সম্পর্ক /
অসীম কুমার চট্টোপাধ্যায় /
আবার বিয়ের পিঁড়িতে বসলেন রামকৃষ্ণ বাবু । ছেলে রামানুজের সৎ মা ঘরে এলো । দুর্ভাগ্য রামানুজের । সৎ মা তাকে মেনে নিতে পারলো না । বিয়ের আগে মেয়েটির গুনের কথা যত শুনেছিলেন রামকৃষ্ণ বাবু ,বিয়ের পরে দেখলেন সবই মিথ্যা । শুধু মাত্র দ্বিতীয়বার বিয়ে করছেন বলে লজ্জায় তিনি মেয়ে দেখতে যান নি । ছেলের কথা ভেবেই তিনি সম্মতি দিয়ে ছিলেন । বাস্তবে তা ঘটলো না । রামানুজের ওপর তার সৎ মা পার্বতী সব সময় খর্গ হস্ত ।
জীবনের নিয়ম মেনে ঘরে এসে গেল নতুন অতিথি । পার্বতীর ছেলে হয়েছে । ছেলে এবং মায়ের দেখাশুনোর জন্য একজন মহিলা রাখলেন রামকৃষ্ণ বাবু । রান্না ঘরটা নিজেই সামলাতেন । দেখতে দেখতে বছর ঘুরে এলো । মা এবং মেয়ে দুজনেই সুস্থ । কিন্তু পার্বতী রান্না ঘরের দিকে পা বাড়ায় না ।
একদিন বাধ্য হয়ে রামকৃষ্ণ বাবু স্ত্রীকে বললেন , এখন থেকে তুমি রান্নাঘরটা সামলাও । আমার পক্ষে তো আর সম্ভব হচ্ছে না ।
স্ত্রী পার্বতীর সোজা উত্তর , আমি পারবো না । তোমাদের গুষ্টির জন্য রান্না করা আমার কম্ম নয় ।
সে কি কথা ? তাহলে রান্না করবে কে ? অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন রামকৃষ্ণ বাবু ।
তার আমি কি জানি ? ঝংকার দিয়ে উঠলেন পার্বতী । তোমার সংসার তুমি বুঝে নাও । খাওয়াতে না পারলে বলে দিও আমি বাপের বাড়ি চলে যাবো । এখনো আমার বাবা মা আছে । খাওয়া পরার অভাব হবে না ।
রামকৃষ্ণ বাবুর পক্ষে রান্না করা অসম্ভব । তার স্কুল আর প্রাইভেট টিউশনেই সময় চলে যায় । রান্না করবেন কখন ? কলকাতা শহরে কাজের মহিলা মানে রান্নার জন্য মহিলা পাওয়া যায় কিন্তু তাদের চাহিদা প্রচুর । তাও দুবেলা আসবে না । এক বেলায় সব করে দিয়ে যাবে । তাতে সমস্যার সমাধান হবে না । তাছাড়া তার পক্ষে এত টাকা দেওয়া সম্ভব নয় ।
জলপাইগুড়িতে ছোট ভাই থাকে । তাকে জানালেন তার সমস্যার কথা । এক রোববার ভাই এলো । সাথে নিয়ে এলো একটি অল্প বয়সী ছেলে । ছেলেটির বাবা ছুতোর মিস্ত্রি । অনেকগুলো ভাই বোন । অভাবের সংসার । পয়সা কড়ি লাগবে না । দুবেলা খাওয়া পরা পেলেই হবে ।
রাজি হয়ে গেলেন রামকৃষ্ণ বাবু ।
স্ত্রীকে বললেন, ভাই এসেছে একটি কাজের ছেলেকে নিয়ে । কিন্তু ছেলেটি বড্ড ছোট । ও কি পারবে সব কাজ করতে ?
ঘরের ভেতর থেকেই পার্বতী বললেন, ওরা সব পারে । তোমাকে অত ভাবতে হবে না ।
ছেলেটির নাম বিষ্ণু । মুখশ্রীটা সুন্দর । রংটাও ফর্সা । সব সময় মুখে হাসি ঝুলে আছে ।
বিষ্ণু বলল, আমাকে রান্না ঘরটা দেখিয়ে দিন । আমি আপনাদের জন্য একটু চা বানিয়ে আনি ।
সেই থেকে রয়ে গেল বিষ্ণু । বাড়ির সমস্ত কাজ একা হাতে সামলায় । দোকান , বাজার , রান্না ঘর সামলানো , জামা কাপড় কাচা , ইস্ত্রি করা সবেতেই আছে বিষ্ণু । রামকৃষ্ণ বাবুর বড্ড মায়া পড়ে গেছে ছেলেটার ওপর । পার্বতীর দৃষ্টি ভঙ্গির কোন পরিবর্তন হয় নি । বিষ্ণু কে চাকর ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে পারেন না । তাতে অবশ্য বিষ্ণুর এত টুকু দুঃখ নেই ।
মনে মনে সে বলে , আমি তো কাজের লোক । কাজ করি বলেই না আমাকে থাকতে দিয়েছে , খেতে দেয় । এই না যথেষ্ট । তাড়িয়ে দিলে কোথায় যাবো ? বাড়িতেও বকা খেতাম । এখানে ও তাই খাচ্ছি । বকে তো শুধু জেঠিমা । জ্যেঠু খুব ভালোবাসে । মনে হয় আমি যেন জ্যেঠুর ছেলে । ভাইটাও খুব ভালো । সব সময় আমাকে বিষ্ণুদা , বিষ্ণু দা বলে ডাকে । তার যত আবদার আমার কাছে । ভাইকে স্কুলে দিয়ে আসা ,নিয়ে আসা সবই আমি করি । প্রথম দিকে জেঠিমা আমাকে বিশ্বাস করতো না । ভাইকে কিছুতেই ছাড়তো না আমার সাথে । এখন ছাড়ে । বলে , সাবধানে যাবি বিষ্ণু । ভাইয়ের হাত একদম ছাড়বি না । স্কুলের ভেতরে ঢুকিয়ে বাইরে বসে থাকবি ।
বিষ্ণু ভাবে আচ্ছা, এসব কি বলার কিছু ? সে কি এসব জানে না ? ভাইয়ের গায়ে সে এতটুকু আঁচড় লাগতে দেবে না ।
তবে বিষ্ণুর খারাপ লাগে বড়দার জন্য । দাদাটা খুব ভালো । কি ভালো ব্যবহার । বাড়ির সবার দিকে নজর । বিষ্ণু যে বাড়ির কাজের ছেলে দাদার আচরণে তা বোঝা যায় না । সে বলে ,আমরা তিন ভাই । কিন্তু জেঠিমা দাদার সাথে খুব খারাপ ব্যবহার করে । সব সময় গাল মন্দ করবে । দূরছাই দূরছাই করবে । দোষ না করেও দাদা বকা খায় । দাদা লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদে ।বিষ্ণু র খারাপ লাগে ।
পড়াশুনো শেষ করার পরেই রামানুজ চাকরি পেয়ে গেল । খুব ভালো চাকরি । অনেক টাকা মাইনে । চাকরি পাবার বছর খানেক বাদেই রামকৃষ্ণ বাবু ছেলের বিয়ে দিলেন । উর্মি মেয়েটি খুব ভালো । রামানুজের পছন্দ । একই অফিসে চাকরি করে দুজনে । বিষ্ণুকে খুব ভালো লেগে গেছে উর্মির । দেওর কার্তিককে যেমন স্নেহ করে বিষ্ণুকেও কিছু কম ভালোবাসে না । অফিস থেকে আসার সময় উর্মি প্রতিদিন কিছু না কিছু কিনে আনবে ।
বাড়িতে ঢুকেই বলবে , বিষ্ণু , আমরা হাত মুখ ধুয়ে আসছি খাবারগুলো সবার জন্য ভাগ কর ।
বিষ্ণু সবার জন্য খাবার প্লেটে প্লেটে ভাগ করে টেবিলে রাখে ।
উর্মি বলবে , তোর কোথায় ?
বিষ্ণু চুপ করে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে । উর্মি বুঝতে পারে । ডাকে বিষ্ণুকে । নিজের প্লেট থেকে খাইয়ে দেয় ।
বলে , এরপর থেকে যদি তোর জন্য না রাখিস তাহলে আর কিছু আনবো না বলে রাখলাম ।
বিষ্ণু চোখ মুছে চলে যায় রান্নাঘরে । চা বানিয়ে আনে । সবাইকে দেয় । নিজে নেয় না । এঁটো প্লেটগুলো নিয়ে চলে যায় সিঙ্কে ।
আবার উর্মির ডাক ।
বিষ্ণু , তোমার চা কোথায় ?
চুপ করে থাকে বিষ্ণু । পায়ের বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে মেঝে ঘষতে থাকে ।
কার্তিক বলে দেয় ।
বৌদি , মা বিষ্ণুদাকে বলেছে , তুই কাজের লোক ,কাজের লোকের মত থাকবি । তোকে ডাকলেই তুই যাবি কেন ? ভুলে যাবি না যে তোরা ছোটোলোক । এক টেবিলে বসে খাবার সাহস হয় কোথা থেকে ?
মা আরো বলেছে যে মা জানে কার প্রশ্রয়ে বিষ্ণুর এতো বাড় হয়েছে । মা চুপ করে আছে বলে সে যেন না ভাবে যে মা কিছু দেখছে না । সময় এলে তাকে ঘাড় ধরে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেবে ।
উর্মি কার্তিকের কথার কোন উত্তর দেয় না । শাশুড়ি যে তার উদ্দেশ্যে কথাগুলো বলেছে সেটা সে ভালোভাবেই জানে । চুপচাপ চায়ের কাপটা নিয়ে নিজের ঘরে চলে যায় । উর্মিকে অনুসরণ করে রামানুজও চলে আসে ।
প্রথম থেকেই রামকৃষ্ণ বাবু পার্বতীর মুখের ওপরে কথা বলতে পারেন নি । সবটাই তাকে সহ্য করতে হয় । কিন্তু এখন বয়স হয়েছে । শরীরে রোগ দানা বেঁধেছে । এখন আর পারেন না । দেখতে দেখতে অসুস্থ হয়ে পড়লেন । নিয়ে যাওয়া হল হাসপাতালে । বেশি দিন বাঁচেন নি ।
মৃত্যু শয্যায় শুয়ে বড় ছেলেকে বলে ছিলেন, বাবা , তুই আমাকে ক্ষমা করিস । তোর প্রতি যে অন্যায় হয়েছে তার জন্য আমি দায়ী । আমি বাবা হওয়ার যোগ্য না ।
কেঁদে ফেলেছিল রামানুজ ।
বলেছিল , তোমার মত বাবা পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার । তোমার জন্য আমি কিছুই করতে পারলাম না । যদি পরের জন্ম বলে কিছু থাকে তাহলে আবার তুমি আমার বাবা হবে ।আমি তোমার ছেলে ।
এরপর রামকৃষ্ণ বাবু কার্তিক কে কাছে ডাকলেন ।
বললেন , বাবা কার্তিক , বিষ্ণুকে দেখিস বাবা । ওকে সব সময় নিজের দাদা ভাববি । কোন অবস্থাতেই ওকে বাড়ি ছাড়া করবি না । বিষ্ণু বড্ড ভালো ছেলে । জানবি আজ তোরা যা হয়েছিস তার পেছনে বিষ্ণুর অবদান প্রচুর । সময় মত সংসারের হাল বিষ্ণু যদি না ধরতো তাহলে সংসারটাই ভেসে যেত ।
তারপর বিষ্ণুকে বললেন , বাবা , তোর হাতে কার্তিককে দিয়ে গেলাম । তুই ওকে দেখিস ।
বিষ্ণু বলেছিল , এসব কথা কেন বলছ জ্যেঠু ? তুমি ভালো হয়ে উঠবে । তোমাকে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যাবো ।
আর মনে হয় ভালো হবে না রে বিষ্ণু । আমি বুঝতে পারছি আমার সময় ঘনিয়ে এসেছে ।
সেই রাত্রেই মারা গেলেন রামকৃষ্ণ বাবু ।
শ্রাদ্ধ সংক্রান্তি মিটে যাবার পর থেকেই অশান্তি শুরু করলেন পার্বতী ।
কথায় কথায় বলতেন, একমাত্র কার্তিক আমার নিজের । আর সব শত্তুর । একটাকেও বিশ্বাস করি না । বেয়াদপি করলেই ঘাড় ধাক্কা দিয়ে তাড়াবো ।
তাকে আর তাড়াতে হয় নি । রামানুজ আর উর্মি নিজের থেকেই চলে গেল বাড়ি ছেড়ে ।
রামানুজ আর উর্মি বাড়ি ছাড়তে চায় নি । রামানুজ জানে বাবার পেনশন এখন অর্ধেক হয়ে গেছে । ভাইয়ের কোনো চাকরি হয় নি । তিন জন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের সংসার চলবে কিভাবে ?
কিন্তু তার সৎ মা তাকে বলে দিয়েছে যে তার এবং তার স্ত্রীর টাকা গ্রহণ করার আগে যেন তার মৃত্যু হয় । কাউকে দয়া দেখাতে হবে না ।
লুকিয়ে লুকিয়ে ভাইকে আর বিষ্ণুকে বলে গেল রামানুজ , সময় পেলেই চলে আসবি । যখন যা দরকার আমাদের বলবি । জানবি তোদের দাদা বৌদি আছে । ভাগ্যে নেই তাই একসাথে থাকা হল না । তোরা সাবধানে থাকিস । ভালো থাকিস ।
বিষ্ণুর মনে হল তার মাথার ওপর থেকে একটা ছাতা সরে গেল । ভাই আছে বটে তবে সে নিজে কতদিন থাকতে পারবে জানে না । জেঠিমার কড়া নজরে রান্না যা হয় তাতে তিন জনের ভালোমত হয় না । প্রায় দিনই বিষ্ণুকে না খেয়ে থাকতে হয় । কার্তিক কিছু জানে না । সে জানে যা রান্না হয় তা তিন জনে মিলে খায় ।
দীর্ঘ বছরে পাড়ার অনেক মানুষের সাথেই বিষ্ণুর পরিচয় । সকলেই ভালোবাসে তাকে । যখনই কারোর বিপদের কথা শোনে ছুটে যায় । সাহায্য করতে এতটুকু দ্বিধা করে না । অনেকেই বলে ,
বিষ্ণু, তোর মত একটা ছেলে পেলে কি ভালো হত । কাজ করবি আমাদের বাড়িতে ? এক হাজার টাকা মাইনে দেব ।
মনে মনে হাসে বিষ্ণু । টাকা ! আজ পর্যন্ত সে একটা টাকাও নেয় নি । টাকার কথা সে কখনো ভাবেই নি । এটা তো তার বাড়ি । জ্যেঠু , বড়দা , বৌদি ,ভাই সকলেই তার অতি আপনার জন ।
নিজের বাড়িতে কাজ করে কেউ টাকা নেয় নাকি ? তাকে যে সবাই এত ভালোবাসে তার কোন দাম নেই ? আজ জ্যেঠু নেই । বড়দা ,বৌদি চলে গেছে । ভাই এখনো চাকরি পায় নি । এই সময় তাকে তো থাকতেই হবে । সে তো আর অকৃতজ্ঞ নয় যে নিজের সুবিধার জন্য চলে যাবে । গরিবের ছেলে । না খাওয়া অভ্যাস আছে । সবাইতো সমান হয় না । জেঠিমা ওই রকম । কি করা যাবে ?
হঠাৎ একটা বুদ্ধি খেলে গেল বিষ্ণুর মাথায় । এই সমস্ত লোকগুলো তাকে তো ভালোবাসে । তাকে একটা কাজ দিতে চায় । এদেরকে ভাইয়ের কথা বললে কেমন হয় ? ভাইয়ের একটা চাকরি খুব দরকার । বেচারা সব সময় মন মরা হয়ে থাকে । আজকাল কয়েকটা টিউশন করে অবশ্য । হাতে গোনা কটা মাত্র ছেলে মেয়ে । ক’টাকা আর হয় ? ভাইটা পড়াশোনায় এত ভালো অথচ কোনো চাকরি পেলো না ।
খুব সাবধানে ভাইয়ের কানে যেন না যায় সেই ভাবে বিষ্ণু এক এক করে পরিচিতদের ভাইয়ের একটা চাকরির জন্য বলতে লাগলো ।এইভাবে বলতে বলতেই এক জনের সাথে যোগাযোগ হল । তিনি পরিচয় করিয়ে দিলেন পার্টির এক স্থানীয় নেতার সাথে । সেই নেতা বিষ্ণুকে আগে দেখেছেন । পরিচয় ছিল না ।
বললেন , সত্যি বিষ্ণু , আমার কাছে সবাই নিজের জন্য আসে । একমাত্র তুমি ব্যতিক্রম । শোনো , আমি তোমার ভাইয়ের জন্য চেষ্টা করবো । কিন্তু একটা কথা বলি । তোমার ভাইয়ের এখন চাকরি নেই । এরপর চাকরি হবে । তারপর বিয়ে করবে । তার সংসার হবে । সেখানে যদি তোমাকে না রাখে তখন তুমি কি করবে ?
অবাক হয়ে গেল বিষ্ণু ।
বলল , কি বলছেন স্যার ? আমার ভাইকে আপনি চেনেন না তাই এই কথা বলতে পারলেন । খুব ভালো ছেলে । আমাকে ভীষণ ভালোবাসে । ছোটোর থেকে ওকে আমি এই দুহাত দিয়ে বড় করেছি । ও আমার খুব আদরের । আমাকে ছাড়া ওর এক মুহূর্ত চলে না । যখন তখন আবদার করে । বলে বিষ্ণু দা একটু চা খেতে ইচ্ছে করছে । বিষ্ণু দা, বাইরে বৃষ্টি একটু তেলেভাজা হলে কেমন হয় ? কিংবা আজকে একটু বিরিয়ানি হোক । আমি সমস্ত রান্না করতে পারি । ভাইয়ের জন্য সব করি । আপনাকে একটা কথা বলি । একটু গোপন কথা । কাউকে বলবেন না । একজনের কাছ থেকে ধার নিয়ে আমি কাপড়ের ব্যবসা করি । বাড়ি বাড়ি ঘুরে শাড়ি বিক্রি করি । ভাই জানে না । দুপুর বেলায় জেঠিমা আর ভাই যখন ঘুমায় আমি তখন বেরিয়ে পরি ।
নেতা ভদ্রলোক অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন বিষ্ণুর দিকে ।
বিষ্ণু বলেই চলেছে , আচ্ছা , আপনি বলুন , ছোট ভাই খেতে চেয়েছে অথচ বাড়িতে কিছু নেই । কেনার মত টাকাও নেই । এসব বাজে খরচের জন্য জেঠিমা টাকা দেবেন না । তাহলে ভাইটা খাবে কিভাবে ? তখনই ঠিক করি গোপনে একটা কাজ করতে হবে । ভাইয়ের এই আবদার গুলো যাতে মেটাতে পারি ।
ঠিক আছে বিষ্ণু । তোমার ভাইয়ের চাকরির ব্যবস্থা আমি করে দেব । তবে যদি তোমার নিজের জন্য কখনো কোন প্রয়োজন হয় তুমি চলে আসবে আমার কাছে । আমি আছি ।
চাকরি হয়ে গেল কার্তিকের । স্থানীয় মাধ্যমিক স্কুলে । তখনও স্কুল সার্ভিস পরীক্ষা চালু হয় নি । সুপারিশে চাকরি পাওয়া যেত । তখনকার দিনে অনেকেই ঐভাবে চাকরি পেয়েছে । কাগজপত্র সব নিয়ম মেনেই হত । এতটুকু অনিয়ম নেই । কেউ প্রমান করতে পারবে না যে পুরো ব্যাপারটাই সাজানো ।
স্কুলের লোক দেখানো ইন্টারভিউতে হাজির কার্তিক । অনেক ভালো ভালো ছেলে উপস্থিত । হলে কি হবে ? কার্তিকের নাম তো প্যানেলে এক নম্বর । কারোর কিছু করার নেই । জয়েনিং লেটার পেয়ে কার্তিকের আর আনন্দ ধরে না । বিষ্ণু সবাইকে বলে বেরিয়েছে যে তার ভাই নিজের যোগ্যতায় চাকরি পেয়েছে ।
টিউশনির বাজারেও কার্তিকের নাম ছড়িয়ে পড়েছে । এখন তার হাতে অনেক টাকা । বড়লোক বলা যেতে পারে ।
দুই ভাইয়ের ভাইয়ের খুব মিল । কার্তিক মাঝে মাঝে বড়দার বাড়িতে যায় । পার্বতীর বয়স হয়েছে । শরীর ভেঙে গেছে । রামানুজ আর উর্মি দেখা করতে আসে । পার্বতী কাঁদে । মুখে কিছু বলে না । না বলার কারন আজকাল পার্বতী কানে কিছু শুনতে পায় না । ডাক্তার দেখিয়েছে । ট্রিটমেন্ট হয়েছে । হিয়ারিং এইড ব্যবহার করতো । কিন্তু এখন আর তাতে কাজ হয় না । পুরোপুরি বধির । আকারে ইঙ্গিতে সব বোঝাতে হয় ।
কার্তিকের বিয়ের জন্য উঠে পড়ে লাগলো রামানুজ আর উর্মি । বর্ধমানের দিকে একটি উপযুক্ত পাত্রী পাওয়া গেল । সকলেরই পছন্দ । তবে বয়সে কার্তিকের চেয়ে অনেকটাই ছোট । মেয়ের বাড়িতে অবশ্য তাতে কোন আপত্তি নেই । ছেলেটি ভালো । সরকারি চাকরি করে । আর কি চাই ? বিয়ে হয়ে গেল কার্তিকের । বিষ্ণুর খুব আনন্দ । বাড়িতে নতুন ভাই বৌ । সে কিছুতেই ভাই বৌকে রান্না করতে দেবে না । রান্না কেন কোন কিছুই করতে দেয় না ।
বলে , আমি আছি কি করতে ? বৌদিমনি , তুমি আনন্দ ফুর্তি কর । ভাইকে নিয়ে একটু ঘুরে বেড়াও ।
জয়ীতা নতুন বৌ । সে কিন্তু অন্য কিছু ভাবলো । এই ক’দিনেই সে বুঝে গেছে যে এই সংসারের চাবি কাঠি বিষ্ণুর হাতে । তার স্বামী কোন কিছুতেই নেই । যা দরকার সব বিষ্ণু দাকে বলতে হয় ।আগে সব কিছু ছিল শাশুড়ির হাতে । তিনি অসুস্থ হওয়ার পর থেকে সংসারের চাবি চলে গেছে বিষ্ণুদার হাতে । তার স্বামীটাও হয়েছে একটা ঢ্যাঁড়স । কোন দিকে নজর নেই । টাকা পয়সা যেন হরির লুটের বাতাসা । বিষ্ণুদা দোকান বাজারে যে টাকা নিয়ে যায় তার কোন হিসাব চায় না তার স্বামী । এতো ভালোমানুষি ভালো নয় ।যে কোন ভাবেই হোক সমস্ত ক্ষমতা নিজের হাতে নিতে হবে । এই বাড়ির সব কিছু চলবে তার নির্দেশে । এমন কি বড়দা বৌদি ও এই বাড়িতে আসবে অতিথি হয়ে ।
প্রতি রাতেই স্বামীর কানে বিষ্ণুদার নামে একটু একটু করে বিষ ঢালা শুরু করলো ।
হেসে উড়িয়ে দেয় কার্তিক ।
বলে , তুমি বিষ্ণুদাকে চেনো না বলে এই সব ভাবছো । আমি নিজেকে বিশ্বাস নাও করতে পারি কিন্তু বিষ্ণুদাকে অবিশ্বাস করার কথা ভাবতেই পারি না ।
জয়ীতা বুঝতে পারলো যে স্বামীকে বলে কোন লাভ হবে না | যা করার তাকেই করতে হবে । বিষ্ণুর মুরুব্বি তার একদম ভালো লাগছে না । বাড়ির বৌ সে । তার নির্দেশেই সব চলবে । সমস্ত টাকা পয়সা থাকবে তার কাছে । এই বিষ্ণুটাকে তাড়াতেই হবে । কিন্তু এখনই না । সবুরে মেওয়া ফলে । বিষ্ণুটাকে এখন তার খুব দরকার । এই বাজারে বিনি পয়সার চাকর ভাবাই যায় না । এই সুযোগ হাত ছাড়া করা বোকামি হবে । পেটে বাচ্চা এসে গেছে ।আর কয়েক মাস বাদেই সে মা হবে । তখন সংসারে প্রচুর হ্যাপা । বিষ্ণুকে দিয়ে সব করাতে হবে । বাচ্চাটা একটু বড় হলেই ঝাঁটা মেরে তাড়াবে বিষ্ণু কে । এই ভাঙাচোরা বাড়িতে আর থাকা যাবে না । এরপরে একটা ফ্ল্যাট বুক করতে হবে । নতুন ফ্ল্যাটে উঠে যাবে । দু কামরার ফ্ল্যাট | সেখানে বিষ্ণুর থাকার কোন প্রশ্নই উঠবে না । । দরকার পড়লে বেকার ভাইকে এনে রাখবে । দোকান বাজারটা ভাইকে দিয়েই করানো যাবে । সে নিজে রান্না করবে । কাজের মাসি থাকবে । কোন অসুবিধে হবে না । মোটমাট বিষ্ণু কে ভাগাও ।
লোকে বলে জীবনটা অংক নয় । কিন্তু আশ্চর্য জনক ভাবে জয়ীতা যেমন চেয়েছিল ঠিক তেমনটাই ঘটলো । কার্তিককে পুরো অন্ধকারে রেখে দাবার ঘুঁটি সাজিয়ে ফেলল সে । তার ছেলে হয়েছে । ছেলের বয়স তিন বছর হতেই একটা নার্সারি স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছে । এখনই মোক্ষম সময় ।
একদিন রাত্রে জয়ীতা ইনিয়ে বিনিয়ে কার্তিককে বলল তার আশঙ্কার কথা । কার্তিক সারাদিন স্কুলে থাকে । বাচ্চাটাও স্কুলে । বাড়িতে শুধু সে আর বিষ্ণু দা । শাশুড়ি থেকেও নেই । কানে কিছুই শোনে না । তার থাকা না থাকা সমান । ফাঁকা বাড়িতে জয়ীতার খুব ভয় লাগে । ভয়ের কারন বিষ্ণু দা । বিষ্ণুদার কু নজর তার ওপরে পড়েছে ।
কার্তিক বলে , কি বলছো তুমি ? বিষ্ণু দা !
আমি কি মিথ্যা কথা বলছি ? সে তো মানুষ । তারও তো ইচ্ছা আছে । রক্ত মাংসের শরীর । জন্তু জানোয়ারের থাকে আর মানুষের থাকবে না ।
ছোটোর থেকে বিষ্ণুদাকে দেখে আসছি । তাকে চিনবো না ? তোমার কোথাও ভুল হচ্ছে ।
দেখ , মেয়েরা এসব ব্যাপারে পুরুষদের চেয়ে অনেক বেশি সচেতন । তারা তাকানো দেখেই বুঝতে পারে সেই তাকানোর অর্থ । আরে বাবা , এতদিন বাড়িতে কোন যুবতী মেয়ে ছিল না । কাজেই প্রশ্ন ওঠে নি । এখন রাতদিন আমাকে চোখের সামনে দেখছে । কাহাতক আর নিজেকে ঠিক রাখবে ? তোমাদের দুই ভাইয়ের বিয়ে হয়েছে । দুজনের বৌ আছে । তার তো নেই । হবে নাই ধরে নাও । সুতরাং আমি কি বলতে চাইছি তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছো । এরপর একটা কিছু ঘটে গেলে আমার গলায় দড়ি দেওয়া ছাড়া আর কিছু করার থাকবে না । তখন থেকো তোমাদের বিষ্ণুদাকে নিয়ে ।
কার্তিকের মাথায় যা ছিল না , জয়ীতা সুনিপুন ভাবে তাই তার মাথায় ঢুকিয়ে দিল । কার্তিক ভাবলো হতেও পারে । সেও তো মানুষ । কিন্তু কিছু তো একটা করতে হবে । রক্তের সম্পর্কে বিষ্ণুদা নিজের দাদা নয় । কিন্তু বিষ্ণুদার সঙ্গে এই সংসারের সম্পর্ক বহু বছরের । যেমন শক্ত তেমন মজবুত ।
বৌদির মাধ্যমে বড়দার কানে কথাটা তুলল জয়ীতা । তারাও ভাবলো সত্যি তো । একটা অল্প বয়সী মেয়ে সারাদিন বাড়িতে একা থাকে । বিষ্ণু যতোই হোক কাজের ছেলের বাইরে তো কিছু না । একটা অঘটন ঘটলে বাইরে আর মুখ দেখানো যাবে না । আর মায়ের যা অবস্থা হাজার চিৎকারেও শুনতে পাবে না । সত্যি তো এই ভাবে ভয় ভয় করে জয়ীতার পক্ষে থাকা অসম্ভব ?
সমস্যার সমাধান করলো জয়ীতা ।
বলল, দাদা আপনারা ওর একটা বিয়ে দিয়ে দিন । মেয়ে পক্ষের কাছ থেকে পণ নিয়ে বিয়ের খরচ মিটিয়ে বাকি টাকা দিয়ে একটা সস্তার বাড়ি ভাড়া করে দেবেন । আমাদের আর কোন দায় থাকবে না । নিজের বৌকে কিভাবে খাওয়াবে সেটা ও নিজে ভাববে ।
কথাটা ভেসে এলো বিষ্ণুর কানে । বিষ্ণু তো অবাক ! তার বিয়ে দেবার জন্য হঠাৎ সবাই উঠে পড়ে লাগলো কেন ? সে তো কাউকে বলে নি যে সে বিয়ে করবে । এর একটাই অর্থ । বিয়ে করা মানে বৌকে নিয়ে অন্যত্র কোথাও থাকা । তাকে তাড়াতে চায় এই বাড়ি থেকে ।চোখ ভিজে আসছে বিষ্ণুর । কত ছোট বেলায় এসেছে এই বাড়িতে । জ্যেঠু বলতেন তার তিন ছেলে । সে বিশ্বাস করেছিল জ্যেঠুর কথা । ভালোবাসার কোন খামতি ছিল না । সে নিজেও মন প্রাণ ঢেলে সবার সেবা করেছে । একটা টাকা পর্যন্ত সে নেয় নি । আজ এরা বুঝিয়ে দিল রক্তের সম্পর্কই আসল সম্পর্ক । সে নিজে সবাইকে আপন ভাবলে তো হবে না । বাড়ির সবাই বুঝিয়ে দিল যে সে কাজের লোক ছাড়া আর কিছু নয় । চাইলেই সম্পর্ক গড়া যায় না । ভালো হোক মন্দ হোক, নিজের লোক সব সময় নিজের লোক । ঘুণ ধরলেও সে সম্পর্ক থেকে যাবে । বাইরের লোক যত ভালোই হোক সে বাইরের লোক । আর কাজের লোকের তো একটাই পরিচয় । কাজের লোকের সাথে কখনো সম্পর্ক হয় নাকি ? কাজের লোক কখনো ঘরের মানুষ হয় না । সবটাই প্রয়োজন ভিত্তিক । লোক দেখানো ।
আর না । অনেক হয়েছে । ঘাড় ধাক্কা মারার আগেই সে চলে যাবে । বিশাল পৃথিবী । সে একা মানুষ । ঠিক কোথাও না কোথাও একটা কাজ পেয়ে যাবে । থাকার জায়গাও জুটে যাবে । যতদিন বাঁচবে একা একাই বাঁচবে ।
সমাপ্ত