার চেষ্টা করবে ? বেশ কিছুক্ষণ ধরে তার মনে টানাপোড়েন চলল ।
শেষ পর্যন্ত শুভবুদ্ধিরই জয় হল । ভদ্রমহিলা তার প্রতি যে ব্যবহার করেছেন তা নিঃসন্দেহে নিন্দনীয় , কিন্তু সে যদি একজন রোগিনীকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয় সেটাও তো আরও বেশি নিন্দনীয় এবং অপরাধও বটে । রোগীনির সাথে তার সম্পর্কের কথা জানতে না দিয়েও সেঁজুতি ডা . রায়কে অনুরোধ করল তিনি যে তার প্রতি বিশেষ খেয়াল রাখেন । সেঁজুতি নিজেও মনপ্রাণ ঢেলে তার সেবা করতে লাগল । এমনকি সেজন্য সে অন্য রোগীদের প্রতি কিছুটা অবহেলাও দেখাল ।
তিন তিনেক পরে রোগিনী চোখ মেললেন , কিন্তু আচ্ছন্ন থাকায় সেঁজুতিকে চিনতে পারলেন না । আরো দুদিন পরে তিনি আচ্ছন্ন ভাব কাটিয়ে ওঠার পরে নার্সের পোশাক পরা সেঁজুতিকে দেখে নিজের বৌমা হিসাবে চিনতে পারলেন । তিনি বুঝতে পারলেন নিজের বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া বৌমাই একদিন সেবাশুশ্রূষা করে তাকে সুস্থ করে তুলেছে । তিনি সেঁজুতির হাতে নিজের হাত রাখলেন , মুখে কিছু না বললেও তার চোখের কোন দিয়ে দুফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল ।
😢😢😢😢😢😢
আমার লেখাটি publish করার জন্য Stories and Articles কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ জানাই । লেখাটি সম্পর্কে পাঠকের যে কোন মতামত গুরুত্বের সঙ্গে গৃহীত হবে ।