Ashim Chandra Paul

আসুন শুধুই টাকা জমাই!

আজও ভাল-মন্দের ব্যবধান মানুষকে পীড়িত করে। মন্দের বেগ সাময়িক ভাবে শিয়ালের গতির মত বেশী হলেও শেষ পর্যন্ত কিন্তু কচ্ছপেরই জয় হয়-এটা ইতিহাস স্বীকৃত। ভাল কিছুকে বুঝতে মানুষের সময় একটু বেশী-ই লেগে যায়। ততক্ষণে ভাল অনেক সামনে এগিয়ে চলে যায়। যারা আবার তড়িৎ গতিতে দৌড়ে গিয়ে সত্যের পথ, মানবতার পথ ধরতে পারে তারাই সত্যের সত্যিকারের ধারক ও বাহক। এ সংখ্যাটি তখন আর কমে না কেবলি বাড়তে থাকে, অন্যায় কেবলি হারতে থাকে।
আমাদের সমাজে বই প্রেমীদের সংখ্যা দিন দিন আনুপাতিক হারে ও উদ্বেগজনক হারে কেবলি হ্রাস পাচ্ছে। সচিত্র বিনোদন সহজলভ্য ও সস্তা হলে কেউ কি আর কষ্ট করে চোখের জ্যোতি নষ্ট করে বিনোদন খোঁজার অনর্থক চেষ্টা করে!

বর্ষার শেষ দিকের কথা। দীর্ঘদিনের বিরতি শেষে আমার এক পাঠক শ্রেণীয় ও সাহিত্য সমালোচক বন্ধু
আমার শহরে বেড়াতে আসে। বর্ষার প্রবল অত্যাচারের কারনে সেদিন আর তার সাথে দেখা সাক্ষাৎ হয়নি।
পরদিন শুক্রবার। সকালের আলস্য উপেক্ষা করে সমালোচক বন্ধুর মূল্যবান সমালোচনা শোনার জন্য বাসা থেকে ছাতা সহযোগে বের হলাম।

কিছু দূর হাঁটাহাঁটির পর উভয়ে মিলে রামকৃষ্ণ মিশনে গিয়ে বসলাম। এখানে উটকোজনের ভিড় বরাবরই একটু কম থাকে। আজকাল ধর্ম ও জ্ঞানের কদর আমাদের সমাজে আশংকাজনক ভাবে কমছে।
প্রায় ঘন্টাখানেক বন্ধুর আলোচনা শুনে বইয়ের প্রতি আগ্রহ বেড়ে যাওয়ায় আমরা শহরের একটি নামকরা লাইব্রেরিতে চলে আসলাম।
লাইব্রেরীটির নাম বাতিঘর। অসাধারণ ও মনোমুগ্ধকর নাম! নিতান্তই সময়োপযোগীও বটে।
সমাজের একটি শ্রেণীকে অবশ্যই এই বাতিঘরের সমাজকে উজ্জীবিত করার এই ধারাকে চির বহমান রাখতে হবে। জ্ঞানের বাতি সকলের মনে প্রজ্জ্বলিত করতে হবে।
বাতিঘর নামক লাইব্রেরীর স্পীকারে তখন খুব ধীর লয়ে মনোহারিণী সুরে গজল বেজে চলেছে। দুজনের খুব ভালোই লাগছিল। নীরবতায় ও এখানকার পরিবেশে অনেকটা সময় কিভাবে কেটে গেলো বুঝতেই পারলাম না।

আমি নিজের জন্য বেশ কয়েকটি বই নিলাম। সাথে পর্যাপ্ত টাকা না থাকায় কিছু নগদ ও কিছু বিকাশে পরিশোধ করলাম। একবারও ভাবিনি তারা এই বইগুলো পরিবর্তন করে দিবে কি না কিংবা তাদের ব্যাবসায়িক পলিসি কেমন?তারা কতটুকু পাঠক বান্ধব?

বেশ কিছুদিন পর আরেকটি লাইব্রেরীতে গেলাম দুটে অব্যবহৃত বই পরিবর্তন করে আনার জন্য। তারা আমাকে যুক্তি দেখালো স্পোকেন ইংলিশ ও উপন্যাসের বই কারো ঘাড়ে একবার জুড়ে দিতে পারলে সেটি আর কোনভাবেই বদল করা যাবে না। তাদের কোম্পানি সেটা নাকি ফেরত নেবে না। তাদের যুক্তির কাছে বিন্দুমাত্র মুক্তি না পেয়ে পরাজিত মন নিয়ে ফিরে আসলাম। ব্যাবসায়ীদের জয় অনিবার্য একথা মনে প্রাণে আরো শক্তভাবে ধারণ করলাম।
ব্যবসায়ীদের কাছে একটি উপন্যাস ও একটি স্পোকেন ইংলিশের বইয়ের একইরকম মূল্য। একবার পড়ে ফেললে সেটি আর ফেরত দিয়ে অন্য বইও দেয়া যাবে না-এটিই ছিল তাদের যুক্তি।
আমরা প্রতিনিয়ত কত রকমের বিজ্ঞাপন দ্বারা প্রতারিত হচ্ছি। বেষ্টসেলার বই যদি কোনক্রমে আপনাকে দোকানদার হাতে ধরিয়ে দিতে পারে তবে সেটির বদল আর কোনভাবেই হবে না। বইয়ের বদলে বই চেয়েও পাওয়া দায়! সমাজে কি করে পাঠক বাড়বে? জ্ঞানের সাধন ত্বরান্বিত হবে?
এখন শুধু দায় হল পাঠ্যবই পড়া। দোকানি বলল,যদি পাঠ্যবই হতো আমি আপনাকে একশবার পরিবর্তন করে দিতে পারতাম।
অন্য বইয়ের এত দোষ! মানুষ শুধু পাঠ্যবই-ই পড়বে?
একটি উপন্যাস ভালো না লাগলে পরেরদিন পরিবর্তন করে অন্য একটি উপন্যাস নেওয়া যাবে না?
এটি তো আর মাছ মাংস না যে এক রাতেই পঁচে যাবে?
কি প্রচন্ড শক্তিশালী এই কোম্পানি গুলো?
দিনে দিনে শুধু কোম্পানি আর লাইব্রেরী মালিকরা ব্যাবসা করে যাবে এভাবে পাঠক ঠকিয়ে?
পাঠকের মুক্ত পছন্দ থাকতে পারবে না?পরিবর্তনের অধিকার থাকতে পারবে না? উপযুক্ত মেমোসহ!
এসব প্রতারণা বরাবরই পাঠককে সত্য সুন্দরের সাধনা থেকে দূরে সরিয়ে দেয়, যা কোনভাবেই পাঠকের কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না।
তাই আসুন, সবাই বই না পড়ে কেবল টাকা জমাই!
টাকা থাকলে আপনি তা দিয়ে কাঁচামাল কিংবা নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস সহজেই কিনতে পারবেন কিন্তু যদি টাকা খরচ করে বই একবার কিনে ফেলতে পারেন তবে সেটি হকারের কাছে কেজি দরে বিক্রি করা ছাড়া আর কিছুই করতে পারবেন না সেটি যতই মূল্যবান বই-ই হোক না কেন?

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *